টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ অফিসে সকাল থেকেই মাল ডেলিভারির চাপ থাকলেও রাকিব পাঁচটার সময়ই অফিস থেকে বের হতে পেরেছে। শীতের শেষে বসন্তকাল এসে গেছে বলে এখন বৃষ্টিবাদল অনেক কমে গেছে। তাই চারপাশে কনস্ট্রাকশনের কাজ বেড়ে গেছে। সকাল থেকে টানা তিনটা পর্যন্ত ডেভিড ইটন ও সে ব্যস্ত ছিল। তিনটার সময় শেষ ডেলিভারি দেওয়ার পর আর নতুন কোনো ডেলিভারি দিতে হয়নি বলে ওরা অফিস থেকে নেমে পাশের ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছে। ম্যাক-চিকেন বার্গার, চিপস ও স্প্রাইট। অফিসে ফিরে এক কাপ গরম ব্ল্যাক কফি। তারপর পাঁচটার মধ্যেই কম্পিউটারে সব ডেটা এন্ট্রি করে অফিস থেকে বের হয়।

অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাকিব ভেবেছিল, বাসায় ফিরে অফিসের কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে কাছেই একটা ফুড সুপারমার্কেটে যাবে। গত এক সপ্তাহ ধরে কোনো বাজার করা হয় না। কিন্তু বাসার সামনে ড্রাইভওয়েতে উঠতেই দেখল, ড্রাইভওয়ের একপাশে একটা গাড়ি। রাকিব গাড়িটা চেনে। গাড়িটা জাহিদের। সামনে ভালো করে তাকাতেই রাকিব দেখল, জাহিদ সিঁড়ির ওপরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

রাকিব গাড়ি থেকেই গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আরে, জাহিদ যে?

জাহিদ বলল, এই তো চলে এলাম।

: ভালো করেছ। ফোন দাওনি কেন?

: তুমি তো অফিসে সহজে ফোন ধর না।

: এখন ধরি।

: কেন, নদী বলে দিয়েছে?

রাকিব একটু শব্দ করেই হাসল। জাহিদও সায় দিয়ে হাসল।

রাকিব গাড়িটা ড্রাইভওয়ের এক পাশে পার্ক করে নেমে জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছ?

জাহিদ বলল, এই তো দশ মিনিটের মতো হবে। আমি তাওরাঙ্গা থেকে সময় হিসাব করে এসেছি। পাঁচটার সময় তোমার অফিস শেষ। সেই পাঁচটাকে টার্গেট করে চারটা বাজার দশ মিনিট আগে তাওরাঙ্গা শহর ছেড়েছি। আমি জানি, তাওরাঙ্গা থেকে হ্যামিল্টন আসতে এক ঘণ্টা দশ মিনিট লাগে। কিন্তু আজ এক ঘণ্টার মধ্যেই চলে এসেছি।

: ও আচ্ছা। আজ তোমার কাজ ছিল না?

: ছিল। তবে আড়াইটার সময় কাজ শেষ হয়ে গেছে। সিকা নামে কিউই ফ্রুটের যে অরচার্ডে কাজ করতাম, আজ ওটার প্রুনিং করে শেষ করেছি। আগামীকাল থেকে নতুন বাগান ধরব।

রাকিব সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ কী ভেবে হ্যামিল্টনে?

জাহিদ বলল, আর কী ভেবে! বাসায় ফিরে স্যারের কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই স্যারকে দেখতে চলে এসেছি।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, হ্যাঁ, তা তো স্বাভাবিক। সেদিন যে তোমার সঙ্গে গেলাম তারপর আমিও আর আজমল স্যারকে দেখতে যেতে পারিনি। ভালোই হয়েছে। তোমার সঙ্গে আজমল স্যারকে আজ দেখে আসব।

জাহিদ সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ভালো হবে। স্যার আমার সঙ্গে তোমাকে দেখলে খুশি হবেন। যদিও স্যারের খুশি হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মানসিক একটা সাপোর্ট পাবেন। ভাববেন, তিনি এতটা অসহায় নন।

রাকিব একটা ভারী নিশ্বাস ছেড়ে বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা জাহিদ, স্যারের জন্য কি কিছু করা গেল না?

: না রাকিব, কী করা যাবে? তাওরাঙ্গা সিটিতে যেসব বাঙালি বসবাস করে তাদের কেউ একজন এগিয়ে আসেনি। আসলে আমরা তাওরাঙ্গায় নতুন তো, তাই।

: হ্যাঁ, ওটাও একটা কথা। তারপরও এই বিদেশে একজন বাঙালি অন্য একজন বাঙালির জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত।

: তুমি তো উচিতের কথা বলছ। তুমি কী মনে কর না, স্যারকে যে ধরিয়ে দিয়েছে সে বাঙালি নয়? অবশ্যই বাঙালি। কাকের মাংস যেমন কাকে খায়, এখানকার বাঙালিরা সেরকমই।

: সবাই এক রকম নয়।

: আমি জানি। এখানে আরেক দল মানুষ আছে তারা তেলের মাথায় তেল ঢালে।

: তাও ঠিক। কিন্তু ভালো-খারাপ নিয়ে সমাজ। প্রত্যেকটা কমিউনিটিতেই ভালো-মন্দ মানুষ আছে। আমরা আমাদেরটা দেখছি। অন্যেরা তাদের কমিউনিটির মানুষগুলো দেখছে। একটা কমিউনিটি থেকে ভালো কনসেপ্টটা নিলে ভালো হয়। মন্দটা নিলে মন্দ হয়। আমাদের কমিউনিটির কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলে দেখনি, এখানকার বাঙালিরা সাহায্য করার জন্য কীভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে?

: তা দেখেছি। আমি তোমার কথাও মানি। তবে আজমল স্যারের ব্যাপারটা নিয়ে এই কয়দিন যা দেখেছি, তা আমার জন্য নতুন একটা অভিজ্ঞতা। বাসায় স্যারের ব্যাপারটা নিয়ে তিনবার পুলিশ এসেছে। আমি যে বাসায় থাকি সেটা মূলত স্লিপ আউট। বাসার যে মালিক হেদায়েত ভাই, তিনি স্যারের ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশ আসবে জেনেও একবারও বাসায় থাকেননি। ইচ্ছে করেই তিনি এই কাজটা করেছেন। অথচ তার জন্য আমাকে পুলিশের কাছে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। আচ্ছা, পুলিশের কথা বাদ দাও। সেই হেদায়েত ভাইয়ের অধীনে আমরা কাজ করেছি। আমি এখনো তার অধীনেই কাজ করি। অথচ স্যারের এই দুর্দিনে স্যারের কাজের আট হাজার ডলার মেরে দেওয়ার ধান্দা করে বসে আছেন।

: স্যারের আট হাজার ডলার মেরে দেওয়ার ধান্দা মানে?

: ও, তোমাকে তো বলিনি। তিনি স্যারের ব্যাপারটা নিয়ে কিচ্ছা-কাহিনি পাকাচ্ছেন। তাকে নাকি কী সব হাজার হাজার ডলার অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফি ও লইয়ার ফি দিতে হবে। অথচ তার জন্য আমি পুলিশের কাছে মিথ্যে বলেছি যে স্যার তার এখানে মাত্র চার-পাঁচ দিন কাজ করেছেন...।

: কিন্তু স্যার তো তার ওখানে দুই কী আড়াই মাস কাজ করেছেন?

: হ্যাঁ। ওটা হেদায়েত ভাইকে ট্যাক্স অফিস আর ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বাঁচানোর জন্যই মিথ্যে বলেছি। স্যারকে তো হেদায়েত ভাই বৈধভাবে কাজ দিতে পারেন না। স্যার এ দেশে অবৈধ না?

: তাহলে তো তিনি আজমল স্যারকে উপকারই করেছেন।

: তা করেছেন। কিন্তু স্যারের এই দুরবস্থায় স্যারের আট হাজার ডলার মেরে দেওয়ার ধান্দাটাও ঠিক না।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হুম। আচ্ছা জাহিদ, আমি ভেতর থেকে অফিসের কাপড়চোপড় ছেড়ে আসি। একটু বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তোমার-আমার জন্য কফি বানাব। কফি খেতে খেতে গল্প করব। আজমল স্যারকেও দেখতে যাব। ও হ্যাঁ, তুমি কি খেয়ে এসেছ? ফ্রিজে সবকিছু রান্না করা আছে। গরম করে দিই?

জাহিদ বলল, না না, আমি খেয়ে এসেছি। তুমি ব্যস্ত হবে না। ফ্রেশ হয়ে এসে কফি বানাতে চেয়েছ কফি বানাও।

: আজ রাতে থাকবে তো?

: না, আমি স্যারকে দেখে চলে যাব।

: না কেন? এত দূর থেকে এসেছ। আজ থেকে যাও।

: আগামীকাল সকাল থেকে নতুন অরচার্ডে কাজ ধরতে হবে। আর তো বেশি দিন কিউই ফ্রুটের উইন্টার প্রুনিং নেই। উইন্টার প্রুনিং শেষ হলে হ্যামিল্টন চলে আসব। হ্যামিল্টন চলে এলে কবে না কবে জব পাই। কোনো কোর্সে ভর্তি হলে স্টুডেন্ট অ্যালাউন্স যা পাব, তা দিয়েই চলতে হবে।

রাকিব মাথা ঝাঁকাল শুধু। কিছু বলল না।

ওরা হ্যামিল্টন সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনে এসে জানল, আজমল হোসেনকে সেদিনই অকল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি আপাতত দেড়-দুই সপ্তাহ অকল্যান্ড সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনের অস্থায়ী জেলে থাকবেন। তারপর তাকে অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে ডিপোর্ট করা হবে।

যদিও ওরা আজমল হোসেনকে কবে ডিপোর্ট করা হবে, এর সঠিক তারিখটা জানতে পারেনি। তবে পুলিশ স্টেশনের এক পুলিশ অফিসার বলেছেন, আগামী সপ্তাহেই নাকি ওরা জাহিদকে আজমল হোসেনের ডিপোর্ট করার তারিখটা জানিয়ে দেবে। আজ রাকিবও তার মোবাইল নম্বরটা সেই পুলিশ অফিসারকে দিয়ে এসেছে।

ওরা আবার বাসায় ফিরে এল। বিষণ্নভাবে দুজনই লাউঞ্জে কতক্ষণ বসে রইল। এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। বাইরে থেকে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক আসছে। এখনো দু-একটা পাখি ডাকছে। ঠিক রাত পাখি নয়। আবার সন্ধ্যার কোনো পাখির ডাক বলেও বোঝা যাচ্ছে না। রাকিব ঘড়ি দেখল। প্রায় পৌনে আটটা বাজে।

রাকিব ঘড়ি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাহিদের দিকে তাকাল। তার হঠাৎ মনে হলো, সে জাহিদকে রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়ে কীভাবে? ফ্রিজে মুরগির মাংস ও ডাল আছে। ওগুলো মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিলেই হবে। আর সঙ্গে দুটো ডিম ভাজি।

কিন্তু রাকিবের এখন কিচেনে যেতে ইচ্ছে হলো না। এমনিতে আজ অফিসে বেশ ব্যস্ততা গেছে। তারপর বাসা ফিরে হ্যামিল্টন সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনে যাওয়া। ওখান থেকে আজমল হোসেনের মন খারাপ করা সংবাদটা শুনে আসা। এখন বাসায় ফিরে এক ধরনের স্তব্ধতা। রাকিব ভাবল, জাহিদকে বরং রেস্টুরেন্টে খাইয়ে দিলেই ভালো হয়। কাছেই তো গ্রে স্ট্রিটে কারি পট।

রাকিব বলল, তুমি আজ থেকে গেলে পারতে।

জাহিদ বলল, আমারও কী ইচ্ছে করছে না? আজ তোমার এখানে থেকে গিয়ে সারা রাত চুটিয়ে আলাপ করতে পারতাম।

রাকিব হেসে বলল, সারা রাত হয়তো চুটিয়ে আলাপ করতে পারতাম না। আমার কাল সকালে অফিস আছে। তারপরও তুমি থেকে গেলে ভালো লাগত। ব্যালকনিতে বসে বেশ রাত অব্ধি গল্প করতে পারতাম।

: আমারও তো কাজ বন্ধু। খুব ভোরে উঠতে হবে। নতুন অরচার্ডের কাজ। কোথায় কাজ হবে এখনো জানি না। হেদায়েত ভাই হয়তো আজ রাতেই জানাবেন। নয়তো কাল ভোরে বলবেন।

: তুমি ভোরে উঠে চলে যেতে? হ্যামিল্টন থেকে তাওরাঙ্গা এক ঘণ্টা দশ মিনিটের পথ মাত্র।

: তা জানি। কিন্তু বাসায় গিয়ে কাজের কাপড়চোপড় পরে অরচার্ডে যেতে দেরি হয়ে যাবে।

: আচ্ছা, তাহলে এখন বাইরে চল।

: বাইরে কোথায়?

: একটা রেস্টুরেন্টে খাব।

: রেস্টুরেন্টে কেন? বাসায় যা আছে তা দিয়েই হবে। তুমি তখন বললে ফ্রিজে রান্না করা আছে?

: তা আছে। কিন্তু আজ তোমাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাব।

জাহিদ এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। একবার জানালা গলে বাইরে তাকাল। বাইরে তাকানোর মতো কিছু নেই। লাউঞ্জের আলো ভেদ করে বাইরে এক দলা অন্ধকার বাদে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে দৃষ্টিটা আবার ভেতরে টেনে আনল। রাকিবের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, আমি কী রেস্টুরেন্টে খাওয়ার মতো এমন কোনো বিশেষ অতিথি?

রাকিব হেসে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, বিশেষ অতিথি না কেন?

: দেখ রাকিব, তুমি-আমি একই কলেজের। বলতে পার, আমরা ক্লাসমেট। আমি সায়েন্সের আর তুমি আর্টসের হলেও তোমার-আমার বাংলা ও ইংরেজি বিষয় তো এক ছিল। সেই অর্থে তুমি-আমি ক্লাসমেট। তুমি এত ফরমাল হলে আমি কিন্তু তোমার বাসায় আসব না।

: আহা জাহিদ, আমি ফরমাল হলাম কোথায়?

: তুমি রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর কথা বলছ কেন?

রাকিব আবার হাসল। বলল, যে রেস্টুরেন্টে আমরা খেতে যাব, সেটা আমার ঘরের মতো। অসংখ্যবার নদী আর আমি ওখানে খেয়েছি। নদীর সঙ্গে পরিচয়ের আগেও আমি ওই রেস্টুরেন্টে অনেকবার খেয়েছি। ওখানে গেলে আমাকে আর খাবারের অর্ডার দিতে হয় না। রেস্টুরেন্টের মালিক বা ম্যানেজার নিজ থেকেই খাবার পাঠিয়ে দেন। বিশ্বাস না হলে তুমি আমার সঙ্গে পরখ করে দেখতে পার। আর এ ছাড়া...।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, এ ছাড়া কী?

রাকিব বলল, আসলে আমার এখন কিচেনে গিয়ে খাবার গরম করতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রিজে শুধু মুরগির মাংস আর ডাল আছে। আমাকে আবার ডিম ভাজি করতে হবে। এখন আমার ডিম ভাজি করতেও ইচ্ছে করছে না।

জাহিদ এবার শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ঠিক আছে। বুদ্ধিটা খারাপ না। হ্যামিল্টন আসার আগ পর্যন্ত তাওরাঙ্গাতেও দেখি এমন একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে পাই কিনা। স্যারের এই ঘটনার পর আমারও কেন জানি আজকাল রান্নাবান্না করতে ইচ্ছে করে না। আগে স্যার ও আমি একসঙ্গে রান্নাবান্না করতাম। এখন বাসায় গেলেই কেমন খালি খালি লাগে!

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, একা থাকলেই রান্নাবান্নার এই অলসতা পেয়ে বসে।

: তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা, তুমি কি নদীকে নিয়ে সব সময়ই ওই রেস্টুরেন্টে যাও?

: হ্যাঁ। নদীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর গত এক বছর একা কখনো সেই রেস্টুরেন্টে যাইনি।

: রেস্টুরেন্টের নাম কী?

: কারি পট সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট।

: ও, সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট? সাউথ ইন্ডিয়ান ফুড আমারও খুব পছন্দের। হেস্টিংসে থাকতে লিডিয়া ও পিটারের সঙ্গে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে দুই-তিনবার গিয়েছি। রেস্টুরেন্টটার নাম বানানা লিফস।

: লিডিয়া–পিটার কে?

: লিডিয়া আমার কাগজের বউ ছিল। যার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে আমার নিউজিল্যান্ডের রেসিডেন্সি হয়েছে। আর পিটার হলো লিডিয়ার বয়ফ্রেন্ড।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও।

জাহিদ হঠাৎ কী ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বলল, রাকিব, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

: কী আইডিয়া?

: তুমি নদীকে ফোন কর। চল আমরা নদীকে নিয়ে একসঙ্গে ডিনার করি। তোমার ভালো লাগবে।

রাকিব মৃদু হেসে বলল, সে কী করে হয়? এখান রাত আটটার ওপরে বাজে। নদী একজনের বাসায় বোর্ডার থাকে। এখন বললেই কী আসতে পারবে? রাত হয়েছে না?

জাহিদ বলল, তুমি না আমাকে বললে, তাকে নিয়ে সেই রেস্টুরেন্টে তুমি অসংখ্যবার ডিনার করেছ?

: সেটা অন্যভাবে। নদী বিকেলে বা দুপুরে চলে আসত। আমি ডিনার করার পর নামিয়ে দিয়ে আসতাম।

; তুমি নদীকে রিং করে দেখ না, আসতেও তো পারে। তবে এক শর্ত, নদী আসলে কিন্তু ডিনারের বিল আমি দেব।

: তুমি দেবে কেন?

: আমি দেব এ জন্য, আমি তোমাদেরকে এক বেলা খাওয়াতে চাই।

: সেটা তুমি তাওরাঙ্গা গেলে কর। হ্যামিল্টনে না। নদীর তাওরাঙ্গা ঘুরে আসার খুব ইচ্ছে। তুমি হ্যামিল্টন আসার আগেই নদী আর আমি একবার তাওরাঙ্গা ঘুরে আসব। তবে তুমি যেহেতু বলছ, আমি নদীকে এখনই রিং করছি।

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও হো! আমি বলছি বলে নয়, আমি বলার পর তোমারও মন চাচ্ছে, ওটা বলো। হা হা হা...!

রাকিবও হাসল। তার এবারের হাসিটা কিছুটা লাজুক হাসি। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সে মোবাইল হাতে নিয়ে নদীকে রিং করল। ওপাশে চারবার রিং বাজতেই নদী তার মোবাইল ধরল। মোবাইল ধরেই বলল, এই তো সুবোধ বালক। আমার কথা শোনে। এখন সুবোধ বালক রাতেও ফোন দেয়...! হি হি হি!

রাকিব ফোনের এপাশে মৃদু হাসল। জিজ্ঞেস করল, কী করছ?

নদী বলল, একটা অ্যাসাইনমেন্ট রিভিউ করছি। সুপারভাইজার দিয়েছেন। তা কবি সাহেব, কী মনে করে আপনি এখন ফোন দিলেন?

রাকিব বলল, তুমি কী একটু আসতে পারবে?

: কোথায়?

: হ্যামিল্টন ইস্টে।

: আপনার বাসায়?

: না, কারি পট রেস্টুরেন্টে।

: আপনি কি এখন কারি পট রেস্টুরেন্টে?

: না, বাসায়।

: তাহলে কারি পট রেস্টুরেন্টে আসতে বলছেন কেন?

: খাব বলে। ডিনার করব।

: তা বুঝলাম। কিন্তু এখন হঠাৎ করে?

: হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো।

: দেখুন, আপনি এত ইমোশনাল মানুষ নন যে এভাবে হঠাৎ করে রেস্টুরেন্টে ডাকবেন।

: আচ্ছা, আমি এত এত কবিতা লিখছি। তারপরও কীভাবে তুমি বলো যে আমি ইমোশনাল নই?

: আমি কোনো ভুল বলছি না। এক বছরের ওপরে আমি আপনাকে চিনি। এখন বলুন, কী কারণে রেস্টুরেন্টে ডাকছেন?

: জাহিদ তাওরাঙ্গা থেকে এসেছে। বিকেলেই এসেছিল। তাকে নিয়ে আজমল স্যারকে দেখতে গিয়েছিলাম। এখন সে তাওরাঙ্গা চলে যাবে। তাই ভাবছি, তাকে রেস্টুরেন্টে ডিনার করিয়ে দিই। তোমাকে ডিনারে আসার জন্য রিং করার আইডিয়াটা জাহিদই দিয়েছে।

জাহিদ পাশ থেকে হাত নেড়ে বলল, আহা, আমার কথা বলতে গেলে কেন?

রাকিব জাহিদের কথায় কিছু বলল না।

নদী ফোনের ওপাশ থেকে বলল, তা বেশ। আচ্ছা, আজমল স্যারের খবর কী?

রাকিব বলল, আমরা আজমল স্যারের সাক্ষাৎ পাইনি। স্যারকে অকল্যান্ড সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুব সম্ভব আগামী দেড়-দুই সপ্তাহের মধ্যে স্যারকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। এ জন্যই স্যারকে অকল্যান্ডের সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনের টেম্পোরারি প্রিজনে শিফট করা হয়েছে।

নদী বলল, আহা! বলেই সে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর কী ভেবে বলল, কিন্তু রাকিব ভাই, আমি একটা কথা বলি। আমি খুব সরি। আমি এখন আসতে পারব না। অ্যাসাইনমেন্টটা রিভিউ করে আগামীকালই সুপারভাইজারকে দিতে হবে। জাহিদ ভাইকে সরি বলবেন।

রাকিব বলল, অসুবিধা নেই। তুমি তোমার কাজটা কর। ওটাই ইম্পর্ট্যান্ট বেশি। আচ্ছা, রাখি।

নদী বলল, জি, আচ্ছা।

রাকিব লাইন কেটে দিয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, নদীর একটা অ্যাসাইনমেন্টের রিভিউ আছে। তার সুপারভাইজার দিয়েছেন। সে এখন ওটা নিয়ে ব্যস্ত। কাল জমা দিতে হবে। তাই আসতে পারবে না। নদী তোমাকে সরি বলেছে।

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হেসে বলল, অসুবিধা নেই। তাহলে বন্ধু, তাড়াতাড়ি রেস্টুরেন্টে চল। খেয়ে আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। বেশি রাত হয়ে গেলে ভোরে উঠতে আমার কষ্ট হবে। এমনিতেই কিউই ফ্রুটের উইন্টার প্রুনিং যা কষ্টের কাজ!

রাকিব সায় দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কিন্তু ওরা কারি পট রেস্টুরেন্টে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে খাবারের অর্ডার দিতেই দশ মিনিটের মাথায় নদী এসে হাজির। নদী একটা দিঘল হাসি দিয়ে রাকিবের পাশের চেয়ারটা টেনে বসতেই রাকিব মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, নদী, তুমি আসলেই একটা পাগল...!

নদী খিল খিল করে হেসে উঠল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>


ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন