আমার নটর ডেম কলেজ

নটর ডেম কলজের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপনের প্রচারপত্র
নটর ডেম কলজের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপনের প্রচারপত্র

আঙুল গুনে গুনে আমার নটর ডেম কলেজের স্মৃতি এখন প্রায় তিরিশ বছরের পুরোনো। তবে ঝকঝকে-তকতকে, টগবগে তরুণ সেই সেদিনের ঝকমকালো স্মৃতি বেশি দিন হলে পরশু দিনের কথা, এ রকম যদি বলি কিংবা কেউ যদি বলেন তাহলে কিন্তু একটুও বাড়াবাড়ি হবে না আমার কাছে। কারণ সুখদিন-সুখস্মৃতিগুলো মানুষ সারা জীবন মনে রাখেন। সারাক্ষণ আপন সম্পদ ভেবে আঁকড়ে ধরেন নিত্য প্রতিক্ষণ।

১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সমস্ত স্বপ্ন আর উত্তেজনা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম নটর ডেম কলেজে। তারপর নটর ডেমের দিনরাত সময়গুলোই সবচেয়ে সুখময় দিন আমার কাছে সেটা আমি বলতে পারি নিশ্চিত করে। আনন্দ-বেদনা, তারুণ্য আর উচ্ছল সব মিলে মিশে কাটে আমার নটর ডেমের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত। আজ কত বন্ধু, চেনা চেনা মুখ লেখা রেখে টেনে নেয় অন্যদিকে। স্মৃতিময় পুরোনো ছবির সামনে দাঁড়ালে যেমন আনমনে হঠাৎ স্থির ছবিও নড়ে ওঠে, সেরকম নটর ডেম নামক গল্পের অংশ হঠাৎই যেন নড়ে ওঠে। তারপর সিনেমার সেলুলয়েডের মতো চলমান হয়ে ওঠে বিশাল পর্দায়।

কুলিয়ারচরে লেখকের নটর ডেমের বন্ধুরা (১৯৯০)
কুলিয়ারচরে লেখকের নটর ডেমের বন্ধুরা (১৯৯০)

নটর ডেম কলেজের প্রিয় শিক্ষক নির্মল স্যারের হাত ধরে অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবে যুক্ত হওয়া। ক্লাবের হয়ে এখানে সেখানে চষে বেড়ানো। তারপর এক শীত শীত কুয়াশা ভেঙে ট্রেনে করে স্যারসহ ক্লাবের সকলকে নিয়ে আমার জন্মভূমি প্রাণের কুলিয়ারচরে যাওয়া। অফুরন্ত কৈশোর আনন্দে মেতে ওঠা এখানে-সেখানে সবাই। সেই আনন্দের ছিটেফোঁটা এখনো জীবন্ত। মনে হয়, এই তো সেদিনই তো ঘুরে এলাম সবাই। নরম আলোর বিকেল শেষে নটর ডেমের খোলা আঙিনায় স্নিগ্ধ ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। এর আরেকবার প্রমাণ পাই বহু বসন্ত পেরিয়ে। নিজের জীবনের শুভ লগনের নিমন্ত্রণপত্র কলেজে রেখে গিয়েছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক ঠিকই নির্মল স্যার আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই কুলিয়ারচরে হাজির হন। আশীর্বাদ করেন দুই হাতে। এখনো ভেবে শিহরিত হই, কত মমতাই না দিয়েছে আমার নটর ডেম কলেজ।

সুখের স্মৃতিগুলোর গতি কেমন যেন দ্রুত মনে হয়। এই তো শুরু হতেই যেন শেষ হয়ে যেতে চায়। নটর ডেমের ভালো লাগা-ভালোবাসা সোনালি অতীতের খামে রেখে চলে চলে গেলাম ভারতের নৈনিতালে। হিমালয়ের পাহাড়-পর্বত ভেদ করে করে আরেক স্বপ্নময় রাজ্য। নটর ডেমের খুব কাছের বন্ধু—সহপাঠী সৌরভ, রুমী আর আমি পড়তে যাই নৈনিতালে। নটর ডেম কলেজের কারণে যতটুকু জ্ঞান-আগ্রহ, স্বপ্ন ছিল জীবনের দুরন্তপনার, সবকিছুই যেন সত্যি হলো আমাদের। হিমালয় কন্যার এ নগরীর পরতে পরতে ছিল বিস্ময়কর রোমাঞ্চ। সেই সঙ্গে ভূগোল পাঠের জ্ঞান মিলেমিশে একাকার তখন। আমাদের একা একা আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে রিনঝিনঝিন কষ্টও কাজ করত এই ভেবে। আহা! নটর ডেমের সেই চেনা মুখগুলো সবাই মিলে যদি রোমাঞ্চকর রাজ্যে ঘোরা যেত। সেটা যেহেতু হয়নি, নৈনিতালের তিন বছর পাথরের কণা, পাহাড়ি ফুল, ধূলি কত কিছুই খামে ভরে পাঠিয়েছি বন্ধুদের। সেটা ভাবতে আবারও রোমাঞ্চিত হই এখন।

নৈনিতালে বন্ধু সৌরভ ও রুমীর সঙ্গে লেখক
নৈনিতালে বন্ধু সৌরভ ও রুমীর সঙ্গে লেখক

রোমাঞ্চিত হই বর্তমানে যেখানে থাকি, অস্ট্রেলিয়ার ভৌগোলিক কাঠামো, গঠন আর অ্যাডভেঞ্চার করার নানা রূপ, কৌশল দেখে। বড়ই সুন্দর অস্ট্রেলীয় লীলাভূমি। মোহিত করে, মায়াবী আঁচলে সারাক্ষণ জাপটে ধরে। মাঝে মাঝে মনে হয় এ অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। নিরন্তর সমুদ্র-পাহাড় ভালোবাসা কখনো ছাড়বে না আমাদের। তাই এ দেশেও খুঁজি ফিরি নটর ডেমিয়ানদের। সিডনিতেও আমরা চেষ্টা করছি নটর ডেম কলেজ অ্যালামনাই গঠন করার। বেশি না হোক, কিছু নটর ডেমিয়ান থাকি একসঙ্গে। জয়তু নটর ডেম কলেজ। ৭০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপনে আমাদের অভিনন্দন।
...

কাউসার খান: নটর ডেম কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী: ব্যাচ ১৯৮৯-১৯৯১, রোল ৯১৮৩১১।