শীতের কম্বল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র পাস করেছি। থাকি মোহাম্মদপুরে খালার বাসায়। কমপ্লিট বেকার। থাকা-খাওয়া ফ্রি। বিনিময়ে বাসার ফুট-ফরমাশ খাটা। তেমন বড় কোনো কাজ নয়। এই ধরুন বাসায় কাঁচা মরিচ নাই। এই যা, এক দৌড়ে গিয়ে কাঁচা মরিচ নিয়ে আয়। খালার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। মুচির কাছ থেকে সারাই করে নিয়ে আসতে হবে। বলা মাত্রই দৌড়। সারাক্ষণেই দৌড়ের ওপর থাকতে হতো। তবে একটা বিষয় খুব ভালোভাবেই তখন মানিয়ে নিয়েছিলাম যে, বেকারদের আত্মসম্মান থাকতে নেই। আর এ জন্যই তেমন একটা খারাপ লাগত না।

তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। খালতো ভাইবোন সবাই বার্ষিক পরীক্ষা শেষে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। বাসায় আমি একা। খালুও জরুরি কাজে দেশের বাড়িতে গেছেন। বেশ কয়েকটা দিন আরামেই কাটছে। জীবনের প্রথম কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছি। শান্তির ঘুম। কম্বল জিনিসটার সঙ্গে আমার আগে কোনো দিনই পরিচয় ছিল না। বাড়িতে বা হল-লাইফটা লেপ মুড়ি দিয়েই কাটিয়েছি। কিন্তু কম্বলে যে এত আরাম এটা আগে বুঝিনি।

আহা শীতের রাতের কম্বল। কম্বলের নিচে শুয়ে শুয়ে কম্বল সম্পর্কিত উদ্ভট চিন্তা করছি। কেন জানি নানান প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি মারছে। আচ্ছা যে কম্বল আবিষ্কার করছে, তিনি কী নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন? মনে হয় পায়নি বেচারা। এত বড় আবিষ্কারের জন্য নোবেল দেওয়া উচিত ছিল। কী যেন একাটা গান আছে—‘বন্ধু আমার শীতের কাঁথা......’। আমার ধারণা যিনি গানটা লিখেছেন, মনে হয় কোনো দিনও কম্বলের নিচে ঘুমাননি। আমি নিশ্চিত তিনি কম্বল জড়িয়ে ঘুমালে জীবনেও গানে কাঁথার কথা লিখতেন না। তো শুয়ে-শুয়ে এই সব উদ্ভট চিন্তা করছি। এরই মধ্যে খালার ডাকে কম্বলের নিচ থেকেই সাড়া দিলাম।

: এই শোন তুই কি ইস্কাটনের সোহাগ কমিউনিটি সেন্টার চিনিস?

: হুম, কম্বলের নিচে থেকেই জবাব দিলাম।

টেবিলের ওপর টাকা রাখা আছে। এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে চলে যা। তোর খালুর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলের সুন্নতে খতনা অনুষ্ঠান। তুই অনুষ্ঠানে খেয়েদেয়ে তোর খালুর নামে টাকাটা লিখিয়ে দিয়ে আসিস। না গেলে আবার ইজ্জত থাকবে না। আমি বাইরে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় দরজায় তালাটা ভালোভাবে মারিস। তোর তো আবার ভুলো মন। তাড়াতাড়ি ওঠ...। এই সব বলে খালা বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।

আমি মনে মনে ভাবছি। এখনই মানে কী! আজকাল কী আবার ব্রেকফাস্টের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেছে। কালে কালে যে কত কিছু দেখতে হবে। কোথাও একটু শান্তি নাই। রাগে গজগজ করে কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে দেখি দুপর ১২টা। এই সারছে রে! কম্বল ভাবনায় আমার ১২টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে দৌড়। দাওয়াত খাওয়ার কথা চিন্তা করে বাসা থেকে কিছু না খেয়েই বের হয়েছি। যেতে যেতে পোলাও-বিরিয়ানি খাওয়ার কথা চিন্তা করতে লাগলাম।

বিপত্তিটা বাঁধল কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে। দেখি কমিউনিটি সেন্টার দুইটা। সোহাগ ১ ও সোহাগ ২। কোনটায় ঢুকব ঠিক বুঝতে পারছি না। কাউকেই তো চিনিও না। খালাও নির্দিষ্ট করে কিছু বলেও দেননি। কী মুশকিল! দুইটাতেই দেখি লোকজন ঢুকছে। ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে সোহাগ ১–এ ঢুকে গেলাম। গিয়ে দেখি বিভিন্ন টেবিলে লোকজন বসে বসে আড্ডা মারছেন। এদিকে ক্ষুধায় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে। খাবারের কোনো নামগন্ধ নেই। আমার কিছুটা সন্দেহ হলো। ভুল করিনিতো! কে কী মনে করে এই ভেবে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে ইচ্ছে করছে না। চোখ আটকে গেল একটা টেবিলে এক সুন্দরীর দিকে। লাল রঙা শাড়িতে আরও অপূর্ব লাগছে। হাত নাড়িয়ে-নাড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। ইশ দেখতে কী সুন্দর। চোখ ফেরাতে পারছি না। এক পলকে চেয়েই আছি। মেয়েটা কেমনে কেমনে যেন আমাকে দেখছে, কিছুটা প্রশ্রয়ের দৃষ্টি। প্রথম দেখাতেই মেয়েটার ওপর ক্র্যাশ খেয়ে গেলাম। ক্ষুধা পেটে আমার আবার ক্র্যাশ খেতে খুবই ভালো লাগে। অনেকটা সাহস করে পাশে গিয়ে বসলাম। মেয়টা মিট মিটি করে হাসছে আর আড় চোখে আমাকে দেখছে। আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। কারও ওপর ক্র্যাশ খেলে আমার আবার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। কোথায় কী বলতে হয়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। একটু সাহস করেই অনেকটা আমতা আমতা করে বললাম—

: ইয়ে মানে কিছু মনে করেন না, আপনাকে না ঠিক আমার জিএফ-এর মতো লাগছে।

সিনেমা বা নাটকে এই ধরনের কথা বলার পর নিশ্চয় একটা চড়-থাপ্পড় থাকে। কিন্তু মেয়েটা দেখলাম তেমন কিছুই করল না। শুধু হেসে জবাব দিল।

: তোমার ফাজলামির অভ্যাস তাহলে এখনো আছে?

আমি ধান্দায় পড়ে গেলাম। বেকুবের মতো শুধু তাকিয়ে আছি।

: আরে আমি প্রভা। আমাকে চিনতে পারছ না?

মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। প্রভা নামের পরিচিত কাউকেই তো আপাতত আমার মনে পড়ছে না। স্কুল-কলেজেতো কোনোদিনই মেয়েদের সঙ্গে পড়িনি। প্রভা নামের একজনকে অবশ্য চিনি, উনিতো নাটক করেন। তিনি তো আবার অনেক বিখ্যাত। সকল যুবক পোলাপানের রাতের বেলার ক্র্যাশ।

: আরে আমি তোমার সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। তোমার মনে নেই। ইতি ম্যাডামের ছোট বোন।

এবার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

: কী বলো, তুমি সেই প্রভা? বেকুবের মতো আবার বললাম, আরে তুমিতো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছ। কত দিন পর দেখা।

আমার বোকামি দেখে প্রভা হাসছে। সব মনে পড়ছে। আমার জীবনের প্রথম ক্র্যাশ ছিল এই প্রভা। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। হঠাৎ করেই একদিন আমাদের হেডস্যার এক সুন্দরী ম্যাডামকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন—উনি হচ্ছেন তোমাদের নতুন ম্যাডাম। এখন থেকে তোমাদের ক্লাস নেবে। হেডস্যার প্রভাকে দেখিয়ে বলল এর নাম প্রভা। তোমাদের ম্যাডামের ছোট বোন। এখন থেকে তোমাদের সঙ্গে ক্লাস করবে।

পরে অবশ্য জেনেছিলাম, ম্যাডামের স্বামী কিছুদিন আগে আমাদের উপজেলায় সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে বদলি হয়ে এসেছেন। স্বামীর বদলির কারণে ম্যাডামও বদলি হয়ে আমাদের স্কুলে জয়েন করেছেন। প্রভা তখন ম্যাডামের কাছে থেকেই পড়াশোনা করত। প্রভাকে দেখলেই বোঝা যেত শহরে বড় হওয়া মেয়ে। বেশ একটা ভাবসাব ছিল। একই ক্লাসে পড়লেও কাউকে তেমন একটা পাত্তা দিত না। আমি মাঝে মাঝে ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু পাত্তা দিত না। আবার ভয়ও পেতাম। ম্যাডামের বোন বলে কথা। প্রাইমারি পাস করার পর আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। ম্যাডামও বদলি হয়ে ঢাকাতে চলে যান। এরপর আর প্রভার সঙ্গে দেখা হয়নি।

: এখন কী করছ? প্রভা আমাকে অনেকটা আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করল।

: মানুষের বাসায় ফুট-ফরমাশ খাটি, এই আর কী।

: ফাজলামি রাখ, তা তুমি এখানকার খবর পেলে কী করে?

: বললাম, কেন মুসলমানির দাওয়াত খেতে এসেছি।

: ইয়ার্কি বাদ দাও, যাও কাউন্টারে গিয়ে ডোনেশানের টাকাটা দিয়ে আসো। পরে চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে, কত দিন পর দেখা।

মনে মনে ভাবছি এ আবার কোন অনাচারের মধ্যে পড়লাম। খাই-দাইয়ের আগেই গিফটের টাকা দিতে হয়। নিয়মকানুন দেখছি সব উল্টে-পাল্টে গেছে। কলিকাল চলে আসছে মনে হয়। প্রভার কথামতো কাউন্টারে খালুর নাম লিখিয়ে ৫০০০ টাকা জমা দিয়ে যথারীতি প্রভার কাছে গিয়ে বসলাম। ওদিকে এখনো খাবারের কোনো নামগন্ধ দেখছি না। যেই প্রভাকে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতে যাব, ঠিক ওই মুহূর্তেই প্রভার প্রশ্ন।

: কত টাকা দিলে?

: ৫০০০ টাকা।

প্রভা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, বেকার অবস্থায় তুমি এত টাকা ডোনেট করলে, তুমিতো দেখছি মস্ত বড় মহান লোক। অনেকটা আনন্দিত হয়ে প্রভা বলল, তোমার টাকা দিয়ে কমপক্ষে ১০টা কম্বল কেনা যাবে।

আমি প্রভার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝলাম না। এর মধ্যে আবার কম্বল এল কোথা থেকে। আমার প্রতি প্রভার আগ্রহটা দেখলাম হঠাৎ করেই খানিকটা বেড়ে গেল।

প্রভা কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে বলতে শুরু করল, জানো আমরা গত দুই বছর ধরে শীতের মৌসুমে কম্বলের এই প্রোগ্রামটা করে আসছি। প্রথমবার আমার বন্ধুবান্ধবেরা নিজেরাই টাকা তুলে এক হাজার কম্বল ফুটপাতের শীতার্তদের মাঝে বিলি করেছিলাম। এবার আমরা ফেসবুক গ্রুপ খুলে ব্যাপক প্রচারণা চালাই। নিশ্চয় তুমিও ফেসবুক থেকেই সংবাদটা পেয়েছ। তুমি কি আমাদের গ্রুপের মেম্বার? দেখছ আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। যা হোক, তোমাকে যখন পেয়েছি আর ছাড়ছি না। আমাদের সঙ্গে তুমিও কাজ কর।

আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। প্রভা কথা বলেই যাচ্ছে আর ওদিকে আমার গলা শুকিয়েই যাচ্ছে। এখন আর ক্ষুধাটাও টের পাচ্ছি না। প্রভাকে বললাম, একটু পানি খাব। মনে মনে ভাবছি কত বড় ধরাটাই না খাইলাম। ও নিজে উঠে গিয়ে আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এল। আমি পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ইতিমধ্যে প্রভা তার অন্য সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আমাকে গর্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

: এই হচ্ছে আমার ছোটবেলার বন্ধু। ও আমাদের প্রোগ্রামে পাঁচ হাজার টাকা ডোনেট করেছে। সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। যদিও এখনো কোনো চাকরি-বাকরি করে না। চাকরি করলে নিশ্চয়ই আরও বেশি ডোনেট করত। কি বল, তাই না? আমিও ধরা খাওয়ার কষ্ট সামলে অনেকটা শুকনা হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে ভাব নিতে থাকলাম।

প্রভার সঙ্গে অনেক গল্প হলো। ও এবার নর্থ সাউথ থেকে এমবিএ শেষ করেছে। এখনো ওর আপা-দুলাভাইয়ের সঙ্গেই থাকে। কাঁঠাল বাগানে বাসা। প্রভার সঙ্গে গল্প করেই যাচ্ছি। বেশির ভাগ কথা ওই বলছে। আমি শুধু হু-হা করছি। কারণ ধরা খাওয়াটা মন থেকে তাড়াতে পারছি না। মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছি। প্রভার চুলের মিষ্টি গন্ধে কেমন যেন আমার পেটের ক্ষুধাটা আবার বেড়ে গেল। বেশি ক্ষুধা পেলে আমার আবার মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। আবোলতাবোল বকি।

: প্রভা তুমি কী গায়ে দিয়ে ঘুমাও? বেকুবের মতো প্রশ্ন করলাম।

: মানে কী, তোমার মাথা ঠিক আছে?

: না, মানে তুমি কি কম্বল গায়ে দাও?

: হ্যাঁ, তো শীতে মানুষ কী গায়ে দেয়?

: না, মানে আমিও কম্বল গায়ে দিইতো, আমতা-আমতা করে বললাম।

প্রভা কিছুটা অবাক হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার আবোলতাবোল কথা শুনে হয়তো মনে মনে ভাবছে-আহা বেচারা! পড়াশোনা করে মাথাটাই গেছে!

: প্রভা, শোনো, একটা কাজ করলে কেমন হয়। খানিকটা সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললাম।

প্রভা অনেকটা আগ্রহী শ্রোতার মতো আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল, কী কাজ?

: আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। আমরা কিন্তু চেষ্টা করলেই একটা কম্বল বাঁচাতে পারি।

: কীভাবে? প্রভা খানিকটা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

: আচ্ছা আগামী বছর আমরা দুজন যদি একটা কম্বল শেয়ার করি তাহলেতো অনায়াসে একটা কম্বল সেভ করতে পারি।

: বুঝলাম না তোমার কথা। পরিষ্কার করে বল। প্রভা অনেকটা সিরিয়াস হয়েই বলল।

: আচ্ছা বলছি, সহজ হিসাব। এই ধরো, আগামী বছর আমরা দুজন যদি একটা কম্বলের নিচে ঘুমাই তাহলে তো অনায়াসে আমরা একটা কম্বল শীতার্তদের মধ্যে ডোনেট করতে পারি। দেখছ না, এই শীতে রাস্তার পাশে থাকা মানুষের কত যে কষ্ট হয়, তাই না? আমি কথাগুলো বলে প্রভার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

আমি জানি না, নাটক বা সিনেমাতে এই ধরনের কথা বলার পর কী প্রতিক্রিয়া হয়। কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার মাথা কাজ করছে না। কিছুই ভাবতে পারছি না...।

শুধু দেখলাম, প্রভা আমার কথা শুনে শুধু হেসেই চলছে।
...

মো. কামরুজ্জামান মিলন: পিএইচডি গবেষক, গিয়াংসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>