চির মমতা তার অঙ্গে মাখা

শিক্ষার্থীরা প্রধান অতিথি ও স্কুল অধ্যক্ষের হাতে দিচ্ছে বিজয় ফুল
শিক্ষার্থীরা প্রধান অতিথি ও স্কুল অধ্যক্ষের হাতে দিচ্ছে বিজয় ফুল

‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি

মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’

একটি স্বপ্নকে সামনে রেখে বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে। বাংলা মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য টগবগে তরুণেরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আত্মাহুতি দেন দেশ মাটির জন্য।

মাইক্রোফোনে মুক্তিযুদ্ধকালের চিত্রটি ভেসে ওঠে। হ্যাঁ, একাত্তরের সে সময়টি তুলে আনেন অধ্যাপক আবু তাহের। তিনি বিজয় ফুল প্রদর্শন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। বলা হয়, তাদেরই উদ্দেশে আজকের এ পুষ্পার্ঘ্য।

মঞ্চে বিজয় ফুল প্রদর্শন
মঞ্চে বিজয় ফুল প্রদর্শন

১১ ডিসেম্বর ১১টা। আবুধাবির বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুলের এই আয়োজন। অডিটোরিয়ামে সেদিন প্রধান অতিথি ছিলেন আবুধাবির বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার ও চ্যান্সারি প্রধান শহীদুজ্জামান ফারুকী।

স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। তিনি বিজয় ফুল প্রদর্শন নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি ব্যাখ্যা দেন।

ফুলের ছয়টি পাপড়িকে ছয় দফা প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। এর কাণ্ড বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একপর্যায়ে দেশ হানাদার মুক্ত হয়। বাঙালি জাতি সেদিন বিজয় লাভ করে। এটাই বিজয় ফুল।

মঞ্চে ওরা কয়েকজন
মঞ্চে ওরা কয়েকজন

শিক্ষকদের পক্ষে বক্তব্য দেন স্কুলের উপাধ্যক্ষ কাজী আবদুর রহিম। তিনি বলেন, ফুল ও শিশু স্বর্গীয়। সুতরাং শিশুদের এ অর্ঘ্য আকাশের ওপার থেকে শহীদেরা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবেন।

নুরেমবার্গ আদালত এখনো যুদ্ধাপরাধ বিষয়টিতে নিরাপোস ও সক্রিয়। এই সত্যটি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক উৎসাহও বটে। এ গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মরণে পপি ফুল নিবেদনের প্রথাটি এখনো চালু। সেই চিত্র নিজের বুকে ধারণ করেন লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশের কবি শামীম আজাদ। তিনি ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি ফোরামের সদস্যও। তাঁরই দেওয়া ধারণা থেকে আজ বিজয় ফুল প্রদর্শন।

বক্তব্যে অধ্যক্ষ হাসান আরেকটি নামের উল্লেখ করেন। কৃতি সে নাম—এ কে আজাদ। তাঁরই স্কুলের ছাত্র। সে সময় তিনি ছিলেন জামালপুর বালক বিদ্যালয়ের স্কাউট লিডার। বলেন, আজকেও তিনি লিডার। এ জন্যই বিজয় ফুল প্রদর্শনের সরকারি সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব বর্তেছে তাঁর ওপর।

প্রধান অতিথি শহীদুজ্জামান ফারুকী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ত্যাগের বিনিময়ে জাতির অর্জন এই স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এমন আয়োজন। নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে দেশ, দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। দেশকে স্বাধীন করতে যাদের অবদান তাদের জানাতে বা চেনাতে এই উদ্যোগ সাহায্য করবে। তিনি বলেন, দেশকে জানতে প্রজন্মের কাছে এ এক অপূর্ব সুযোগ।

অর্থনৈতিক, কারিগরি ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই চলমানতার সঙ্গে নতুনরা নিজেদের সংযুক্ত রাখার আগ্রহও পাবে এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আয়োজনে একটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। শেখ রাসেল মুক্তমঞ্চ দেখলাম। সেখানে ফুল নিবেদন করা হচ্ছে শহীদদের প্রতি। আনন্দময় শৈশবে ছোটরা হোলি খেলছে। সজীব সুন্দর জীবনকে তুলে আনা হয়েছে এ চিত্রে।

মঞ্চে গান পরিবেশনা
মঞ্চে গান পরিবেশনা

মঞ্চে বিজয় ফুল হাতে দাঁড়ান শিক্ষকেরা। তাদের সামনে বসা ছিল কোমলমতি শিশুরা। ফুল ও শিশু, দুইয়ের মিলিত চিত্র মঞ্চকে আলোকিত করে তোলে। জ্বলজ্বলে এ ছবিতে ক্যামেরা আর মোবাইলের ক্লিক আলাদা এক শিহরণ জাগায়।

‘যে দেশের নীল অম্বরে মন মেলছে পাখা
সারাটি জনম সে মাটির দানে বক্ষ ভরি।’

ভরে যায় মন প্রাণ। আবৃত্তি, নৃত্য আর গান আলাদা ব্যঞ্জনা দেয়। দলীয় নৃত্য, দলীয় গানের মধ্য দিয়ে পরিবেশ আনন্দময় হয়ে ওঠে। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল...গানের এমন কথা নৃত্যের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করছিল ওরা। আনন্দ আনন্দ অনুভূতি সবার। ওদের চোখ মুখের সঞ্চালনই তার প্রমাণ। একক নৃত্য পরিবেশন করে রাবেয়া নূর। ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। দেশ প্রকৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় শ্রোতা-দর্শক।

নুজহাত আর পায়েল। ওরা দুজন নাচে। শাবাশ বাংলাদেশ...এমন প্রকাশের মধ্য দিয়ে জন্মভূমির প্রতি হৃদয়ের ভালোবাসাকে ঢেলে দেয় ওরা। সপ্তম শ্রেণির এই দুই নৃত্য কন্যার সঙ্গে কথা হয়। বলল, ভালো লেগেছে নাচ। কী এক অনুভূতি! রাফিয়া ও সাদিয়া দলীয় আবৃত্তিতে অংশ নেয়। ওরাও জানাল ওদের ভালো লাগা।

শুধু কী ওরা! বড়রাও এই অনুষ্ঠানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মিশেল জুরিয়ান। এই স্কুলের শিক্ষক। ফিলিপিনো। কেজি ক্লাসে শিক্ষা দেন। মায়ের মতোই বলেন, আমার বাচ্চারা ভালো করেছে। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমি ধন্য।

ইউনিভার্সেল হাসপাতাল থেকে এসেছেন মারিসেল অ্যাঞ্জেলেস। তিনি ওই কোম্পানির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। তিনি বলেন, আমি অভিভূত। এখানে আসার কারণে আমি এই কমিউনিটির সঙ্গে মেশার সুযোগ পাচ্ছি। তিনি কমিউনিটিকে চিকিৎসাসংক্রান্ত সহযোগিতার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন।

শহীদ মিনারের পাদদেশে কয়েকজন
শহীদ মিনারের পাদদেশে কয়েকজন

সে আমার প্রিয় জন্মভূমি। তাকে স্মরণ করতেই হয়।

‘যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদী জল ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আঁকা’

তাকে ভোলা যায় না।

ফুল ভালোবাসে না এমন কেউ মানুষ হত্যা করতে পারে। আর যে ভালোবাসে? সে মহান, মানবীয় গুণে ঐশ্বর্যময়। শাপলা ফুল আমাদের দেশে তেমন যত্ন আত্তি ছাড়াই বেড়ে ওঠে। পুকুর, দিঘি, খাল-বিল, ডোবায় সাদা পাপড়ির বিছানা মেলে বিকশিত হয়। তবে আউশ ধানের খেতে শাপলা ফুল ভালো জন্মে। আপনা-আপনি এর জন্ম। সে জন্য শাপলা জাতীয় ফুল।

বর্ষার মাঝামাঝি থেকে শরৎকালের শেষ পর্যন্ত শাপলা ফুল পাওয়া যায়। এ ফুলের কাণ্ড ও মূল থাকে পানির তলায়। অন্য দিকে পাতা ও ফুল পানির ওপর ভেসে থাকে। কী সুন্দর সে দৃশ্য! গ্রামের শিশুরা দল বেঁধে শাপলা ফুল তুলে নিয়ে আসে। ডাঁটা দিয়ে মালা গাঁথে।

সারা দেশে এই ডিসেম্বরে এই অনুষ্ঠান চলছে। চার কোটি শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করছে। এই এখানে আবুধাবির স্কুলছাত্ররাও আজ মালা গাঁথল। শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাগজ কেটে এই আয়োজনটি করলেন। মঞ্চে ফুটে উঠল একরাশ ফুল।

শহীদ মিনারের পাদদেশে লেখক ও অন্যরা
শহীদ মিনারের পাদদেশে লেখক ও অন্যরা

‘মোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি।’

গান বাজে প্রকৃতিতে। হৃদয় মাঝে তারই অনুরণন।

মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিকের কথাই আসে। নারীর মধু প্রেমেতে তার রক্ত দোলে। বিশ্বের ব্যাপারটি বাদ দেওয়া যায় না। শিশুর মায়া হাসিতে বিশ্ব ভুলে যায় সবকিছু। কপোত-কপোতী সুখ স্বর্গের দুয়ার খুলে বসে। সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে তার যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধা সে কারণেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অনুমান করি, তার হাত ভরে ওঠে বিজয় ফুলে। একাত্তর সে জন্যই মহান। মুক্তিযুদ্ধ একই কারণে মহাভারত।

এ এক অনুভব! আয়োজনে দেখি, এমনই একটি মূল্যায়ন মনে মনে। যাদের জন্য একটি দেশ, একটি পতাকা, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা সবার। দেশ মাতার জন্য মমতা তার। বুঝি, সে শিহরণ অঙ্গে মাখা। বিজয় ফুল অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।