জীবনের আরেক রূপ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সোহান আজ সন্ধ্যার আগেই ফিরেছে। বাসায় এসেই শাহানাকে অপ্রস্তুতভাবে সোফায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সে ভীষণ অবাক হয়। নিজের গায়ে চিমটি কাটে। একি, স্বপ্ন দেখছি না তো! শাহানা দেশে গিয়েছিল এক মাসের ছুটি নিয়ে। আট দিন পরই রহস্যজনকভাবে লন্ডনে ফিরে সোফায় শুয়ে আছে। বাসার ভেতরে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করে সোহান। আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকে—আরে, কী ব্যাপার! একটা খবর পর্যন্ত না দিয়ে...।

সোফার হাতলে বসে শাহানার মাথায় হাত রাখতেই শাহানা জেগে ওঠে। চোখ দুটো রক্তবর্ণ। অনিদ্রা, অনাহার আর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

: কী ব্যাপার, একটা মেসেজ পর্যন্ত দিলে না। তুমি এভাবে চলে এলে। সবাই ভালো তো?

কোনো কথারই জবাব না দিয়ে শাহানা সোহানকে জড়িয়ে ধরে। অঝোর কান্নায় বেশ কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ।

: কী করছ এসব। এখানে কেবল তুমি আর আমি। কাঁদছ কেন?

: তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। লজ্জায় চুপসে যাচ্ছি। আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেছে।

শাহানার চোখ মুছে দিতে দিতে সোহান বলে, পায়ের নিচের মাটি আগের মতোই আছে। তুমি আর আমি ভালো আছি। সুস্থ আছি। আর কী চাই। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। কী কারণে তোমার মন ভালো নেই তাও হয়তো বুঝতে পারছি। কী আর করা। জীবনে কত কিছুই তো হয়। এসব মেনে নিয়েই তো জীবন।

সোহানকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরে শাহানা বলে, তুমি এত ভালো কেন।

: তুমিও অনেক ভালো। নইলে কী আর ভালো থাকতে পারতাম।

শাহানার এই শিশুসুলভ আচরণ দেখে সোহান মনে মনে হাসে।

এদিকে সোহানের বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শাহানা। দুই চোখ বেয়ে অবিরাম ঝরছে অশ্রু। কিছুতেই আর থামে না যেন।

ইংল্যান্ডে সোহান আর শাহানার সংসার আজ ছয় বছর। সেবার লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার পরপরই শাহানা এ দেশের বাস্তবতা টের পায়। কয়েকটা মাস রেস্ট করো। আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরে দেখব। এমন নানান কথা বলে সোহান। তবে শাহানা এসবের তোয়াক্কা না করে মাস পার হতে না হতেই একটি রিটেইল শপে চাকরি নেয়। দুজনে মিলে দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যাযাবরের মতো কয়েকটা বছর খুব ভালো করে খেটে কিছু পাউন্ড জমাবে। সেগুলো দিয়ে একটি বাড়ি কিনবে। তারপর সংসার জীবন শুরু করবে। এই ছিল তাদের পরিকল্পনা।

তবে এবার শাহানা দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এমনই কিছু কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে। একটা তপ্ত নিশ্বাস গোপন করে শাহানা বলে, আচ্ছা, এভাবে আর কত। পার্সোনাল লোনটার রিপেমেন্ট টানতে টানতে তো আর কূল-কিনারা দেখছি না।

সোহান বলে, কী আর করা। হয় দেউলিয়া হতে হবে। নয়তো শোধ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে টানতে হবে। কত বছর লাগবে কে জানে।

শাহানা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, লোনটা কত বছরের প্যাকেজ ছিল?

: সাত বছরের।

: তার মানে টানা সাত বছর আমাদের এভাবে গাধার খাটুনি খাটতে হবে। তারপর শুরু হবে সেভিংস।

: হুম, এ ছাড়া আর উপায় কী?

পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের লোন! এটা টানতে গিয়ে তাদের আর কোনো সেভিংস হচ্ছে না। মাঝে মাঝে নিয়মিত কিস্তির টাকা শোধ করে কিছু অতিরিক্ত দিতে গেলেই ওই সপ্তাহটা তাদের টানাটানি লেগে যায়। আলুভর্তা, ডাল আর ডিমে কাভার দিতে হয়। একদিন শাহানার মনে খুব শক্তভাবে এক প্রশ্নের উদয় হয়, কেন, কেন আমাকে এত বড় লোন টানতে হচ্ছে। সোহান যদিও মুখ খুলে কিছুই বলছে না। তাই বলে তার এই ভদ্রতাকে সুযোগ হিসেবে নেওয়া কী ভালো দেখায়? আমার জীবনে যদি ছন্দপতন ঘটে, তবে এ দায় কার? নাহ, ফোনে কথাবার্তা অনেক হয়েছে। এবার দেশে গিয়ে মা-বাবা আর বড় ভাইয়ের সামনাসামনি বসে বিষয়টা আলোচনা করব। তা ছাড়া, দেশে আত্মীয়স্বজনকে দেখতেও ইচ্ছে করছে। এমনই কিছু ভেবে সোহানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে শাহানা একাই দেশে যায়।

যদিও সবাইকে জানিয়েই শাহানা দেশে গিয়েছিল, তারপরও এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করতে কেউ আসেনি; যা কল্পনারও অতীত। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে শাহানা বাসায় ফোন দেয়। মায়ের সঙ্গে কথা বলে। মা-মেয়েতে কথা তেমন না হলেও মা ফোনটা কেটে দেওয়ার পর তার মাথাটা কেমন করতে থাকে। সে নিজেই একটা গাড়ি ভাড়া করে। গাড়িতে উঠে শাহানার কেমন যেন ভয় করতে থাকে। এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড ধরে শাহানা বাসায় যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছগুলো নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। একসময় চোখজুড়ানো আবেদন ছিল এই গাছে। দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় গাছগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে শাহানার চোখ দুটো ভিজে যেত। আর আজ! আজ বড় ভয় হচ্ছে। নিবিড় আতঙ্ক।

অবশেষে বাসায় পৌঁছায় শাহানা। কিছু খেয়ে ক্লান্ত দেহখানা পড়ার রুমটায় এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে সে। পড়ার এই রুমে তার অনেক স্মৃতি। তার আগমনে এই জড় কক্ষটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। বহুদিন অবহেলায় পড়ে থাকা বইগুলো চোখ মেলেছে। কী যেন বলতে চায় ওরা।

আশা-নিরাশা, পাওয়া না পাওয়ার টানাপোড়েনে একসময় রাত হয়ে আসে। সবাই বাসায় ফেরে। বাবা আর বড় ভাই কেমন যেন এড়িয়ে চলছেন। শাহানাকে কথা বলার সুযোগই কেউ দিচ্ছে না।

নিজের বাড়িতে পরের মতো এভাবেই শাহানার কেটে যায় চার দিন।

আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা। শাহানার বড় ভাই তপন আর তার দুই বন্ধু মিলে একটা শোরুম কিনবে। তাই হঠাৎ করেই বেশ কিছু টাকার দরকার। ওদিকে ব্যাংকে অ্যাপ্লিকেশনটি ঝুলে আছে। মাস তিনেকের মধ্যেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। তাই ছয় মাসের মধ্যে ফেরত দেওয়ার কথা বলে শাহানার বাবা সোহানের কাছে চেয়ে ষাট লাখ টাকা ধার নেন। মাত্র ছয় মাসেরই তো ব্যাপার। লোনটা হয়ে গেলে হয়তো আরও আগেই টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। বেকারত্বের হতাশায় তপু ভাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে যদি তার জীবনটা সুন্দর হয়। এই ভেবে সোহান আর শাহানা যৌথভাবে পারসোনাল লোন নিয়ে বাবাকে ষাট লাখ টাকা পাঠিয়ে দেয়।

কী এক রহস্যময় কারণে টাকা পাঠানোর পর থেকেই দেশের সঙ্গে শাহানার যোগাযোগ কমে আসে। বাবা আর বড় ভাই সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকেন। মায়ের সঙ্গে কথা হয়। মা কিছুই ঠিকভাবে বলতে পারেন না। এদিকে সোহান আর শাহানার ব্যর্থতাও ক্রমে বাড়তে থাকে। সংগত কারণেই বাড়তে থাকে দূরত্ব।

অবশেষে এই টাকার জের টানতে গিয়ে লন্ডনে তাদের জীবনযুদ্ধের কথাটা বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিতে শাহানা মাকে অনুরোধ করে। শাহানা এও বলে, ‘মা, যদি নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চাও—বছর দুই আমি চাকরি করতে পারব না। ওই চিন্তা করার আগে অবশ্যই লোনটাকে একটা পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। নইলে সোহান একা চাকরি করে কিছুই করতে পারবে না। ব্যাংক আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দেবে যে।’

মেয়ের এই অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে মা খুব অস্থির হয়ে পড়েন। পরদিন বিকেলে কোনো এক সুযোগে শাহানার মা-বাবার মধ্যে এ বিষয়ে কথা হয়। শাহানা পড়ার ঘরে শুয়ে শুনছিল সবই। বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা শেষে একপর্যায়ে বাবা বলেন, আমি কী করব। টাকা এনে তপুরে দিছি। তপু শোরুম কিনছে। বাস কিনছে। সব শেষ করে আবার ইতালি গেছে। সেখানে ধরা পড়ে এক বছর জেল খেটে ফেরত এসেছে। এখন সারা দিন খায় আর ঘুমায়। এখন আমি কী করব। নিজেই পড়ে আছি বিশ লাখ টাকার ঋণে। এখন ষাট লাখ টাকা কোত্থেকে দেব?

মা বলেন, জামাইয়ের তো শিক্ষাদীক্ষা আছে। ভালো মানুষের ছেলে। লজ্জায় কিছু বলছে না। যদি কোনো দিন টাকাটা নিয়ে কিছু বলে, তখন আমার মেয়ে কী জবাব দেবে? আমার মেয়ের কি তখন মানসম্মান বলে কিছু থাকবে? বিদেশের বাড়ি। কী হবে উপায়। শাহানারও তো ভবিষ্যৎ আছে।

মা এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা যে জবাব দেন, সেটা কথা শুনে শাহানার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। আপন ঘরে নিজেকে এত অবাঞ্ছিত দেখতে পেয়ে শাহানা পরের দিনের জন্য বুকিং কনফার্ম করে। ওই দিনই বিকেলে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে এয়ারপোর্টে চলে আসে।

রানওয়ে থেকে ফ্লাই করে ঢাকার আকাশে ওড়ামাত্র শাহানার বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল, আহা আমার বাবা! এ কথা কেমন করে বলল! আমার আর সোহানের জীবন কি তার কাছে এমনই খেলনা?
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>