আমার বাংলা অভিজ্ঞতা ও ভাবনা

লেখিকা
লেখিকা

আমার নাম ইয়োশিকা। আমি জাপানি। টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিখছি। এখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছ কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে আমি সাধারণত বলি, ‘কোনো বিশেষ কারণ ছিল না, কিন্তু বাংলা নিয়ে কিছু আগ্রহ ছিল। কেননা আসলে বাংলা আমার একদম অপরিচিত। এ ছাড়া, যেখানে বাংলা ভাষা বলা হয় সেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমার বিদেশে কাজ করার ইচ্ছা আছে। তাতে আমি ভেবেছি সংস্কৃতি ও ভাষাটি বুঝলে সুবিধা হবে। সেই জন্যে আমি বাংলা শিখছি।’

এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। আমি মনে করি, প্রথম প্রণোদনার চেয়ে প্রক্রিয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরে বাংলা ক্লাস শুরু হলে ভাষাটি আমার পছন্দ হয়। বাংলা ভাষার অক্ষর দেখতে সুন্দর আর শুনতেও সুন্দর। ব্যাকরণের দিক থেকে জাপানি ভাষার সঙ্গে অনেক মিল আছে। তাই শিখতে সহজ। বাংলা ভাষা সত্যি মিষ্টি ভাষা বলে আমি অনুভব করেছি। কাজেই বাংলা ভাষা পছন্দ করার জন্য অত বেশি সময় আমার লাগেনি।

স্থানীয় শিক্ষকেরা যাঁরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তাঁরা ছাড়া অন্য বাঙালিদের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হলে অনেক গল্প যখন করেছি। তখন আমি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দুই দিন ধরে আন্তর্জাতিক বঙ্গ বিদ্যা সম্মেলন (ISBS) অনুষ্ঠিত হয়েছে আমাদের টোকিও বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রচুর বাঙালি মানুষ এসেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমি উপস্থিত থেকেছি সেই সম্মেলনে। নানারকম ক্ষেত্রের গবেষক আর অধ্যাপকেরা অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। অধিবেশনের ঘরে আমি ছিলাম এবং তাঁদের সাহায্য করেছি। তখন বাঙালিদের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পেয়েছি। ইংরেজি ব্যবহার না করে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেছি। একটু কঠিন লেগেছে, কিন্তু প্রথমবার অনেক বাঙালিদের সঙ্গে বাংলায় অনেক কথা বলে আমি খুবই খুশি হয়েছি, কারণ জাপানে বাঙালিদের সংখ্যা কম। সে জন্যে সাধারণত বাংলা ভাষা একেবারে ব্যবহার করা হয় না এখানে। আইএসবিএসের সম্মেলনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমি দেখেছি বাংলার সুন্দর নাচ আর শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। ভীষণ ভালো লেগেছে। এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আমি আরও পছন্দ করেছি।

তারপর আমার দ্বিতীয় বছরে ভারতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেটা হলো কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় সপ্তাহ ধরে বাংলা ভাষা শেখার বিশেষ কর্মসূচি। এটা ছিল ভারতে ও কলকাতায় আমার প্রথমবার যাওয়া। সেখানে আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম, কারণ ভারত আর জাপান একদম আলাদা। কলকাতা শহরে আমি দেখেছি অনেক মানুষ, গাড়ি, কুকুর, কাক, ময়লা, দোকান ও ইত্যাদি। শহরের অবস্থা ছাড়াও সাংস্কৃতিক তফাৎ নিয়ে বারবার আমাকে অবাক হতে হয়েছে। ক্লাসের পর প্রতিদিন শহরে ঘুরেছি ও প্রচুর মানুষের সঙ্গে দেখা করে বাংলা ভাষায় কথা বলেছি। তখন সব সময় তারা অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘তুমি বাংলা শিখেছ কোথায়?’ তারপর তারা সবাই হেসে খুশি হয়েছেন। আমারও ভালো লেগেছে। আর ওখানে অনেক ভালো বাঙালি বন্ধু হওয়ায় মজার অনেক স্মৃতি জমা হয়েছে। এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমার মনে হয়েছে, আবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে আরও অনেক কিছু শিখতে চাই। সেই জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তৃতীয় বছরে ঠিক করেছি এক বছর ধরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব।

২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হয় আমার নতুন কলকাতা জীবন। এবার লম্বা সময়ের মধ্যে একটি কথা আমি বুঝেছি, যারা কলকাতায় থাকেন তারা বেশি বাংলা ভাষায় কথা বলেন না। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা আর ট্যাক্সিচালক। কারণ তরুণ-তরুণীদের মনে হয় বাংলা ভাষায় কথা বলতে ভালো লাগে না অথবা বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা তারা বেশি পছন্দ করেন। এমন কেউ কেউ ছিল যখন আমি বাংলায় কথা বলেছি তখন শুধু ইংরেজিতে তারা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। অন্যদিকে ট্যাক্সিচালক বেশির ভাগ পশ্চিমবঙ্গের পাশের অন্য রাজ্য থেকে কলকাতায় এসেছেন। তাদের উদ্দেশ্য হলো অর্থ উপার্জন। তাদের ভাষা হিন্দি তাই তারা ব্যবহার করে হিন্দি ভাষা। সে জন্য যখন আমি ট্যাক্সিতে উঠেছি তখন চালকের সঙ্গে যোগাযোগ কঠিন লেগেছে। যেহেতু আমার হিন্দি ভাষা জানা নেই এবং তাদের বাংলা জানা নেই। তবে ভারতের বাঙালিদের হিন্দি ও ইংরেজি জানা আছে বলে তাদের অসুবিধা নেই। এভাবে আমি কলকাতায় ছিলাম অথচ মাঝেমধ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারিনি। এটা আমার দুঃখ ও অসুবিধা। মনে হয়েছে আজ থেকে অনেক দিন পরে একদিন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে। তবে যখন আমি বাংলাদেশে ভ্রমণ করেছি তখন আমি বুঝেছি ওখানে কলকাতার মতো নয়। কারণ বাংলাদেশের বাঙালি সকলের কাছে বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য লড়াই এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে বলে ভাষাটি তাদের কাছে খুবই মূল্যবান। বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আঞ্চলিকভাবে আলাদা, কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। সবকিছুতেই বাংলা ভাষায় লেখা আছে। কাজেই বাংলাদেশ হচ্ছে সোজাসুজি বাংলার দেশ। বাংলা আমার খুবই ভালো লাগে এই কারণে বাংলাদেশও ভালো লেগেছে।

সর্বশেষে যা আমি বলতে চাই তা হলো, বাংলা ভাষা পৃথিবীর মধ্যে সত্যি ভালো, সুন্দর আর মিষ্টি ভাষা। তাই বাঙালিদের তাদের ভাষাটি রক্ষা করা দরকার এবং বাংলা অঞ্চল, মানুষ, ইতিহাস আর সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য নিজের জ্ঞান আমি আরও গভীর করে নিতে চাই।