ক্রিসমাস এলেই মনে পড়ে

সংগৃহীত ছবি
সংগৃহীত ছবি

তখন আমরা অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতাম। দুই বেডরুমের বাসা। দক্ষিণের বড় ব্যালকনিতে বসলে দখিনা বাতাস ছুঁয়ে যেত। ভোরের সূর্যের আলোটা এসে পড়ত ছোট ছোট টবে লাগানো ফুল গাছের শিশিরের ওপর। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ভর করত টবের গাছগুলোর ওপর। একদিন দেখি আমাদের (অপজিট) মুখোমুখি অ্যাপার্টমেন্টে ব্যালকনিতে বসে আছে চার কী পাঁচ বছরের একটি মেয়ে।

আমাকে ব্যালকনিতে দেখে বলল, হাই?

আমিও বললাম হাই। পুতুলের মতো সুন্দর বাচ্চা মেয়েটি। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?

বলল, জোয়ানা।

বাহ, সুন্দর নাম, আমি বললাম।

এবার জোয়ানা আমাকে প্রশ্ন করল, তোমার নাম কী? বললাম, তুমি আমাকে ফারজানা বলতে পার। এতে সমস্যা হলে ‘বেলি’ নামে ডাকতে পার। বেলি আমার নিক নেম (নিউজার্সিতে সবাই নাম ধরেই ডাকে। আন্টি বা ম্যাডাম বলে না)।

জোয়ানা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি তোমাকে ফারজানাই ডাকব।

ওকে।

তোমার কোনো বেবি নেই? জোয়ানা আমাকে প্রশ্ন করল। আমি আমার মেয়ে আফসানাকে ডাকলাম। বললাম, এই যে আমার বেবি। ওর নাম আফসানা। তুমি চাইলে ওর বন্ধু হতে পার।

জোয়ানা খুব খুশি হলো। আফসানা ওর থেকে কিছুটা ছোট হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মম কোথায়?

বলল, আমার মম সিক্রেট সান্তার কাছে আছে। পাপা বলেছে, আমি যখন বড় হব তখন মম আসবে আমার কাছে। আমি তো এখন ছোট তাই মম আসে না। তবে সান্তার কাছে আমার মম আমাকে অনেক গিফট দেয়।

বুঝতে পারলাম মেয়েটির মা নেই। তাই আর এ প্রসঙ্গে কথা বাড়ালাম না। খারাপ লাগছিল খুব। এত সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে। আহা কী দুর্ভাগা, মনে মনে বললাম।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সঙ্গে কে কে থাকে?

জোয়ানা বলল, ওর গ্র্যান্ডমাদার আর ওর পাপা।

আমি ফিরে এলাম রান্নাঘরে। মাথায় শুধু ঘুরছিল জোয়ানার কথা। মেয়েটির কত স্বপ্ন। একদিন সিক্রেট সান্তা তার মমকে নিয়ে আসবে। এই স্বপ্নটাই লালন করছে।

তখনো আমি চাকরি শুরু করিনি। কারণ আমার মেয়ে আফসানা। ওকে বেবি সিটারের কাছে রেখে বা ডে কেয়ারে রেখে চাকরি করার কথা কোনো দিনও ভাবিনি। তাই বাসায় সময়টা কাটত ওর সঙ্গে খেলা করে, টিভি দেখে। বিকেলবেলা বাসার সামনে আমি আর আফসানা দুজনেই খেলতাম ওয়েদার ভালো থাকলে। আমাদের দেখাদেখি অনেক বাচ্চারাও আসত। বেলা ডুবলেই সবাই চলে যেতাম বাসায়। চমৎকার একটা সময় কাটছিল। একদিন বিকেলে আমি আর আফসানা বাসার সামনে খেলছিলাম—ফ্রিজ বি। দেখি জোয়ানা ব্যালকনিতে বসে আছে। বললাম, খেলতে চাও? চলে আস।

জোয়ানা বলল, আমি তো আসতে পারব না।

কেন পারবে না? পাপা রাগ করবে? আমি বললাম।

দেখি জোয়ানা মাথা নিচু করে আছে। কিছু বলছে না। এমন সময় ওর গ্র্যান্ডমাদার এল ব্যালকনিতে।

পরিচয় হলো আমার সঙ্গে। বললাম, নিচে আসতে জোয়ানাকে নিয়ে।

জোয়ানার গ্র্যান্ডমাদার বলল, জোয়ানা হাঁটতে পারে না। চিকিৎসা চলছে। তারপর বললেন, আমি ওকে নিয়ে আসছি। ও সিঁড়িতে বসে তোমাদের খেলা দেখতে পারবে। উনি জোয়ানাকে নিয়ে নিচে এলেন। আমি একটা ধাক্কা খেলাম বলা যায়।

বাচ্চাটার মা নেই। হাঁটতে পারে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছুই বুঝতে দিলাম না।

আফসানা আমার সঙ্গে খেলা বন্ধ করে জোয়ানাকে ডাকছে ওর সঙ্গে খেলতে। ও তো বোঝে না যে জোয়ানা হাঁটতে পারে না। এ ব্যাপারে আমি কিছুই আর জিজ্ঞেস করলাম না। আমরা খেলা শুরু করলাম। আমি, আফসানা আর জোয়ানা। ফ্রিজ বি দূরে গেলে আমি বা আফসানা জোয়ানার কাছে এনে দিই। ও বসেই আছে। শুধু আমাদের কাছে থ্রো করে। এভাবে পুরো সময়টা কাটালাম। ও খুব খুশি। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, অনেকে যখন দেখে মেয়েটা হাঁটতে পারে না, এড়িয়ে যায়। আমি তার উল্টোটাই করলাম। আমার বরং মায়া হলো। বাচ্চাদের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে, সে যেমনই হোক না কেন। ফুলের মতো বাচ্চারা খিলখিল করে হাসছে, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে।

আর জোয়ানা পুতুলের মতো। নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে এমনিতেই।

একদিন ডেভিডের সঙ্গে পরিচয় হলো। জোয়ানার বাবা। বললেন হাল ছাড়েননি। ডাক্তার বলেছেন জোয়ানা হাঁটতে পারবে। কারণ সমস্যাটা জন্মগত না। তবে সম্ভাবনা কম। চেষ্টা করলে অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সমস্যা হলো ও বসে থাকে। এতে করে ওর আরও ক্ষতি হচ্ছে। সমস্যা হাড়ে। আমি শুনে যাই শুধু, ডেভিড নিজ থেকে যা বলে তাই। যেচে কিছুই জিজ্ঞেস করি না, যদি অভদ্র ভাবেন বা যদি ভাবেন আমার এত উৎসাহ কেন তাই। ডেভিডকে শুধু বললাম, প্রতিদিন যদি একটু একটু করে প্র্যাকটিস করে তবেই কি সম্ভাবনা আছে? ডেভিড বলল, হ্যাঁ।

তারপর থেকে আমি খেলার ছলে ওকে দাঁড়াতে বলতাম। এক পা, দুই পা হাঁটতে বলতাম। ও বলত, কষ্ট হয়। বললাম, চেষ্টা করলে তুমি আফসানার মতো দৌড়াতে পারবে।

সত্যি?

বললাম, অবশ্যই। তবে কষ্ট পেলেও তা করতে হবে।

আমি আফসানার পুতুলগুলো দিলাম, খেলনাগুলো দিলাম। আফসানাও ওর সঙ্গে খেলে। অবশ্য আমার মেয়ে সব বাচ্চাদের সঙ্গেই মেশে। জোয়ানা আমাদের পেয়ে ওর সময়টা সুন্দরভাবে কাটাতে লাগল।

অবাক ব্যাপার হচ্ছে ও চেষ্টা করছে দাঁড়াতে। আমাকে প্রায় জিজ্ঞেস করে কবে হাঁটতে পারবে।

এভাবে দিন যায়, মাস যায়। জোয়ানা চেষ্টা করেই যায়। চেষ্টা করতে করতে মেয়েটা একটা সময় দাঁড়াতে শিখল। কোনো কিছু ধরে সে দাঁড়াতে পারে। কী যে খুশি, কী আনন্দ। এরপর এক পা, দুই পা হাঁটতে পারে।

ওর সবচেয়ে বেশি ইচ্ছা ওর মমের সঙ্গে যখন দেখা হবে ও দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে, এটা ওর খুব ইচ্ছে।

মানুষের ইচ্ছা শক্তি মানুষকে কত দূর নিয়ে যায়। শুধু একটু সাহস, একটু ভালোবাসা পেলে বদলে যেতে পারে তার পৃথিবী। আমরা অনেক শিশুকে অবহেলা করি, অবজ্ঞা করি। অথচ ওরা বেশি কিছু চায় না। একটু ভালোবাসা পেলে, আদর পেলে খুশি। জোয়ানাকে আমি কিছুই দিইনি। শুধু একটু সঙ্গ দিয়েছি, সময় দিয়েছি। ঠিক তাও বলা যাবে না। খেলেছি এক সঙ্গে, এতটুকুই। হয়তো আমার মেয়ে আফসানাকে দেখে ওর ভেতরটা বদলে গেছে যে আমিও দৌড়াব, আমিও খেলব আফসানার মতো বা তার মাকে দেখার যে স্বপ্ন, মায়ের কাছে দৌড়ে যাবে এই চিন্তা শক্তি হয়তো ওকে বদলে দিয়েছে, তাই চেষ্টা করেছে।

এক ক্রিসমাসে জোয়ানা ঠিকই দেখলাম হাঁটল। সিক্রেট সান্তাকে বলেছে, ও এখন হাঁটতে পারে এটা যেন ওর মাকে বলে। আমি ডেভিডকে বললাম, সত্যিটা বল না কেন ওকে? বলল, বলে দেবে শিগগিরই।

ডেভিড বলল, আসলে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। স্ত্রীকে হারিয়ে, সন্তানের এ অবস্থা দেখে, একটা মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম। এখন সময় এসেছে বলার। আর আমার প্রতি ডেভিড ও জোয়ানার গ্র্যান্ডমাদার কী যে কৃতজ্ঞ। ওর সঙ্গে খেলেছি বলে। কোনো রকম অবজ্ঞার চোখে দেখিনি বলে।

একটা সময় ডেভিড অন্য স্টেটে চলে যায় চাকরির কারণে। তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল বেশ কিছুদিন। পরে শুনেছিলাম জোয়ানা পুরোপুরি হাঁটতে পারে, স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমার মেয়েও স্কুলে ভর্তি হয়। আমিও চাকরি শুরু করি। আমি ব্যস্ত হয়ে যাই।

পরে আমরা ম্যুভ করি। বাড়ি কিনে চলে আসি অন্য জায়গায়। এখন যোগাযোগ নেই। তবে জোয়ানাকে মনে থাকবে অনেক দিন। মানুষের চেষ্টা মানুষের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে দিতে পারে। আমি জানি, এই বাচ্চাটি একদিন দারুণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ এতটুকু বয়সে সে বুঝে গেছে যে চেষ্টা করলে পারবে। এই বোধ তার মনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এই বোধ শক্তিই তাকে অনেক দুর নিয়ে যাবে।

জোয়ানা ভালো থাকুক, ভালো থাকুক সকল বাচ্চারা এই কামনা করি। বাচ্চারা আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।

(২৫ ডিসেম্বর ২০১৮)