আবুধাবিতে বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের ছবি

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করছেন মোহাম্মদ ইমরান
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করছেন মোহাম্মদ ইমরান

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’ বাজতে থাকে।

প্রত্যন্ত গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান। তাঁরই পাঠশালা গিমাডাঙ্গা স্কুল। সীতানাথ একাডেমি। একেক করে ভেসে ওঠে।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। ‘...আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।...’ বজ্রকণ্ঠ। আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সেখানকারই ছবি এটি।

১৬ ডিসেম্বর রোববার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের বিজয় দিবস উদ্‌যাপন। সকালে পতাকা উত্তোলন শেষে ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। তারপর দূতাবাসের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা পর্ব।

দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান এ আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্যে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানলে বাংলাদেশ জানা হয়ে যায়। তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রূপকার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানান ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের প্রতি যাদের ত্যাগ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বক্তব্য দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মুক্তির জন্য লড়েছেন। কোনো প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধ করেননি।

তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৎ দেশপ্রেমিক, যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচন করার ওপর গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত সাড়ে সাত লাখ বাংলাদেশির জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা প্রয়োজন বলেও তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বাংলাদেশ স্কুলের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বাংলাদেশ স্কুলের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ

প্রামাণ্যচিত্র দেখেন শ্রোতা-দর্শক। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান বাজে। তারই মাঝে মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ারের গর্জন। এরপর নানা রকম প্রতিকূলতা শেষে বিজয়।

‘ও আমার দেশের মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা...।’

দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ। কোদাল নিয়ে মাটি কাটছে নারীরা। ইট মাথায় শ্রমিকের। বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সংবিধান রচিত হলো।

বঙ্গবন্ধু দেশে এলেন। সফর করলেন, অভ্যর্থনা গ্রহণ করলেন।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। ঘাতকের গুলিতে প্রাণ গেল বঙ্গবন্ধুর। নিহত হন পরিবারের আরও সদস্য।

বঙ্গবন্ধুর সমাধি। কিন্তু এটা কি শেষ? না।

যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/ তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

প্রাণের আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। কবিতার সঙ্গে বসবাস তার। আবুল হাসানের কবিতা থেকে তুলে আনেন একটি লাইন। লক্ষ্মী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখি না। কেবল পতাকা দেখি, কেবল বিজয় দেখি।...বিজয় মহা কর্মসূচিতে রূপ নেয়। দেশের প্রতিটি জায়গায়। বাইরের দেশগুলোতে যেখানে বাংলাদেশিরা আছেন সেখানেও এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। লাল-সবুজের মেলা বসেছে সর্বত্র।

মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে তাঁর বলা, রক্তাক্ত লুঙ্গির মর্যাদা মিলবে না কোনো দিন। আজ বলছি, তোমরা সম্মানিত হবে প্রতিদিন।

সেখানে বক্তব্য রাখেন বিমান কর্মকর্তা নিধিন কুমার বড়ুয়া। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধু পরিষদ, যুবলীগ, প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সামাজিক আরও সংগঠনের অংশগ্রহণ ছিল।

পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন দূতাবাসে।

মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক বলেন, উৎসবের বিজয় দিবস আজ। তবে এর একটি পাতা আগে ত্যাগ নির্যাতন আর আত্মাহুতির ইতিহাস। মায়ের অশ্রু ঝরার আর বোনের সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস।

তিনি আজন্ম দেশ এবং এর মানুষের খেদমত করে যাবেন, এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

আবুধাবির জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ
আবুধাবির জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শহীদুজ্জামান ফারুকী। এ পর্বে বাণী পাঠ করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী পাঠ করেন তিনি নিজে। আরমানউল্লা চৌধুরী, রিয়াজুল হক, যোবায়েদ হোসেন পড়েন যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী।

বাঙালি জাতি যুদ্ধ করেছে। লড়াই তার জীবন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি এগোয়। এ দেশ ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের এগারো দফা ও গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার অধিকার সম্পর্কে জানিয়ে দেয় তখনকার সরকারকে। এরপর সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করে সে তার আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে। জাতির পিতা অনুধাবন করেন স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাঙালি জাতির ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার অবসান হবে না।

৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে তখন জনসমুদ্র। একজন কবি কবিতা পড়েন। এ কবি বঙ্গবন্ধু। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।

সকালে দূতাবাসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। তারপর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। আবুধাবির সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আসে এখানে। জয় বাংলা অনুরণিত হয় প্রতিজনের হৃদয়ে।

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। এ সময় ভারত পাশে এসে দাঁড়ায়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীকে পরাজিত করে। ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। জাতি পায় একটি দেশ, একটি পতাকা। বেজে ওঠে হৃদয়তন্ত্রীর গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

দেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২১.৮ শতাংশ। আমাদের মাথাপিছু আয় ১৭৫১ মার্কিন ডলার। শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে বই পাচ্ছে। শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ। ৯০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে। সারা দেশে সড়ক মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, পাতাল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল ও নৌ যোগাযোগে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে পদ্মাসেতু। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এখন বিশ্বের পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ।

এমন একটি উন্নয়নমুখর পরিবেশে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত ইমরান বলেন, দশ কোটি ভোটারের এই নির্বাচন সুশৃঙ্খল এবং সুন্দর হলে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। এ ব্যাপারে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

বলেন, বঙ্গবন্ধুর রূপকল্প বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। মানুষের প্রায় দোরগোড়ায় এখন স্বাধীনতার সুফল। তিনি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বাজে হৃদয়ের গান। ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি,/ সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।।’

আমরা ছুটি স্কুলের অনুষ্ঠানে। সেখানেও উদ্‌যাপিত হতে যাচ্ছে বিজয় উৎসব।