অব্যক্ত অভিমান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাবা–ছেলের মধ্যে দা কুমড়ো সম্পর্ক। দুজনেরই ধারণা অপরজন তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। একে অপরের বিরুদ্ধে হাজারটা অভিযোগ। বাবা বলেন, ছেলে তাকে সম্মান করে না। আর ছেলে বলে, বাবা তাকে পাত্তা দেয় না।

ছেলে সারা রাত জেগে পড়ে। টিভি দেখে। তারপর ফজরের নামাজ পড়ে একবারে ঘুমাতে যায়। বাবা সেটা কিছুতেই মানতে পারেন না। কেন হবে এই রাত জাগা? রাতে ঘুমিয়ে দিনে কেন পড়া যাবে না? অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করেও ছেলের অভ্যাস বদলানো যায় না।

বাবা চান ছেলে তার পাশে বসে ঘরের খাওয়া খাক। কিন্তু ছেলের পছন্দ বাইরের খাবার। সে দোকান থেকে খাবার কিনে এনে নিজের রুমে টিভি দেখতে দেখতে খেতে পছন্দ করে। পুরোনো দিনের নাটকের মতো সবাই এক টেবিলে গোল হয়ে বসে খেতে কেন হবে? আর মাছ ভাত কী কোনো খাবার জিনিস? বাবার দীর্ঘশ্বাস ছেলের পিৎজা–পাস্তার কাছে চাপা পড়ে যায়।

ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পরও পড়বে না। কারণ যে সাবজেক্টে চান্স পেয়েছে তা তার পছন্দ নয়। সে পছন্দের বিষয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। বাবা–ছেলের মধ্যে এ নিয়ে তুলকালাম চলে কিছুদিন। বাবার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না ঢাকা ইউনিভার্সিটির মতো জায়গায় কেউ পড়তে না চায় কীভাবে? এত বড় সুবর্ণ সুযোগ কীভাবে কেউ পায়ে ঠেলে দেয়! ছেলের মাথায় ঢোকে না বাবা কেন এখনো মান্ধাতার আমলের মেন্টালিটি নিয়ে চলেন? কেন বোঝেন না, পড়াশোনা জিনিসটা জোর জবরদস্তি করে হয় না? যে যেই বিষয়টা নিয়ে পড়তে চায়, ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তাকে সেটা করার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।

পদ্মার পানি এদিক-ওদিক বহুবার আছাড় খেয়ে অবশেষে যখন আবার নিজের জায়গায় বইতে শুরু করে তখন দেখা যায় ছেলে প্রাইভেট ইউনিতে পড়ছে। প্রতিটা সেমিস্টার খুব ভালোভাবে পার করছে। এ রকম রেজাল্ট, যেকোনো মা–বাবার জন্য গর্বের ও আনন্দের। কিন্তু এই পরিবারে কেমন যেন এক বিষাদের ছায়া!

বাবা বন্ধুবান্ধবদের কাছে দুঃখ করে বলে বেড়ান ঘরে শান্তি লাগে না। ছেলে স্বেচ্ছাচারী। কথা শোনে না। তারা এসে ছেলেকে বলেন বাবার মনে দুঃখ দিয়ো না, এত ভালো বাবা তোমার। এসব শুনে ছেলে আরও অভিমানী হয়ে ওঠে। কেন বাইরের লোকের কাছে বাবা এভাবে ছেলেকে দোষী করে কথা বলবেন? কেন তার বিরুদ্ধে নালিশ করবেন? সে কি অপরাধ করেছে?

দূরত্ব যেন দিন দিন আরও বেড়েই চলে। অব্যক্ত অভিমানগুলো বাড়তে বাড়তে দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেয়। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেও যেন মুখে বাধো বাধো ঠেকে। পারতপক্ষে কেউ কারও সামনে আসতে চায় না। বাবা দিন শেষে বাড়িতে ঢুকলে ছেলে নিজের রুমে নিজেকে বন্দী করে ফেলে। আর ছেলে সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন।

বাইরের লোকে বাবাকে বলে ছেলের দিকে নজর রাখতে। দিনকাল ভালো না। এই বয়সের ছেলেরা সঙ্গদোষে নষ্ট হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে দেখেন ইয়াবা–টিয়াবা খায় কিনা। এসব শুনে আশঙ্কায় বাবার রাতের ঘুম হারিয়ে যায়। যে ছেলে তার সঙ্গে কথাই বলে না, তাকে কী করে জিজ্ঞেস করবেন নেশাটেশা করা বন্ধুবান্ধব আছে কিনা? থাকলে তাদের থেকে যেন দূরে থাকে। অস্বস্তিতে ছটফট করতে করতে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করে দিন কাটে তাঁর।

ছেলে দেখে বাবা তার বোনের জন্মদিনে কেক নিয়ে আসেন। কিন্তু তার জন্মদিনে তাকে উইশটাও করেন না। ইচ্ছে করে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বাবা তুমি কী সত্যি আমার জন্মের তারিখটা ভুলে গেছ, নাকি ইচ্ছে করেই ভুলে যেতে চাইছ? কিন্তু নাহ, করা হয়ে ওঠে না আর সে প্রশ্ন। দুজনের মাঝখানের দেয়ালটা সবগুলো প্রশ্ন নিয়ে সমানে এগোতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়! মন চাইলেও বুঝি এ দেয়াল আর কখনোই ভেদ করা যাবে না।

আরও অনেক অনেকগুলো দিন এভাবে গড়িয়ে যায়।

লেখিকা
লেখিকা

একদিন ছেলেটি খুব যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফেরে। যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসে সে তাকে জানিয়েছে পরিবার মেয়েটির জন্য একজন সৎপাত্র ঠিক করেছে। মেয়েটি চেষ্টা করেছিল তার পছন্দের ব্যাপারে পরিবারকে রাজি করাতে, পারেনি। মেয়েটি তার পরিবারের অমতে সব ছেড়ে ছেলেটির কাছে আস্তে চায় না। সে সবার সম্মতি নিয়ে বিয়ে করতে চায়। এখন ছেলেটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কী চায়? সে কী পারবে নিজের যোগ্যতায় সবাইকে রাজি করিয়ে পুরো সমাজের সমানে মেয়েটির হাত চিরজীবনের জন্য ধরতে নাকি মেয়েটিকে নিজের জীবন থেকে চলে যেতে দেবে? দিশেহারা ছেলেটি বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে সে! এখনো তো সে চাকরি শুরু করেনি। কীসের জোরে সে সামনে এগোবে? পুরো দুনিয়াকে নির্দয় নিষ্ঠুর মনে হয় তার। যাকে জীবনের সবটুকু ভেবে রেখেছে, সে দূরে চলে গেলে কী করে বাঁচবে সে? এত কঠিন কেন পৃথিবীটা? মনের ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় যেন! তার এই অস্থিরতা, উসকোখুসকো চেহারা মাবোনের চোখ এড়ায় না। তারা জানতে চায় কী হয়েছে। ছেলেটি খুলে বলে তাদের সব।

বাবা কয়দিন ধরে খেয়াল করেন বাড়ির সকলের চোখে মুখে কেমন একটা ভয়, আশঙ্কা ও অসহায়ত্ব কাজ করছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও কেউ তা ঢাকতে পারছে না। এরা নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করে। তাঁকে দেখলেই চুপ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু চেহারা থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ মুছে ফেলতে পারে না। কী হয়েছে সবার? জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যায়। ভালো মুশকিলে পড়া গেল দেখি! না, এভাবে আর না, আজ তিনি শক্তভাবে মেয়েকে ধরলেন। হম্বিতম্বি রেখে সত্যি উত্তরটা দিতে বললেন। মেয়ে চুপ করে আছে দেখে ধৈর্যচ্যুত হয়ে একটা ধমক দিলেন। তখন মেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকে সব জানাল। দিয়ে বাবার হাত ধরে বলল, বাবা তুমি ভাইয়াকে বকা দিয়ো না, ও অনেক কষ্টে আছে। ঠিকমতো খাবারও খায় না কয়দিন ধরে। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। তোমার যত রাগ আমাদের সঙ্গে কর, ভাইয়াকে কিছু বল না প্লিজ। ভাইয়া এখন যে অবস্থায় আছে তুমি যদি এখন খারাপ কিছু বল তাহলে ও আর সহ্য করতে পারবে না।

কোথায় সে এখন? বাসায় আছে? বাবা জানতে চান।

বাবা প্লিজ এখন ওকে কিছু বল না তুমি। এই খারাপ সময়টা কেটে যেতে দাও। তারপর তোমার যত অভিযোগ আছে সেগুলো নিয়ে...মেয়ে কথা শেষ করতে পারে না। দেখে বাবা ভাইয়ের রুমের দিকে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মাকে ডেকে আনে সে। মা–মেয়ে মিলে যতক্ষণে ছেলের কাছে পৌঁছায় ততক্ষণে বাবা–ছেলে মুখোমুখি। বাবা একটা হুংকার দিয়ে বলেন, আমি যা শুনেছি তা কি সত্যি?

ছেলে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকায়। সেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরাজিত মুখটা দেখে বাবার বুকের ভেতরের সবকিছু নড়েচড়ে যায়। তিনি নিজেও টের পান না। তিনি যে কখন ছেলের কাঁধে হাত রেখে কোমল স্বরে বলে উঠেছেন, কেন এত হতাশ হয়েছিস বাবা? আমি আছি না? আমি সব ঠিক করে দেব। তুই চিন্তা করিস না। এতো বড় ছেলে তুই, মায়ের কাছে গোপনে কাঁদবি এটা কেমন কথা? আমাকে আগে বলতি, দেখতি বাপ বেটা মিলে কী করে এক তুড়িতে এই সমস্যা সমাধান করে দিতাম!

অভিমানী ছেলের বাবার এই স্নেহস্পর্শে ভার হয়ে থাকা মনটার সবগুলো বাঁধ ভেঙে যায় যেন। সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

বাবা ছেলের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, আমি আছি রে, আমি আছি। কীভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতে হয় আমি দেখব।

পৃথিবীতে সব সহ্য করা যায়। কিন্তু সন্তানের অসহায় মুখ কখনোই সহ্য করা যায় না। ওই করুন পরাজিত মুখ পিতার বাহ্যিক কাঠিন্য ভেঙে ঠিকই ভেতরের স্নেহময়ী পিতাকে বের করে আনে। যে পিতা জানে সন্তানের যেকোনো দুঃসময়ে পিঠে পিতার হাত সবচেয়ে বেশি সাহস ও ভরসা জোগায়। স্নেহের কাছে ইগো অতি তুচ্ছ একটা জিনিস। জয় হয় পিতাপুত্রের বন্ধনের। হতে বাধ্য!

তাই আজ এক পিতা পুত্রের বহুদিনের পুরোনো এক চাপা অভিমানের। অকারণ ভুল বোঝাবুঝির আর নীরব এক ইগোর লড়াইয়ের অবসান হয়।

আজ এই পরিবারের সবার চোখে পানি। যে পানি আনন্দের, ভরসার আর ফিরে পাওয়া বিশ্বাসের।
...

সারা বুশরা দ্যুতি: বেডফোর্ড, ইংল্যান্ড।