মাউন্ট উইলসনে একদিন

মাউন্ট উইলসনের প্রকৃতি
মাউন্ট উইলসনের প্রকৃতি

মাউন্ট উইলসন। ম্যাপল গাছের সুনিবিড় ছায়ায় এ যেন প্রকৃতির সাজঘর। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের ব্লু মাউন্টেন এলাকায় এর অবস্থান। সিডনি শহর থেকে প্রায় এক শ বিশ কিলোমিটার পশ্চিমে ও ব্যাল শহর থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার পূর্বে নয়নাভিরাম এই মাউন্ট উইলসন। ১৮৬৮ সালে এডওয়ার্ড উইন্ডহাম প্রথমে এলাকাটি সার্ভে করেন। পরে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের ল্যান্ড সেক্রেটারি জন বোয়ি উইলসনের নাম অনুসারে এই এলাকার নামকরণ মাউন্ট উইলসন।

অস্ট্রেলিয়ার নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক প্যাট্রিক হোয়াইট (১৯১২-১৯৯০)। জীবনের শুরুর দিকে তিনি বেশ কিছু বছর তাঁর মা-বাবার সঙ্গে এই মাউন্ট উইলসনে বসবাস করেন। তাঁর ব্রিটিশ অভিবাসী মা-বাবা অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেট হয়ে ১৯১২ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত সময় এখানেই কাটিয়েছেন। মাউন্ট উইলসনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই প্যাট্রিক হোয়াইটের লেখকসত্তা জাগিয়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল। তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্লো ইন দ্য গ্লাস’-এ তিনি এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন।

শরৎকালে এ এলাকার ম্যাপলগাছগুলো হলুদ হয়ে আসে। কখনো লালচে। আমি, বন্ধুবর ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, অনীলা আপু, নাজিয়া হাফিজ আর ছোট্ট মামণি ঈশিকা। আমরা সবাই সিডনি থেকে ফ্রিওয়ে এম ফোর ধরে ব্লু মাউন্টেনের থ্রি-সিস্টার এলাকা পার হয়ে চলেছি মাউন্ট উইলসনে। ব্যাল শহর পার হতেই শুরু হয় নিবিড় ছায়ায় ঝরাপাতা ছাওয়া ঘাস। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ আর ‘রূপসী বাংলার কবিতা’র আবহ আমরা টের পেতে থাকি।

পাহাড়ের পর পাহাড়। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে উঠতে গিয়ে আমাদের গাড়িটা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে। এক্সিলেটর কথা শুনছে না। এরই মধ্যে টের পেলাম আমরা একে অপরের কথাও তেমন শুনছি না। কানে অন্য রকম যন্ত্রণা হচ্ছে।

বললাম, নয়ন ভাই, আমরা তো প্লেনে উড়ছি না। কানের বাতাস বেরিয়ে গেল কেন?

নয়ন ভাই বললেন, ভাই, প্লেনে উড়ছি না সত্যি। তবে সমুদ্র লেভেল থেকে এখন আমরা প্রায় দুই হাজার মিটার উচ্চতায় আছি।

মাউন্ট উইলসনের প্রকৃতি
মাউন্ট উইলসনের প্রকৃতি

ও আচ্ছা। তাই তো আমাদের গাড়িটা প্লেনের মতোই আওয়াজ করছে। শরীরটাও বেশ হালকা লাগছে। সহসা নিজেকে আকাশে উড়ন্ত পাখির মতো মনে হলো। পেছন ফিরে দেখি অনেক নিচে বহুদূরে আমাদের সিডনি শহর দেখা যাচ্ছে। একপর্যায়ে যখন আমাদের গাড়িটা মাউন্ট উইলসন এলাকায় ঢুকতে শুরু করে, নিজের অজান্তেই মনটা যেন বদলে যেতে থাকে। স্থায়ী আবাস থেকে হঠাৎ করেই দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার এই এক ভালো লাগা। এতে করে জীবনের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। একঘেয়ে জীবনে মনের ভেতর জমা হওয়া কষ্টগুলো মুছে যায়।

হঠাৎই মনে পড়ে যায় দেশের কথা। আমাদের মতো প্রত্যেক অভিবাসীর হয়তো এমনই হয়। ব্যস্ত জীবনের বাঁকে একটু সুন্দর সময়ের ভেতর দিয়ে যেতেই মনে পড়ে দেশে ফেলে আসা জীবনে ওই সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলো। আহা, এখন যদি আমার ওই খোকন সঙ্গে থাকত। সে খুব সুন্দর বাঁশি বাজায়। আজকের মনোরম বিকেলটি মাউন্ট উইলসনের এই হলুদ স্বর্গে বসে তার বাঁশি শুনতে পারতাম। ওই যে একবার তিতাস নদের পাড়ে বহু প্রাচীন বটগাছটার ছায়ায় বসে চানাচুর-মুড়ি-সালাদ মেখে খাওয়া...। ওই মনোরম বিকেলটা। কলেজমাঠের এক প্রান্ত ওই মেহগনিগাছটার নিচে বসে একের পর এক রূপসী বাংলার কবিতাগুলো পড়া। কবিতার মুগ্ধতায় একসময় ছেদ পড়ে। কার যেন ছায়া। সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে।

চোখ তুলতেই দেখি সবিতা।

তুই এখানে!

আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলে, তোর জন্য এনেছি। খেয়ে নিস।

প্যাকেটটা খুলে দেখি বেশ বড় আকারের আটটি লিচু। প্রচণ্ড গরমের ভরদুপুর। তিনটি লিচু খাওয়া শেষ হতেই দেখি আমার ক্লাসমেট ইমন, সজল আর দিপু কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলে সব।

ইমন বলে, কত মেয়ের পেছনে ঘুরছি, কেউ পাত্তা দেয় না। এদিকে ওর অবস্থাটা দেখ, সারা দিন কবিতা-উপন্যাস-গান নিয়ে থাকে, কাউরে সে পাত্তা দেয় না। অথচ সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ঘোরে ওর পেছনে।

মাউন্ট উইলসনে সপরিবার লেখক
মাউন্ট উইলসনে সপরিবার লেখক

আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। লিচু খাবি খা। এত কথা বলার কী আছে। সজল আর দিপু এমনই আরও কিছু কথা শেষে শুরু করে সরকারি আর বিরোধী দল নিয়ে সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। দেশের বেশির ভাগ মানুষই এই এক মোহে বিভোর হয়ে আছে। অথচ এসব আলোচনা আমার একেবারেই অপছন্দ। পরিবেশটাই গেল নষ্ট হয়ে। শান্তিময় জীবন গড়তে নিজের প্রতি খেয়াল করতে হয়। মনটাকে বড় করতে নিজেকে সময় দিতে হয়। মানুষের তৈরি করা গল্পের ভেতর হারিয়ে গেছে মানুষ। আপন ঘরের নেই খবর। ‘এমন মানব জনম রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। মন রে কৃষিকাজ জানো না।’ না। আমি বৈষ্ণব-বাউল কোনোটাই নই, তবে তাদের মাঝেই বড় হওয়া আমি আবহমান বাংলার এক বাঙালি। সারা পৃথিবীর মনোরম শিল্পগুলো তুলে এনে আমি আমার ঘরখানা সাজাই।

ওই সবিতা আজ আর নেই। জানি না কে কোথায়। তবুও ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য মনটা কেন এত ব্যাকুল। সুন্দরের মাঝেও কী এক কষ্ট জড়ানো। চাওয়া-পাওয়ার এত টানাপোড়েন।

শুকনো হলুদ পাতায় ছাওয়া পথে হাঁটতে হাঁটতে নয়ন ভাইকে বললাম, ভাই, চলুন শুকনো পাতায় ছাওয়া ঘাসের ওপর বসি। একটা গান শুনতে বড় ইচ্ছে করছে।

বেশ তো। তাই হোক।

তারপর মাদুর পেতে আমরা সবাই বসে পড়লাম। আইফোনে ইউটিউবে শিল্পী মান্না দের ওই গানটা...।

‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়।
তারই মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর।’

প্রেম, প্রকৃতি মানুষ...। অনেক পাওয়ার মাঝে কী যেন না পাওয়া। অনেক খেয়ালের মাঝে এক অদেখা খেয়াল। অবহেলায় ফেলে আসা জীবন। তাই যেন গুমরে গুমরে কাঁদে এই বুকে। কী যেন নেই।

ক্যাপিটালিজমের চাকায় পিষ্ট হওয়া আমাদের বনলতা সেন অফিস শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। বাড়ি-গাড়ির লোন, ইনভেস্টমেন্ট প্রোপার্টি—জীবনে সুসময় কখন আসবে? এমন হাজারো হিসাব-নিকাশের জীবন্ত ক্যালকুলেটর পরবাসে আমাদের বনলতা সেন। রূপসী বাংলার কবিতায় ডুবে থাকাকালে তপ্ত দুপুরে মায়া জড়ানো ওই আটটি লিচু? ইমন, সজল আর দিপু রূপে পুঁজিবাদ কেড়ে নিয়ে গেছে আমাদের শিল্পীমন। স্বপ্নচারী কবি-সাহিত্যিকদের স্বপ্ন বিহারের বিপরীতে আমাদের কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘স্বর্গ যদি থেকেই থাকে, তবে তাকে আমাদের সাধনা দিয়ে এই ধূলির ধরাতে নামিয়ে আনব।’

মহা উল্লাসে ঈশ্বরের কুলখানি খেয়ে বর্তমান বিশ্ব আমাদের এ কথাই বলছে। তার পরও ক্লান্ত মন মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, হে বন্ধু, তোমার ওই স্বর্গ আর কত দূর?

গান শেষে নয়ন ভাই বললেন, ভাই, পাহাড় বেঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে খিদে লাগছে খুব।

হ্যাঁ ভাই, চলুন কোথাও বসি।

একটা ম্যাপলগাছের ছায়ায় মাদুর পেতে বসি সবাই। সঙ্গে করে আনা পেঁয়াজি আর ছোলা ভাজা সালাদসহ মেখে সামান্য মুড়ি মিশিয়ে শুরু হয় মধ্যাহ্ন ভোজন।

বললাম, নয়ন ভাই, উপনিবেশ কিংবা জবরদখলের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই বলা যাবে। তবে ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক এই অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ জবরদখলের সূচনা করে ভালোই করেছিলেন। নইলে আমাদের মতো ভিতু মানুষেরা এই মনোরম মাউন্ট উইলসন দেখার কথা চিন্তাও করতাম না।

ঠিকই বলছেন। পৃথিবীটাকে আধুনিক রূপ দিতে তাঁদের ভূমিকা অনেক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই সময়টা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিময়। এই সময়টুকু তৈরিতে...কী কারণে যেন নয়ন ভাই থেমে গেলেন।

বললাম, জি ভাই। এই কৃতিত্বের দাবিদার পারমাণবিক বোমা। বিষয়টা এমন—দেখো বাছা, আমাকে মেরেছ কী তোমাকেও মারব।

ঠিক তাই।

মাউন্ট উইলসনে
মাউন্ট উইলসনে

আচ্ছা নয়ন ভাই, অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের বাঙালি পাঠকদের পরিচিতি...। আপনার কাছে কী মনে হয়?

কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বলেন, না, তেমন কোনো অনুবাদকর্ম আমার চোখে পড়েনি।

জি, সেদিন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সময়ের আলোচিত ছোটগল্পকার টিম উইন্টনের একটা গল্প পড়ছিলাম। ঠিক তখনই মনে পড়ে এ সময়ের সাহসী অনুবাদক ফজল হাসান ভাইয়ের কথা। ফোন দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত লেখকদের ভালো মানের কিছু ছোটগল্প অনুবাদ করে একটা বই প্রকাশ করতে তাঁকে অনুরোধ করেছি। উনি সম্মত হয়েছেন।

খুব ভালো করেছেন। ফজল হাসান ভাইয়ের অনুবাদ করা ‘আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইয়ের ‘দাশত্-ই লাইলি’ গল্পটা পড়ার সময় আমার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। চলুন একদিন সুযোগ করে ক্যানবেরায় ওনার বাসায় যাই।

জি ভাই। আমারও খুব ইচ্ছে তাঁর সঙ্গে দেখা করার।

অনীলা আপু আর নাজিয়া হাফিজ দুজন এতক্ষণ নানান আলোচনার পাশাপাশি ছোলা ভাজা মাখানোয় ব্যস্ত ছিল। আমাদের হাতে প্লেট দিয়ে নাজিয়া বলে, এই পিলত সাহেবরা, এখন ছোলা মুড়ি খান। ওই সব জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এখন বাদ। খাওয়া শেষে আমাদের অনীলা আপু গান গাইবে।

এবার শুরু হয় লাইভ গান। ম্যাপল বনের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দিগন্ত আকাশ। একখণ্ড সাদা মেঘ সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একের পর এক চলে গান। এবার আমার পালা। আমার কণ্ঠে সুর চেপে বসেছে।

‘ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার
মনের মন্দিরে।’

গান শেষে মনে হলো, প্রকৃতির এক মহা উপহার আমার এই জীবন। কতই না সুন্দর এই সব সুন্দরের মাঝে বেঁচে থাকা।
...

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>