মাপকাঠি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তানভির স্মার্ট হতে চায়। যাকে বলে ‘ড্যাম স্মার্ট’। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে যে ধরনের জীবনযাপন করে তা বাংলাদেশের অনেকের স্বপ্নেরও বাইরে। তিন বছর বিশ্বের ফ্যাশন আইকন দক্ষিণ কোরিয়ায় টো টো করে ঘুরে বেড়ানো তানভিরের সঙ্গে দেশের আর দশজনের অভিজ্ঞতা মেলে না। এখন সে আবার বাস করে সবার স্বপ্নপুরি আমেরিকাতে।

কী সে করেনি। লাতিন নাচ, নৈশক্লাব, মার্শাল আর্ট, অভিনয়, ফটোগ্রাফি। কোরিয়ায় বিদেশিদের মাঝে এক জনপ্রিয় নাম ছিল তানভির। এত কিছুর পরও তার কেবলই মনে হয়, সে বুঝি পিছিয়েই আছে। ঠিকই তো বাংলাদেশের সমাজের মাপকাঠিতে সেতো ‘ভালো’ বলে বিবেচিত ছিল না! নটর ডেম কলেজে পড়া হলেও বুয়েটে পড়ার ভাগ্য তার হয়নি, শেষ পর্যন্ত জায়গা হলো মিলিটারিদের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। সেখানে তার ভালো লাগলেও, অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা শুরু হলো। বুয়েটের বড় ভাইরা বোঝালেন, আমেরিকাতে যেতে না পারলে জীবন বৃথা। আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার যত রকম চেষ্টা করা যায় সবই সে করেছে। কোনো লাভই হয়নি। একের পর এক আবেদন ব্যর্থ হওয়া, বন্ধুদের বিদেশ যাওয়া দেখতে দেখতে তানভির মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। এক বন্ধুর পরামর্শে দক্ষিণ কোরিয়ায় আবেদন শুরু করল। সেখানেও খুব একটা সুবিধা হচ্ছিল না। এক অখ্যাত কোরীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাওয়া গেল। অনেকেই কুকুরের মাংসের ভয় দেখাল, কেউ কেউ বলল কোরিয়ার পড়ালেখার কোনো মূল্যই নাই।

জাত হারানো তানভির অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল কোরিয়া অতি উন্নত দেশ। ভাষার সমস্যা ছাড়া আসলে সেই দেশে তেমন কোনো সমস্যা নাই। প্রথম খাবার দাবার নিয়ে কিছু সমস্যা হলেও দেশে বোঝা হিসেবে বিবেচিত তানভির খুব শিগগিরই খাপ খাইয়ে গেল। সম্পূর্ণ অজানা কোরীয় ভাষাও সে আয়ত্ত করল এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল, কোরীয় সংস্কৃতি ও ভালো লাগা শুরু করেছে।

সব ভালোরই শেষ হয়। কোরিয়ায় পড়ালেখার পাট চোকার সঙ্গে সঙ্গেই তানভির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পালিয়ে বেড়াতে লাগল। কারণ আর কিছু নয়, অজানা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না। তত দিনে সে বুঝে গেছে বাংলাদেশ থেকে বাইরে থাকলে তথাকথিত মাপকাঠি থেকে বাঁচা যাবে। কিন্তু দেশে ফিরলে আর রক্ষে নেই।

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। তানভিরকে দেশে ফিরে আসতে হলো। শুরু হলো এক অদ্ভুত পলাতক জীবন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী কাউকেই তার ঠিক সহ্য হচ্ছিল না। নিজের চিরচেনা দেশকে খুবই নোংরা আর মূল্যহীন মনে হতে শুরু করল। তানভির কাছে হঠাৎ তৃতীয় বিশ্ব ধারণাকে সত্য মনে হতে লাগল। এক অস্বাভাবিক রাগ, ঘৃণায় মন ভরে উঠল। অথচ তৃতীয় বিশ্বে জন্ম নেওয়া এই তানভিরই কোরিয়াতে উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের এ ধারণা বিপক্ষে তর্ক যুদ্ধে হারিয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে।

হন্যে হয়ে আবার দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে বেশ কিছু সম্ভাবনা তৈরি হলো। তানভির উপলব্ধি করল তার কোরীয় ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা এক অমূল্য সম্পদে রূপ নিয়েছে। স্বপ্নের সেই আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ এসে গেছে! কাউকে না জানিয়ে মোটামুটি গোপনে সে আমেরিকার পথে রওনা হয়ে গেল।

এরপরেও সমালোচনা থেকে পুরোপুরি মুক্তি সে অবশ্য পায়নি। আমেরিকায় বন্দুক যুদ্ধ হয়, মুসলমানদের হেয় করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমেরিকাতে সে আবার নতুন মাপকাঠি আবিষ্কার করল। আমেরিকা ছাড়া অন্য কোনো দেশ নাকি উন্নত না! কোরিয়ার মতো অত্যাধুনিক দেশ দেখে আসা তানভিরের এবার বেদম হাসি পেল।

কিন্তু এসবের সঙ্গে স্মার্ট হতে চাওয়ার সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা বেশ জটিল। অন্তত তানভিরের কাছে তাই মনে হয়। তথাকথিত উন্নত বিশ্বেও যে আরেক ধরনের মাপকাঠি আছে! দেশ ছেড়ে এলেও বিদেশিদের মতো সে মেয়েদের শরীরে অবলীলায় হাত রাখতে পারে না। লাস্যময়ী মেয়ে বন্ধু নেই। অ্যালকোহলের গন্ধ সহ্য হয় না। নৈশক্লাবে গিয়ে মূর্তির মতো এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিদেশি মেয়েদের পিছে ঘোরার ফলাফলও মোটামুটি একই। সবাই বাংলাদেশি মেয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। দুই কূল হারানো মাঝির মতো তানভির ভাবে তার কী কোনো দিনই মাপকাঠির থেকে মুক্তি মিলবে না?
...

তাওসীফ রহমান: আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>