অদৈব দংশন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঝমঝম করে থেকে থেকে বৃষ্টি ঝরছে। প্লাস্টিকের ছাউনির ওপরে ঝমঝম শব্দটা আরও অনেক বেশি অনুভূত হতে থাকে বুন্দিরার কাছে। আজ আর কাজে বের হতে পারেনি। বৃষ্টি সবকিছু পণ্ড করে দিয়েছে। একবার বেড়ার ফাঁক দিয়ে শাকুরের দিকে তাকায়। নতুন বউ খিলখিল করে হাসছে। শাকুর আলতো ছোঁয়া দিচ্ছে। এতটুকু দেখেই বুন্দিরা বেড়ার ফাঁক থেকে সরে আসে।

এক স্বামীর তিন–চারটা বউ থাকবে। বউরা সারা দিন বাইরে এ গ্রাম ওই গ্রাম ঘুরে ঘুরে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে আয় রোজগার করবে। আর স্বামীরা ঘরে বসে বসে বউয়ের রোজগার খাবে। এই হলো বেদে পাড়ার নিয়ম। বিয়ের সময়ই মেয়েরা এই প্রতিজ্ঞায় রাজি হয়। তারপর বিয়ে হয়। সব বউয়েরা তাই করে। স্বামীরাও অনেক সময় কাজ করে। সেটা তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সাপের খেলা বেদেনীরা দেখালেও সাপ ধরার কাজটা বেদেরাই করে। দুই–তিন স্ত্রী থাকে সবার। কিন্তু শাকুরের বেলাতেই একটু ব্যতিক্রম। বিয়ে এত দিন যাবৎ একটাই ছিল। সবাই দ্বিতীয়, তৃতীয় বিয়ের জন্য চাপাচাপিও করেছে। কিন্তু করবে করবে করেও শাকুর কেন যেন পিছিয়ে যেত। অবশেষে কয়েক মাস আগে, কাকলিকে এনে ঘরে তোলে।

লেখিকা
লেখিকা

বেদে পাড়ার লোকজন এক জায়গায় কেউ স্থায়ী হয় না। কিছুদিন এই নদীর পাড়ে। কিছুদিন ওই নদীতে চর জেগেছে সেখানে। কখনোবা খালের পাড়ে জমি পড়ে আছে। এসে তারা আশ্রয় নেয়। জায়গায় জায়গায় ঘুরে যাযাবরের জীবন পার করে। সেবার নোয়াখালীতে খালের পাড়ে বিশাল জায়গায় সবাই মিলে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে একেকটি মাচা তৈরি করে। এক মাচায় বুন্দিরা ছোট সংসার সাজায়।

শাকুর বলে, বুন্দিরা তুই যহন কামে চলি যাস, মাথাত সাপের ঝুড়ি লই আঁর কথা কি তোর মনে থাহেনি?

বুন্দিরা খেমটি মেরে বলে, নাহ। তোর কথা আঁর কোনো কালেই মনে থাহে না।

: তোর একমাত্র সোয়ামি এহনো দ্বিতীয় বিয়া করে ন, আর তুই এই কতা তারে হুনাইলি কেমনে।

: এহন কি বিয়া আরেকডা কইরতি চাসনি।

: এহনো সিদ্ধান্ত নি ন। তুই কী কস।

: ওমা, আঁই কী কমু। বিয়া করবি তুই আঁই কী কমু। বেদে হাড়ার মইধ্যে কাউরে কি মনে ধরছেনি?

: নাহ। এইহানে মনে ধরে ন।

: তাইলে কোনহানে মনে ধরছে। কুলের বাইরে অন্যহানে চোখ দিলে, আগুনে হুইড়াই মরবি। কিচ্ছু হাইবি না।

: যাহ। এইহান তুন অহন যাহ। আঁরডা আঁরেই ভাবতি দে।

শাকুরের মনমেজাজ আজকাল ভালোই থাকে। না হলে, বুন্দিরাকে হয়তো দুই–একটা সহনীয় মারত। মার পড়লে বুন্দিরাও ছাড়ে না। পালটা মারতে যায়, সেই সঙ্গে মুখতো চলেই। বেদে পাড়ার সবাই এমন। শাকুরের তাই আর এই রকম মেয়ে বিয়ে করার খায়েশ জাগে না। এ জন্য দ্বিতীয় বিয়ে এখনো হয়ে ওঠেনি। শাকুরের ভালো লাগে গৃহস্থ ঘরের মেয়ে। স্বামীর কথা শুনবে, পা টিপে দেবে, রেঁধে খাওয়াবে, রাত অবধি গান শোনাবে, ঘুম আসার আগ পর্যন্ত। শাকুরের মনে মনে এমন মেয়ের স্বপ্ন। কিন্তু বেদে পাড়ায় এমন নিয়ম নেই। নিজেদের মতোই সবাই বিয়ে করে, বেদে–বেদেনীদের সংসার। আর গৃহস্থ ঘরের কেউ শাকুরের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। কোনো গৃহস্থ ঘরের মেয়েও বেদেদের পছন্দ করে না। কত মেয়ে রাস্তাঘাটে, স্কুলে–কলেজে আসে যায়, কোনো দিন শাকুরের দিকে ফিরেও তাকায়নি। শাকুর তবুও আশা ছাড়ে না। সব সময়েই গৃহস্থ ঘরের একটা ছটফটে সুন্দর মেয়ের কথা ভাবে।

বুন্দিরা এই বাড়ি, ওই বাড়ি ঘুরে মানুষের দাঁতের পোকা ফেলে, শিঙা দিয়ে বাতের রক্ত নামায়, কাউকে সাপে কাটলে বিষ নামায়, সাপের খেলা দেখায়, বানরের গণা করে। একেক দিন একেকটা নিয়ে বের হয়। যা আয় করে দুজনের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। শাকুরের ঘরে একলা ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে হাতের কাছে যা পায় তা নিয়ে বেরিয়ে যায়। বানর পেলে বানর নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাপ পেলে সাপ। আবার কয়দিন পরপর সাপ ধরে আনা লাগে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে খবর দিলে, দু-একজনকে নিয়ে গিয়ে সাপ ধরে আনে। বিষ দাঁত ফেলে দিয়ে বুন্দিরাকে উপহার দেয়। রং বেরঙের বাহারি সাপ দেখলে বুন্দিরার মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। বিভিন্ন সাপ দিয়ে সাপের খেলা জমে ভালো।

শাকুর বানরের ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ‘এই বানরের গণা, বানরের গণা’ বলে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় হাঁক দিতে থাকে। একটা তেরো–চৌদ্দ বছরের মেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার কিনারায় এসে ডাক দেয়।

: বানরের গণা, আন্নে এত দিন আইয়েন ন কিল্লাই?

: তুঁই কি খুজ্জিলানি?

: হ, খুঁজ্জিলাম।

: বাড়িত আইয়েন।

শাকুর মেয়েটার পেছনে পেছনে বাড়ির দিকে যেতে থাকে। দুই–একটা কথাও বলতে থাকে।

: তুঁই আঁরে খুঁজ্জিলা কিল্লাই?

: আন্নের বাঁন্দরের গণা হাছা হয়, হেইটার লাই।

: তোঁয়ার নাম কী?

: আঁর নাম কাকলি। আন্নের বাঁন্দর আঁরে হরীক্ষায় হাস কারায় দিসিল। এবারের হরীক্ষায় হাস করাইবনি?

: করাইব। অবশ্যই করাইব। চল বান্দররে দি গণাই।

দুজনে বাড়িতে আসে। কাকলি তার মা, ভাই-বোনদের ডাক দেয়। সবাই মিলে মহাসমারোহে বানরের গণা দেখতে থাকে। প্রথমে কাকলিরটা শুরু করে। বানর ইশারাইঙ্গিতে কী যেন বলতে থাকে। শাকুর সেই অনুযায়ী বয়ান দেয়। কাকলি রানি সরকার। বয়স তেরো-চৌদ্দর মাঝামাঝি। পড়ালেখায় মন কম, অস্থির মন। তাই পরীক্ষার ফলাফলের জন্য বান্দরের শরণাপন্ন হয়। সঙ্গে সঙ্গে বানর শাকুরের দিকে তেড়ে এসে খামচি মারে। শাকুর সঙ্গে সঙ্গে কথা পরিবর্তন করে নেয়। বান্দরকে ভালোবাসে, তাই বান্দরের শরণাপন্ন হয়। ভাগ্যবতী মেয়ে, যে ঘরে যাবে সে ঘর ধনে-জনে পূর্ণ করবে।

এবার কাকলি লজ্জা পায়। কথা অন্যদিকে সরানোর জন্য বলে, এবারের হরীক্ষায় হাশ করুম কিনা হেইডা কন?

শাকুর দুটি কাঠি নিয়ে রাখে। কাকলিকে বলে একটা কাঠি তুলতে। কাকলি মনে মনে ঈশ্বরকে ডেকে, কাঠি তোলে। শাকুর বলে, তুঁই হাস কইরবা। কাঠিতে হাস উঠছে। কাকলি দৌড় দিয়ে ঘরে গিয়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এনে দেয়।

এরপর কাকলির অন্য ভাই-বোনদেরটাও গণা করে। কাকলি মনে মনে যেমন বানরকে কৃতজ্ঞতা জানায়, তেমনি বানরওয়ালার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জন্মায়।

শাকুর বাড়ি আসার পর থেকেই কেন যেন বারেবারে কাকলির কথা মনে আসতে থাকে। কী সহজসরল মেয়ে, সবকিছু কীভাবে বিশ্বাস করে ফেলল। কেমন ছটফটে, কী সুন্দর চঞ্চল একটা মেয়ে। এই মেয়েটাকে যদি...। বয়স কম। হয়তো আসতে আসতে প্রেমের কথা বলে পটানো যাবে। বিয়েতো তারা দেবে না, ভাগিয়ে আনতে হবে। শাকুর ভাবে আর রং বেরঙের স্বপ্ন দেখে।

শাকুরের মন অস্থির অস্থির লাগতে থাকে। আবার দুই দিন পর সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। হাঁক ডাক দিতে থাকে। কাকলি ছুটে আসে।

: বান্দরওয়ালা আইজকা আইছেন যে। আইজকাতো আর গণা কইরতাম ন।

: আইজকা গণা করতে আসি ন। তাইলে কী করতে আইছেন?

: আগে এক গেলাস জল দাও। তারহর কথা কমু।

কাকলি ঘরের থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে আসে।

শাকুর জল খায়, বিশ্রাম নিতে একটু সরে গাছের তলায় গিয়ে বসে। কাকলিও আসে।

: অনেক দূরের তুন আইছেন?

: হ আইছি। আবার চলি যামু। এই দেশ, ওই দেশ ঘুরে, যাযাবরের জীবন সবকিছু কাকলিকে বলে। পথঘাট, নদনদী, খালবিল সবকিছুর বর্ণনা দেয় কাকলির কাছে। কাকলির চোখে ঘোর লেগে যায়। এত কিছু কাকলিতো কখনো দেখেনি। এই গ্রাম, এই জনজীবন ছাড়া যে কাকলি কিছু জীবনে কখনো দেখেনি। যাযাবরের জীবন কত সুন্দর! কোনো বাধা নেই, কিছু নেই। একই রকম জীবন। জীবনে কোনো উচ্চাশা নেই, লোভ নেই। এমন জীবন যদি কাকলি পেত।

এমন ভাবনার সময় ঘর থেকে ডাক পড়ে। মা, ভাই-বোনেরা সবাই আসে। মা কাকলিকে কাছে ডেকে বলেন, এই বেডার লগে এত কথার কি আছে?

: না, আম্মা হেতাগো জীবন কী সুন্দর! আঁই হেইটা হুইনতেছিলাম।

মা শাকুরকে বলেন, আইজকা কী কাজ এইহানে?

: সাপ ধইরতাম আইছি। হুইনছি আন্নেগো বাড়িত অনেক সাপ আছে।

: ঠিক আছে, সাপ ধইরবার আইছ সাপ ধর।

শাকুর বিন বাজিয়ে বাজিয়ে এক এক করে সাপ ধরে। কাকলি বিমোহিত হয়ে দেখে। শাকুর যাবার সময় আবার কী অছিলায় আবার আসবে তা ভেবে, কাকলির মাকে বলে, বেগগুন ধইরতে হারি ন। কিছু বাকি রইছে। আবার আইয়ুম।

কাকলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আসার প্রতিজ্ঞা করে। পরদিন আবার আসে, কিন্তু মা কাকলিকে দেখা করতে দেয় না। আবার কিছু সাপ ধরা বাকি আছে, বলে কয়দিন পর আবার আসে। কিন্তু কাকলির দেখা মেলে না। শাকুর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু হায় বৃথা। ঘুরেফিরে কাকলির কথাই মনে আসে।

ওদিকে কাকলিও মনে মনে আসা করে থাকে, কখন শাকুরের দেখা মিলবে। কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ কোনভাবেই যেন শাকুরের সঙ্গে দেখা না করে, কথা না বলে। মায়ের চুলতো আর এমনি এমনি পাকেনি। কাকলির চোখ-মুখ, মনের অস্থিরতা দেখে মা সব বুঝে নিয়েছেন।

কয়দিন পর শাকুর আবার আসে। কিন্তু বাড়িতে আর আসে না। যেই পথ দিয়ে কাকলি স্কুলে যায়-আসে সেই পথে এসে দাঁড়ায়। কাকলি স্কুল থেকে ফিরছে। কাকলিকে দেখে শাকুর কথা বলতে উদ্যত হয়। কাকলি বান্ধবীদের সঙ্গে থাকায় ভদ্রতাবশত দুই–একটা কথা বলে চলে যায়। দুই দিন পর পর শাকুর এই পথ ধরে দাঁড়ায়। দুই-একটা কথা বলে। এভাবে শাকুর প্রায়ই আসে। কখনো দুজনে অল্প কিছু কথা বলে, কখনো মামুষজন না থাকলে বেশিক্ষণ কথা বলে। কখনো নিরিবিলি লোকচক্ষুর আড়ালে গাছের নিচে বসে কিছু সময় কাটায়।

এ ভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু বেদে পড়ার নিয়ম এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে পারবে না। সবাই ঠিক করেছে, চাঁদপুরে নদীর কাছে চরের মতো জেগেছে, সেখানে কিছুদিনের জন্য আবাস গড়বে। সবাই ভাসমান ঘরবাড়ি গুটাতে শুরু করে। মঙ্গলবার শুভদিনে রওনা হবে। শাকুর ধীরে ধীরে সবকিছু গুটায়, যেন তেমন তাড়া নেই।

এবার কাকলির স্কুলের পথিমধ্যে নিরিবিলি রাস্তা দেখে গাছের নিচে শুষ্ক মুখে বসে থাকে। কাকলি দূর থেকে দেখে বুঝতে পারে। বান্ধবীদের থেকে ছলাকলা করে সরে আসে।

: বান্দরওয়ালা কী হইছে তোঁয়ার? মুখ এরুম দেখাইতেছে কিল্লাই?

শাকুর কাকলির হাত ধরে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বলে, আমরা যে চলি যাইয়ের কাকলি।

: কই যাইতাছ?

: চাঁদপুরে এক নদীর পাড়ে চর জাগছে হেইখানে।

: ওমা তো কী হইছে! এত ভাঁঙ্গি হড়নের কী আছে! আঁরে নিবানি তোঁয়ার লগে?

শাকুরের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়।

: তুঁই যাইবা আঙ্গোর লগে?

: হুম, যামু। আগামীদিন ঠিক এইসময় এইহান তুন আঁরে লই যাইবা। আঁই অপেক্ষা করুম।

কাকলি চলে যায়। শাকুর আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যায়।

পরদিন ঠিক এই জায়গায় কাকলি নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে একা একা হেঁটে আসতে থাকে। বারবার নিজের বাড়ির দিকে তাকায় আর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। শাকুর এগিয়ে আসে, কাকলির চোখের জল মুছে নিজ পাড়ায় নিয়ে যায়। এদিকে পুরো গ্রামময় হয়ে যায়, বানরওয়ালা কাকলিকে তাবিজ করে ভাগিয়ে নিয়েছে। কাকলির বাবা লোকজন নিয়ে বেদে পাড়ায় গেলেও কাকলি ফেরত আসে না। সেখান থেকেই তারা চাঁদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়।

বেদে পাড়ার নিয়ম অনুযায়ী সবাই বিয়ের ব্যবস্থা করে। বুন্দিরা নিজে কাকলিকে ঘরে তোলে। গৃহস্থ ঘরের মেয়ে তাই কাকলির প্রতি বুন্দিরার প্রথম দিকে মায়া-মমতা থাকলেও কিন্তু পরে বিষিয়ে ওঠে।

এই মেয়ে বাইরে কোনো কাজে যায় না। সারা দিন দুইটা রান্না করে আর জামাই নিয়ে পড়ে থাকে। মাচার মতো ঘরে একটু রান্না ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। মাঝে মাঝে শাকুর কাজে বের হয়, তা দিয়েই দুজনের হয়ে যায়। বেদে পাড়ায় সব বউরাই কাজে বের হয়, শুধু কাকলি ছাড়া। দুই–তিন বউ সবারই থাকে। পালাক্রমে সব বউদের কাছেই সব স্বামীরা যায় শুধু শাকুর ছাড়া। শাকুর কাকলি ছাড়া কিছুই বোঝে না। বুন্দিরার দিকে ফিরেও তাকায় না। এই মেয়ে নিশ্চয়ই শাকুরকে বশ করেছে। বুন্দিরার চোখে কাকলিকে বিষের মতো লাগে। কাকলির দিকে ফিরেও তাকায় না। তাকালেই যেন চোখ দিয়ে ঈর্ষার উত্তাপ বের হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঘাড় ধরে বের করে দিতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। শাকুরের বিয়ে করা স্ত্রী।

বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম তাই আজ আর বুন্দিরার কাজে বের হতে হয়নি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে শাকুর আর কাকলির রঙ্গলীলা দেখেছে বুন্দিরা। বুকের ভেতর শুধু ছটফট করতে থাকে যেন বুকের মধ্যে একেকটা সাপ ছোবল মারছে। বুন্দিরা মাচার বাইরে আসে। হায় হায় সাপগুলো সব ঝুড়ির বাইরে। এটা বানরের কারসাজি। বানর বৃষ্টিতে ভিজছে, কিন্তু সাপ ঝুড়ির মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজছে না কেন! উভয়ই পোষা। তাই বানর ঈর্ষান্বিত হয়ে, সাপের ঝুড়ির ঢাকনা খুলে দিয়েছে। সাপও যেন বৃষ্টিতে ভিজে। সাপগুলো সব ঝুড়ি থেকে বের হয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। বুন্দিরা ছুটে গিয়ে বানরকে ভর্ৎসনা করতে করতে সাপগুলোকে ধরে ঝুড়িতে ভরে। ঈর্ষা যেমন প্রাণিতে তেমনি মনুষ্যে। মাঝে মাঝে মনুষ্যের ঈর্ষা অন্য সব প্রাণিকেও ছাড়িয়ে যায়।

সাপ রাখতে রাখতে বুন্দিরার মনে নতুন ভাবনার উদয় হয়। এই সাপের দংশনে যদি কাকলিকে সরানো যায়। পথের কাটাতো দূর হবেই, শাকুরকেও ফিরে পাওয়া যাবে। কাকলি আসার আগে বুন্দিরা জানতই না, শাকুরকে বুন্দিরা এতখানি ভালোবাসে। এখন শাকুরকে পাওয়ার জন্য এতটা উতলা থাকে। কিন্তু শাকুর ফিরেও চায় না। সব এই সাপিনীর কারণেই হয়েছে। একে কালসাপ দিয়েই মারতে হবে।

পরদিন ভোর হতেই বুন্দিরা সাপের সন্ধানে বের হয়। শাকুরের ছোট ভাই নতুন পদ্মগোখরো সাপ ধরে দেবে বলেছে, বুন্দিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার সঙ্গে গিয়ে সাপ নিয়ে আসে। বিষদাঁত না ফেলে সাপটাকে খুব সাবধানে রাখে। আর গভীর রাতের অপেক্ষায় থাকে। কাকলি মারা গেলে সব আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে, শাকুর আবার আগের মতো থাকবে। আর কোনো বিয়ের দরকার নেই। শুধু বুন্দিরাকে নিয়ে থাকলেই চলবে। বুন্দিরা চোখের জল মুছে নেয়।

রাতের শেষভাগে বুন্দিরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে কাকলিকে ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করে নেয়। কাকলি ডান কাত হয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বুন্দিরা কাকলির বুক, পেট, হাত, পায়ের ঠিক কোলের মধ্যে খুব সাবধানে পদ্মগোখরো রেখে দেয়। গোখরো কিছুই করে না, চুপচাপ বসে থাকে। কিছু সময় যাওয়ার পর শাকুর ঘুমের মধ্যেই কাকলিকে কাছে টেনে নেয়। শাকুরের শরীর প্রায় পুরোই কাকলিকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। শাকুরের পায়ের মধ্যে কেমন যেন ঠান্ডা-শীতল অনুভূত হয়। সাপ হতে পারে কিন্তু বিষদাঁততো নেই। স্বভাবগতভাবেই শাকুর লাথি মারে। পদ্ম গোখরো দ্বিগুণ ফুলে ওঠে। ফোঁস করে শাকুরের পায়ের মধ্যে দংশন করে। শাকুর চিৎকার করে ওঠে, কালগোখরা আঁরে খাইছে রে...তোরা আঁরে বাঁচা। কাকলি তাকিয়ে দেখে গোখরো চলে যাচ্ছে। কী করতে হবে, কাকলি জানে না। শুধু চিৎকার করে, আর কাঁদে।

বুন্দিরা ছুটে আসে, এইডা কী হইছে, চাইছি কী হইছে কী। বুন্দিরা শাকুরের শরীরে বান দেয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিষ মস্তকে চলে গেছে। শরীর–মুখ নীল হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। বুন্দিরা বিন বাজায়, মন্ত্র পড়ে, বেদে পাড়ার কেউ চেষ্টার ত্রুটি করে না। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় না। শাকুর প্রাণত্যাগ করে। বুন্দিরা মাটির সঙ্গে মাথা আছড়ে আছড়ে কাঁদতে থাকে। কাকলির চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে নীরবে।

মৃতদেহ সবাই মিলে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। কেউ কাকলির মুখে কোনো দানাপানি দিতে পারে না। তিন দিন যাওয়ার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে, কাকলি নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে চাঁদপুর থেকে নোয়াখালীর দিকে একা একা হাঁটতে থাকে। ঠিক যেভাবে নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছিল ঠিক সেভাবেই বারবার শাকুরের ছোট্ট মাচার দিকে তাকায় আর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।

নূর নাজমা: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।