ঘোল-মাখনওয়ালা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমাদের ছোটবেলায় বাংলাদেশে অনেক রকম ব্যবসা অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসা ছিল। যার মাধ্যমে অনেক পরিবারের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হতো। আমি সময়কালটা একদম সুনির্দিষ্টভাবে না বলতে পারলেও হয়তো ১৯৭৫-৮৫, এই এক দশকের মধ্যে হবে, যত দূর আমার স্মৃতিতে ভাসে।

আমি তখন ছোট অথবা বুঝতে শিখছি, এমন একটা বয়স আমার। তখন আমাদের পাড়ায় একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘোল-মাখন বিক্রি করতেন ফেরি করে। তাঁর পরনে থাকত শুধুমাত্র সাদা রঙের (যা কিনা অতি পুরোনো হওয়ার জন্য ঘি রং ধারণ করেছে) একটা ধুতি হাঁটু পর্যন্ত। খালি পা। কখনো স্যান্ডো গেঞ্জি পরতেন। আবার কখনো খালি গায়ে থাকতেন। তবে শরীরে (বুক-পিঠে) পইতাটা ঠিকই থাকত। বড় একটা বাঁশের লাঠির দুই মাথায় দুটি বড় হাঁড়ি দড়ির শিকার মধ্যে ঝুলত। একটা হাঁড়িতে থাকত ঘোল আর অন্যটাতে থাকত পানির মধ্যে ভাসমান মাখনের ছোট ছোট দলা। ঘোলের হাঁড়ির ওপরে অ্যালুমিনিয়ামের থালার ওপরে থাকত দুটি ছোট কাচের গ্লাস। যেটা দিয়ে ঘোল মেপে বিক্রি করতেন।

প্রতিদিন সকালে আমাদের সদর দরজায় এসে হাঁক দিতেন, ‘ঘোল-মাখন, লাগবে ঘোল-মাখন’। অমনি মা বলতেন, পিরিচ নিয়ে যাও, চারটা মাখন কেনো। আমার ঘোলের দাম মনে নেই। তবে মাখনের দাম মনে আছে। কারণ, ঘোল খেতেন মা আর আব্বা। আর মাখন খেতাম আমি ও আমার ভাইয়া। একটা মাখনের দাম ছিল চার আনা। একটা মাখনের সাইজ হলো এক ইঞ্চি ব্যাসের একটা দলা। ঘোল-মাখনওয়ালা হাত দিয়ে তাঁর হাঁড়ির মধ্যে থেকে মাখন তুলে দিতেন আমার হাতে রাখা পিরিচের ওপর। এই চারটা মাখনের দলা একটা চায়ের কাপের পিরিচে করে ঘরে নিয়ে আসতাম। (হাইজিন বলে জিনিসটা তখন কেউ তেমন তোয়াক্কা করত না।)

ওই মাখন ঘরে এনে সঙ্গে সঙ্গে একটা গরম রুটির ওপরে প্রলেপ দিয়ে তার ওপরে চিনি ছিটিয়ে মা রুটিটা পেঁচিয়ে লম্বা রোল করে হাতে দিতেন খাওয়ার জন্য। আর অন্য আরেকটা মাখন পিরিচের ওপরে নিয়ে এক চামচ চিনি ছড়িয়ে চামচ দিয়ে শুধু শুধু চেটে চেটে খেতাম। এভাবে দুটি মাখন আমার আর দুটি মাখন আমার ভাইয়ার জন্য দেওয়া হতো। সেই মাখন খেয়েই বড় হয়েছি আমরা।

লেখিকা
লেখিকা

ঘোল-মাখনওয়ালা (নাম জানি না, আমরা এই নামেই তাঁকে চিনতাম) আবার ঘিও বিক্রি করতেন। মা ঘিয়ের বায়না দিতেন ওনার কাছে। বলতেন খাঁটি গাওয়া ঘি। আর আমাদের প্রতিদিনের খাবারে ঘি থাকত। দুপুরে একরকম ভর্তা বা সবজি ভাজি থাকত আর এক রকম মাছের তরকারি বা ঝোল। মা গরম ভাতের ওপর এক চামচ ঘি ঢেলে দিয়ে লবণ দিয়ে ভাতটা নরম করে মেখে দিতেন। এই ঘি-লবণ দিয়ে গরম ভাত অমৃতের মতো লাগত। আমার মা ডাল বাগার দিতেন ঘি দিয়ে। অতুলনীয় তার স্বাদ! আমার মা বলতেন, ‘ঘি-মাখন খেলে বুদ্ধিদীপ্ত হয়’। কথাটার সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে ঘি-মাখন আমাদের প্রতিদিনের খাবারের অবশ্য অংশ ছিল। এখন সুপার মার্কেটের কত-শত ব্র্যান্ডের মাখন দেখি, কিনি, খাই, কিন্তু সেই স্বাদ তো পাই না!

এখনো আমি মাঝে মাঝে গরম ভাত ঘি-লবণ দিয়ে খাই। আর আমার বাচ্চারাতো খুবই পছন্দ করে। দুই-তিন লোকমা ভাত ঘি-লবণ দিয়ে খেয়ে তারপর ওই ভাতের সঙ্গে ভাজি বা ভর্তা দিয়ে খেতাম। সেই স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে। ভুলতে পারি না। আর সেই একই কারণে ঘোল-মাখনওয়ালার চেহারাটাও মন থেকে মুছতে পারি না। এখনো এই মধ্য বয়সে এসব স্মৃতি থেকে থেকে মানসপটে ফিরে আসে।

তারপর একটা সময় আসে যখন বড় বড় মিষ্টির দোকান থেকে ঘি কিনে খাওয়া প্রেস্টিজের অংশ হয়ে গেল। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘি টিনের ডিব্বায় বিক্রি হওয়া শুরু হলো। হয়তো সে কারণেই একসময় ঘোল-মাখনওয়ালা হারিয়ে গেলেন আমাদের আশপাশে থেকে। বুঝতে পারিনি কখন হারিয়ে গেলেন। অথবা টেরও পাইনি, জীবনের চলমান সময়ে, যখন কৈশোর অথবা যৌবনে পড়াশোনা, চাকরি, সংসার, এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।

এখন মনে হয়, ভদ্রলোক হয়তো কয়েক দশক আগেই পরলোকগত হয়েছেন। কারণ, তখনই তিনি বৃদ্ধ ছিলেন। ৭০–এর কোটায় বয়স ছিল। এখন মনে হয়, তিনি কীভাবে মারা গেলেন? ওনার পরিবার কীভাবে চলত, যখন উনি এই ঘোল-মাখন আর বিক্রি করতে পারতেন না? ওনার পরে তো আর কাউকে ঘোল-মাখন বেচতে দেখিনি আমাদের পাড়ায়।

ওনার হাতে তৈরি ঘি-মাখন খেয়ে বড় হয়েছি। পড়াশোনা করে উন্নত দেশে থাকছি। খুব জানতে ইচ্ছা করে ওনার পরিবারের সদস্যদের কী পরিণতি হয়েছে? কী করেন তারা এখন? কোথায় তারা? কেমন আছেন? তারা কি আমারই মতো ভালো আছেন?