আলোহীন আলোতে দেখেছি পৃথিবী

চার বোন ও তাদের একমাত্র ভাই। হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে
চার বোন ও তাদের একমাত্র ভাই। হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে

আমার বন্ধু সালিমা যেদিন সিটি কলেজের বারান্দায় আমাকে আলতো ছুঁয়ে বলল, ‘আচ্ছা রিমু বলত, আমি দেখতে কেমন?’ আমি কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়েছিলাম। সালিমা কোনো দিন নিজেকে দেখেনি। সালিমা কখনো স্নেহময়ী মাকে দেখেনি। সালিমা কখনো প্রিয় বাবাকে দেখেনি। চিরজীবন ধরে কাছে থাকা পাশবালিশের ভাইবোনদেরও দেখেনি। এটাই সত্য। সেদিনই মনে হলোআমার, কিছু সত্য অসুন্দর। সত্য এমন অসুন্দরও হয় তা আজকে আমার স্বীকার না করে কী উপায়?

আমার বন্ধু তাসলিমা। সিটি কলেজের একই বারান্দায় আমার বন্ধু তাসলিমার জামার সঙ্গে ম্যাচিং কানফুল দোলে। জুতার ফিতাও দেখি সেই রঙের কথা বলে। এবার আমি বিমূঢ় নই, মুগ্ধ হয়ে বলি, কেমন করে পারিস রে তোরা! কেমন করে পৃথিবী বলে আলোহীন, চোখে দেখিস না তোরা?

সালিমা আর তাসলিমা ওরা দুই বোন। আমার আর রিপার বন্ধু। আমরা কলেজজীবন পার করেছি হাতের আদরে হাত রেখে। আমরা একটা জীবন দেখেছি আলোহীন এক তুমুল আলোতে।

এমন আলোহীন এক ভিন্ন আলোতে কাটছিল আমাদের কলেজের দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন ভুল করে একটা চুলও ভুল না করা সালিমা কলেজের ইনফরমেশন গ্যাপের ভুলে জানতে পারল, কী একটা ফরম যেন লাগবে। আজই লাগবে। এখনই। আমাদের জানা ছিল না আগে। ফরমটা আছে ওদের বাসাতে। কী যে করি। চোখে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি।

সালিমা আমাকে আলতো ছুঁয়ে বলল, এখনই রওনা করা যায় কি? সালিমা ভাববাচ্যে কথা বলে সব সময়। সিদ্ধান্তটা নেবার ক্ষমতা দিয়ে দেয় সামনের জনকে। এত মিষ্টি ওর এই বিষয়টা!

ইন্টারমিডিয়েটের কলিজা আমার। কীই–বা আর সাহস! আমার চোখে ভয়। সালিমা ঠিক ঠিক বলে দিল, ভয় পাচ্ছিস রিমুইন্না! আমাকে তুই চিনিস না? পারব আমি তোকে পথ চিনিয়ে আমাদের বাসায় নিতে? আমি লজ্জা পেলাম। সালিমার আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাসের বাতাস আমার একটু তো ছিল জানা। সংকোচ কেটে বললাম, পারবি না আবার! প্রতিদিন তুই আসিস কলেজে তবে কেমন করে! এখনই চল।

আমি শুধু একটা দিনের বর্ণনা দিচ্ছি। একটা দিন! আমার বন্ধু সালিমা–তাসলিমার বাকি ৩৬৪ দিন আপনারা অনুমান করে নেবেন। সেই সেদিন।

চলতে চলতে আমি পৃথিবীর মধ্যেই অন্য এক পৃথিবীতে ঢুকে পড়ি। সালিমাদের বাসায় রওনা করি। আমাদের ক্লাস ছিল পাঁচতলাতে। পাঁচ তলা থেকে নামার প্রতিটা সিঁড়ি যেন একটা বছর। কখনো চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি পার হয়েছেন কেউ? হলে শুধু সেই মানুষটাই জানবেন কতটা কষ্ট আর ঝুঁকি এতে। এক সিঁড়ি থেকে একটু পা পিছলে গেলেই শেষ।

কিন্তু তা কী হয় নাকি! শেষ বলতে কোনো শব্দ অভিধানে নেই যার, সেই সাহসের হাত ধরেছি। চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ের রাস্তাটার কথায় বলছি। পৃথিবীতে পুলসিরাত পার হওয়া বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে এটাই সেটা। চৌরাস্তার ভেতরে আট রাস্তা। যানবাহনগুলো যেন এক একটা জানোয়ার। একটু অমনোযোগী হলেই আসল পুলসিরাতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে তাতে। তবুও আমাদেরতো রাস্তা পার হতেই হবে।

সালিমার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছি। অনভ্যস্ত হলেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে ওর পায়ের স্টেপগুলো ঠিক আছে কিনা। রাস্তায় এত গর্ত। গর্তে পড়ছে কিনা। আচমকা ব্যথা পেয়ে যাবে কিনা। হঠাৎ দেখি, দৈত্যের মতো একটা ট্রাক আমাদের মুখোমুখি। থরথর করে কাঁপতে থাকা আমি আজও জানি না, ঠিক কত ন্যানো সেকেন্ডের জন্য বেঁচে গেলাম আমরা। আমরা চলতে থাকি।

থেমে গেলে হবে না। আমার যে হাতে ধরা অদম্যর সঙ্গে বন্ধুত্ব। আমরা চলতে চলতে বাস স্টেশনে আসি। ওই মুহূর্তে দ্রুত যাওয়ার জন্য আলাদা ট্যাক্সি নেবার টাকা আমাদের হাতে ছিল না। আসা–যাওয়ার হিসেবের বাইরে কলেজজীবনে কত টাকাই বা আর পকেটে থাকে? আমরা বাসের জন্য দাঁড়াই। রুটটা সালিমা জানে। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। একজন যায়, দুজন যায়, কেউ তাকায় না। আমাদের চার চোখ, তার মধ্যে দুই চোখে আলো নেই। বুঝতে পারলেই চলে যাচ্ছে বাসচালকেরা। ভ্রুকুটি করছে হেলপাররা। আমরা অসহায় হয়ে বাস চালকের অমানবিকতা দেখি। হেলপারদের ভ্রুকুটি দেখি। গাড়িতে অন্ধ মানুষ নেবে না তারা। কে নেয় এসব ইচ্ছাকৃত ঝামেলা!

চলতে চলতে আমি দেখি, আমরা দেখি। কিছু মানবিক মানুষও আছে অমানবিক এই সব মানুষের ভিড়ে। তাদের একজন সালিমাকে একটু চেনে। এই রুটেই আসা যাওয়া করে। সে হেলপার। আমাদের বাসে উঠতে হেল্প করে ছোট্ট ছেলেটা। যত্ন করে বসিয়ে দেয় বাসের সব থেকে সামনের নিরাপদ সিটটাতে। আমরা আরামে বসে বাসের জানালা খুলে দিই। মিষ্টি একটা বাতাস এসে আমাদের এতক্ষণের সব কষ্ট উড়িয়ে নিয়ে যায়। বাস চলতে থাকে সাঁই সাঁই। আমরা গল্প করতে থাকি। সালিমাদের বাসা পাহাড়ের গভীরে। অনেকটা দূরে। আমাদের গল্পের সময় তাই বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে গল্প চলে যায় আরও গভীরে।

সালিমা আলতো ছুঁয়ে বলে, জানিস রিমু আমাদের ছোটবোনটা নাকি খুব সুন্দর। ও যে সুন্দর, জানে না সে তা। না জানাই ভালো হয়তো। প্রতিদিন কত মানুষের সাহায্য নিতে হয় আমাদের! জানলে যদি সাহায্য নিতে সংকোচ হয়। তুই দেখলে বলতে পারবি হয়তো। আমি বিস্মিত হয়ে বলি, সে জানে না তা? সালিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, হয়তো জানে, হয়তো জানে না। আমি আকাশ থেকে পড়ে বলি; মানে কী? সালিমা ঝরঝর করে কেঁদে বলে, সেও দৃষ্টিহীন যে। আমার ছোট বোনটার নাম জানিস? পাখির নামে নাম। মুনিয়া। আমাদের গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলতে থাকে। কত দূর! বাসের ভেতরে এত কোলাহলের মধ্যেও আমি স্তব্ধ গ্রামে যেন। একটা ডানা ভাঙা পাখি আকাশ খুঁজছে যেন।

আমাদের স্তব্ধতা ভাঙে হেলপারের ডাকে। ‘দুই আফা দুই আফা নামেন নামেন। সবার আগে। ভেতর থেইক্যা মানুষ ঠেলা দিলে পরে পারবেন না আর।’ তারপর মানুষের ভেতরের সেই সত্যিকারের মানুষটা আমাদের নিরাপদ একটা রাস্তার ধারে নামিয়ে দেয়। কিন্তু কোথায় যাব সালিমা আমরা? আর কত দূর? সালিমা আমার হাতটা আলতো নয় এবার শক্ত করে ধরে বলে, এই পাগল আমি আছি। দেখত, এখানে একটা ওষুধের দোকান আছে কিনা? থাকলে সেই পথই আমাদের বাড়ির পথ। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলি, আছে সালিমা!

তারপর আমরা হেঁটে যেতে যেতে পার হই ফলের দোকান। একটা মাত্র দিনের বর্ণনা দিচ্ছি আমি। একটা দিন! আমরা পার হই ডাস্টবিন, পার হই ম্যানহল। একটু অসাবধান হলেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা যাতে শতভাগ। আমি হতবাক হয়ে বলি, কেমন করে যাও সালিমা প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে। এত দূরের পথ পেরিয়ে কেমন করে যাও কলেজে? সালিমা হাসে। আত্মবিশ্বাসের পাহাড় ভেসে উঠছে তাতে। কিন্তু একি হঠাৎ উঁচু পাহাড় কাটা রাস্তা পড়ল সামনে। সালিমা বলল, রিমু একটা পাহাড়ের মতো রাস্তা দেখছিস কি? হুঁ, বলতেই সে বলল, এই পাহাড়ের মতো রাস্তার ওপাশেই আমাদের বাড়ি।

পাহাড়ের ওপাশ আমাদের দরজা খুলে দেয়। পাহাড়ের ওপাশে ওদের বাড়ি। প্রতিদিন পাহাড়ের মতো বাধা জয় করে বলেই কী! সালিমা রুমে ঢোকে। আমি আলতো চোখ বোলাই বসার ঘরটিতে। হারমোনিয়াম টেবিলে। কেউ নিশ্চয়ই গান করেছে সকালে। সোফার কভারগুলো কুসুম কুসুম সৌন্দর্যে গোছগাছ করে বসে আছে। কে গুছিয়েছে কে জানে! হঠাৎ ঝুপ করে শোকেসের আয়নার কাচ নড়ে ওঠে। কারও একজনের হাত পড়েছে ওতে। আমি মনোযোগ ভিড়াই অন্যদিকে। আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তাড়া দিই সালিমাকে। সালিমা একটু হেসে বলে, আমাদের বাসা থেকে খালি মুখে যাওয়ার নিয়ম নেই। রান্না ঘরের দিক থেকে পেঁয়াজের ঝাঁঝ আসছে। আমি একটু রাগ হয়ে বলি; কী কাণ্ড! এসব কেন সালিমা? কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা। নাশতা এল টেবিলে। সাজানো টেবিলের গ্লাসগুলোও। কে রেখেছে এত সুন্দর করে সাজিয়ে এই সব, প্রশ্ন মনে। এদিকে সালিমা নাছোড়বান্দা। রিমু তোকে একটু কিছু খেয়েই যেতে হবে সতর্কবার্তা এল। আমি সামান্য একটু কেক হাতে নিয়ে বললাম, খাচ্ছি বাবা, চল। দেরি হলে কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে। অস্থিরতায় মুখেই দেওয়া হয়নি আসলে খাবারটা। সালিমা তার আলতো স্বরটা কঠিন শক্ত করে বলে; মিথ্যা বলবি না রিমু। তুই খাসনি কিছুই। আমার চোখে গ্লাসের পানিগুলো উঠে এল যেন। ছলছল চোখে বলি, দে। সব খাব। আসলেও খিদে আছে পেটে কিন্তু তাড়াহুড়া এত। ক্রিস্টালের বাটিতে সাজানো নুডলস। মুখ যাওয়ার আগে চোখ যায় ওতে। সবই আছে। শুধু আলতো হলুদ রংটা নেই ওতে। সোফার সাজানো কুশনগুলো তাকিয়ে আছে আমার দিকে, রংহীন পৃথিবী বলবার ঔদ্ধত্য আমার নেই যে।

সব ঘরের আসবাব সাজাল কে? সালিমা উত্তর করে। আপু সাজিয়েছে। কেমন হয়েছে রে? আপু হয়তো জানে না কেমন দেখতে হলো সব। মানে কী? কী বলছ আবার এই সব? সালিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপুও দৃষ্টিহীন রে। হাবিবা আপু নাম। সালিমারা চার বোন এক ভাই। ভাইটা দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হলেও চার বোনের কারও চোখেই পৃথিবীর রং নেই। আমার আর কীই–বা বলার থাকে? নিস্তরঙ্গ একটা মন খারাপ ঢেউ শিরশির করে শরীর বেয়ে নামে।

আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই আর। কলেজে যেতে হবে আবার। একই পথে, একইভাবে যাওয়ার যুদ্ধটা পুনরায় কল্পনা করা যায় কী? আপনাদের তাই করতে হবে যে।

আমি আর সালিমা আবার রওনা করি। জীবনের পথে। পথে যেতে যেতে সালিমার আলোহীন চোখে চেয়ে দেখি অন্য আলোর পৃথিবী। যে পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছিলাম আমি। যে পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছিল পরবর্তীতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। যে পৃথিবীতে হেরে যাওয়া বলে কোনো শব্দ নেই। নেই বলেই সালিমা, তাসলিমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করেছে। মাস্টার্স করেছে। হাবীবা আপু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল শেষ করেছে। আইন বিভাগ থেকে নিয়েছেন ডিগ্রি। মুনিয়া এখনো অধ্যয়নরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই। হাবীবা আপু ও তাসলিমা শিক্ষকতা করছেন বর্তমানে। তাদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দশ দিগন্তে। সালিমা নিচ্ছে বিসিএসের প্রস্তুতি। আর অন্যদিকে মুনিয়া পাখিতো আপুদের গানের পাখি! গান করে সে। শুভ সকাল টেলিভিশন প্রোগ্রামে দেখতে পাওয়া যায় তাকে।

আর কি লাগে আমার, আমাদের? কলেজজীবনটা এমন আলোর সান্নিধ্যে কেটেছে বলেই তো, আমি রূপকথার তারাদের গল্প শুনি না। তারারাও ঝরে যায়, কিংবা হারিয়ে যায়। আমার কাছে আমার বন্ধুগুলো তারা নয়, নক্ষত্র। প্রত্যেক তিথিতে চাঁদেরও অবস্থান করতে হয় একেকটি নক্ষত্রের কাছে! কলেজজীবনের প্রতিটা দিন আমি ও আমার টুইন বোন রিপা সালিমা-তাসলিমার সংস্পর্শে থেকে ওদের আলোহীন আলোয় দেখেছি ভিন্ন এক পৃথিবী। যে পৃথিবীর অভিধানে ‘হেরে যাওয়া’ নামে কোনো শব্দ নেই। আমাদের তুমুল আনন্দ এখানে, আজ আর কেবল আমরা নই, ইত্যাদির মাধ্যমে পৃথিবী দেখল তোদের পৃথিবী কত আলোময়। আমার চোখে সালিমা তাসলিমার আম্মু–আব্বু, আমাদের আন্টি আংকেলই সত্যিকারের রত্নগর্ভা মা–বাবা। আমি জানি না, জাতীয়ভাবে রত্নগর্ভা মা নির্বাচনের আয়োজক কে, আয়োজন করেন কারা। তাদের দৃষ্টি ছুঁয়ে যাক এই পরিবার। আমি উচ্ছ্বাসে ভাসব আবার!