তবু তরী বাইতে হবে

রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে বিজয়ের ব্যাজ পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে বিজয়ের ব্যাজ পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে

‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে

আমরা কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছিরে॥’

ওরা গান গায়। মনের কথা কয়। ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটে ওদের প্রকাশে। ওরা নতুন। ওদের আছে অগাধ শক্তি। ওরা হাল ছাড়ে না।

কিশোরী ওরা। কণ্ঠে ওদের একাত্তরের গান। মুক্তিযুদ্ধের এ গান প্রেরণা জোগায়। আসমা আমরিন। সাংস্কৃতিক এ পর্বের সঞ্চালক। বলল, গান গেয়ে আমাদের অপার আনন্দ। যেহেতু এটা নতুন নয়, সে কারণে এ অনুভূতি একেকবার একেক রকম। মুসসারাত ও তাজমিয়া পাশে দাঁড়িয়ে। ওদের প্রথমজন বলে, গানে বরাবরই প্রাণবন্ত হয়ে উঠি। অন্যজনের মুখে মিষ্টি হাসি।

মঞ্চে আবৃত্তি
মঞ্চে আবৃত্তি

বিজয় দিবসের কথা বলছি। বাংলাদেশ স্কুল। ১৬ ডিসেম্বর। যথারীতি অডিটোরিয়াম ছিল আনন্দমুখর। অভিভাবক শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমন্বয়ে দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বুকে বিজয়ের ব্যাজ। সবাই 'জয় বাংলা, বাংলার জয়' এর শান্তি অনুভব করে দেহ ও মনে।

আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। স্বাগত বক্তব্য দেন স্কুল-অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান।

বাংলাদেশ আজ ৪৮ বছরে পদার্পণ করেছে। এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অবসান ঘটে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

পুরস্কারের ডালি
পুরস্কারের ডালি

প্রধান অতিথি রাষ্ট্রদূত ইমরান বলেন, বিজয় এমনিতে আসেনি। ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। আসলেই কেড়ে আনা এ বিজয়। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। বাঁকা করে নিতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। একপর্যায়ে এই দেশের মানুষ তারই আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবন কাটে যুদ্ধ করে। বিজয়ের মধ্য দিয়ে তারা আদায় করে একটি দেশ, একটি পতাকা।

রাষ্ট্রদূত বলেন, দূতাবাসের মাধ্যমে দেশ থেকে বাংলায় প্রকাশিত বইপুস্তক আনা হয়। সাবলীল ভাষায় সেখানে জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে লেখা আছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এসব মনোযোগ সহকারে পড়বে। তিনি উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা তুলে ধরেন। বিদেশি সাহায্য ছাড়া বড় বড় প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ আমাদের গর্ব। বুক ফুলিয়ে দেশটার এই কৃতিত্ব অন্যের সামনে তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

রাষ্ট্রদূত ইমরান স্কুল পরিচালনায় অংশগ্রহণমূলক কমিটি গঠন করা হচ্ছে বলে একটি বার্তা দেন। তিনি এর মাধ্যমে স্কুলে সর্বোচ্চ অবদান রাখার অনুরোধ জানান।

বঙ্গবন্ধু একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে তিনি এ যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। এরপর নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ আজ এই পর্যায়ে।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। পেয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি। নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত পদ্মাসেতু এখন দৃশ্যমান। বাস্তবায়িত হচ্ছে মেট্রোরেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ অভিজাত স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য। প্রবৃদ্ধি অর্জন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এ কারণে আজকের বিজয় দিবস আরও বেশি মহিমাময়। এ কথা যেমন প্রধান অতিথি বলেছেন তেমনি সবার আলোচনার মধ্যেও সমান গুরুত্ব নিয়ে উচ্চারিত।

আয়োজনে বিশেষ অতিথি ছিলেন দূতাবাসের মিনিস্টার ও হেড অব চ্যান্সারি শহীদুজ্জামান ফারুকী। আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আবু তাহের।

জীবন কাটে যুদ্ধ করে/ প্রাণের মায়া সাঙ্গ করে/ জীবনের স্বাদ নাহি পাই।

কী এক দেশপ্রেম তাদের বুকের গভীরে! তারা যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

ঘরবাড়ির ঠিকানা নাই/ দিনরাত্রি জানা নাই/ চলার ঠিকানা সঠিক নাই।
জানি শুধু চলতে হবে/ এ তরী বাইতে হবে।

কারণ তারই জবানে...আমি যে সাগর মাঝিরে।...

বড়রা এসেছেন আজকের বিজয় দিবসের কর্মসূচিতে। এসেছে ছোটরা। সাদিয়া আর আরিফা। পরীক্ষার ফল ওদের হাতে আজ। ওরা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠল। দুই বিজয়ের হাসি ওদের মুখে।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন

বিজয় দিবসে নতুন সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে ভালোবাসা নিয়ে ছুটছে সবাই। এ ভালোবাসা স্বাধীনতা সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের উদ্দেশ্যে। শ্রদ্ধা বঙ্গবন্ধু—শ্রদ্ধা জাতীয় বীরদের প্রতি।

একাদশ শ্রেণির জান্নাত লিখিত বক্তব্য রাখে অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গুরুত্ব পায় সে লেখায়।

বাংলার সন্তানদের শৌর্যবীর্যের নাম আছে। মুক্তিযুদ্ধ এর প্রমাণ। সে কারণে তামাম দুনিয়া আজ বিস্মিত। কবি সুকান্ত লিখে গেছেন ঠিক কথাটি। শাবাশ বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।

ফারলুনা হক। মা তাঁর শয্যাশায়ী। স্কয়ার হসপিটালে ডায়ালাইসিস চলছে।

বরাবরের মতো তিনি ছোটদের মাঝে সংগঠকের ভূমিকা রাখছেন। ফাঁকে কথা হয়। সমবেদনা জানাই।

মিসেস অনিতা ও মিসেস কিরণের সঙ্গে দেখা হলো। তারাও ব্যস্ত ছোটদের নিয়ে।

বিশেষ অতিথি নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা আনার বিষয়টি সামনে আনেন। বলেন, বাংলাদেশের সৃষ্টিকে জানাও এক মহান দায়িত্ব।

তরুণী মা এক। শাহনাজ বেগম। আবদুল্লাহ ইবনে মাহফুজ তাঁর পুত্র। এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠল। ভালো রেজাল্টের আনন্দ মা ছেলের। উজ্জ্বল মুখে সেটি স্পষ্ট। কথা হয়। আমি বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাই।

নাফিসুর রহমান মাহী। সেও একই শ্রেণির শিক্ষার্থী। রচনা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে। অভিনন্দন জানাই।

স্কুলের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র
স্কুলের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র

বিবি শাহিনুর এই স্কুলের সাবেক ছাত্রী। স্নাতকোত্তর শেষে চাকরি নিয়েছেন। তিনি আহালিয়া মানি এক্সচেঞ্জ ব্যুরোর রিলেশনস ম্যানেজার। এক ডালা পুরস্কার এনেছেন ছাত্রদের জন্য। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানালেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিজয়ের মাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাঙালিরা আরও আরও রেমিট্যান্স পাঠাবে দেশকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে।

বাখিতা, সামিরা ও নাদিয়া—ওরা তিনজনই চতুর্থ শ্রেণির। বলল, অনেক ভালো লাগছে। হাঁটছে না, দৌড়াচ্ছে ওরা একই সঙ্গে!

বাইরে দেখা এক দল তরুণের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। ওরা এখানকার সাবেক ছাত্র। কেমন লাগল, জানতে চাইলাম। অনেক অনেক...সমস্বরে বলল...ভালো লাগল...বাংলাদেশকেই পেলাম। ছবির জন্য দাঁড়াল। ক্যামেরার ক্লিকে চারপাশ হেসে উঠল।

কথা হচ্ছিল অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসানের সঙ্গে।

জীবনের রঙে মন টানে না/ ফুলের ওই গন্ধ কেমন জানি না/ জ্যোৎস্না দৃশ্য চোখে পড়ে না/ তারাও তো ভুলে কভু ডানে না।

মঞ্চে গান চলছিল। আমরা শ্রোতা।

গানের প্রক্ষেপণ কী আবেদনই না তুলছিল! বাঁ পাশে সৌম্যজিৎ, দেখাচ্ছিলেন আমাকে।

ওদের দলে আরেক জন আবরার!

হঠাৎই জ্বলে ওঠে। প্রতিবেশ উঠে আসে। বৈশাখের রুদ্র ঝড়ে আকাশ ভেঙে পড়ে যেন। ছেঁড়া পাল আরও ছিঁড়ে যায়। দেখাই আমি, সুনির্দিষ্ট করে বলেন অধ্যক্ষও। কী তেজই না ফুটে ওঠে!

হাতছানি দেয় বিদ্যুৎ আমায়/ হঠাৎ কে যে শঙ্খ শোনায়।/ দেখি ওই ভোরের পাখি গায়।

দৃপ্ত শপথ মুক্তিসেনার। কঠোর ওদের কণ্ঠ।

তবু তরী বাইতে হবে/ খেয়া পারে নিতে হবে/ যতই ঝড় উঠুক সাগরে।

এই অঙ্গীকার ছিল সবার মনের মধ্যে। নির্বাচন নিয়ে কথা হয়। সেখানেও প্রত্যয়ের ঘোষণা। সবক্ষেত্রেই থাকবে এমন দৃঢ়তা। এই বিশ্বাস পরিলক্ষিত মঞ্চে, এমনকি শ্রোতার চেহারায়ও।