দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ

ছায়াঘেরা ঘরবাড়ি
ছায়াঘেরা ঘরবাড়ি

দ্বীপ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াতেও রয়েছে আরও অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ। তবে সিডনির খুব কাছেই অতি মনোরম একটা দ্বীপ যে আছে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। সিডনি থেকে মাত্র আধা ঘণ্টা ড্রাইভ করলেই আপনি এমন একটা দ্বীপে পৌঁছে যাবেন। যেখানে গেলে আপনার মনে হবে, আপনি নাগরিক কোলাহল থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত কোনো এক গ্রামে এসে পড়েছেন।

ডাঙ্গার দ্বীপে যাওয়ার ফেরিঘাট
ডাঙ্গার দ্বীপে যাওয়ার ফেরিঘাট

সমারসবি ঝরনা থেকে ফেরার পথে আমরা খুঁজছিলাম এমন একটা জায়গা, যেখানে আমরা দিনের আলোয় বাকি সময়টুকু পার করতে পারি। আমাদের সহযাত্রী ভায়রা রাজীব দাদা ম্যাপ দেখে বললেন, সামনেই একটা ফেরি ঘাট আছে, নাম ব্রুকলিন। চলেন আমরা ওখানে যাই। শ্যালিকা পলি তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, তাহলে ভালোই হয়, ফেরার পথে কিছুটা বিশ্রামও নেওয়া হয়ে যাবে। সেই মোতাবেক আমরা ব্রুকলিন ফেরি ঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। আপনি অবশ্য সিডনি থেকে ট্রেনেও যেতে পারেন। ব্রুকলিন ফেরি ঘাটের সঙ্গেই লাগোয়া হকসবুরি ট্রেন স্টেশন। হকসবুরি নদীর নামে ফেরি ঘাট ও ট্রেন স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে। সময় লাগবে ঘণ্টা দুইয়ের মতো। তবে এই সময়টা আপনি কাটাতে পারেন ট্রেনের জানালা দিয়ে দুই পাশের সবুজের ও নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে।

মেঠো পথ
মেঠো পথ

ট্রেন থেকে নামলেই ফেরি ঘাট। অথবা গাড়ি চালিয়ে গেলেও আপনি রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে কিছুক্ষণ হাঁটলেই পাবেন ফেরি ঘাট। আধঘণ্টা পরপর ডাঙ্গার দ্বীপের উদ্দেশে ফেরি ছেড়ে যায়। ফেরিতে ডাঙ্গার দ্বীপে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র পনেরো মিনিটের মতো। ফেরির ভাড়াও অনেক কম। এই পনেরো মিনিট আপনি হকসবুরি নদীর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখেই পার করে দিতে পারেন। তারপর ঘাটে পৌঁছেই আপনি চলে যাবেন অন্য একটি জগতে। যেখানে কোনো ধরনের গাড়ির শব্দ বা কালো ধোঁয়া নেই। আছে পায়ে হাঁটার জন্য মেঠো পথ। ঘাসের মধ্যে পা ডুবিয়ে আপনি ধীরলয়ে হেঁটে বেড়াতে পারেন যতক্ষণ ইচ্ছে। ডাঙ্গার দ্বীপে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অধিবাসী সর্বসাকল্যে প্রায় তিন শজন। দ্বীপে পা দেওয়া মাত্রই আপনার মনটা শান্ত হয়ে যাবে দ্বীপের ছায়াঘেরা পরিবেশে আর বিভিন্ন প্রকার পাখির কুজনে।

একই গাছে হরেক রকম ধুতরা ফুল
একই গাছে হরেক রকম ধুতরা ফুল

দ্বীপের প্রত্যেক বাড়িই ছায়াঘেরা ও সেখানে আছে পাখির ডাক। গাছের সুশীতল ছায়ায় কাঠের দরজা দেওয়া বাড়িগুলো খুবই মনোরম দেখতে। আপনি হাঁটা শুরু করতে পারেন মেঠো পথে। এ জন্য আগে থেকেই ম্যাপ নিয়ে যেতে পারেন। আর যদি থেকে যেতে চান তাহলে আগে থেকেই থাকার জায়গা বুকিং দিয়ে যাওয়া ভালো। ছুটির মৌসুমে দ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

গাছের গুঁড়ি
গাছের গুঁড়ি

দ্বীপে পৌঁছেই রায়ান ও তাহিয়া ব্যস্ত হয়ে গেল খেলাধুলা নিয়ে। আমরা তাদের নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। কারণ এখানে রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। আছে শুধু দুই চাকার সাইকেল। যেটা দিয়ে দ্বীপের অধিবাসীরা চলাফেরা করেন। আর স্কুলের বাচ্চারা সাইকেলে চালিয়ে ফেরিঘাটে এসে সেখানকার ফেরি ঘাটের বিশ্রামাগারে সাইকেল পার্ক করে ব্রুকলিন চলে যায়। আবার ফেরার পথে সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে ফিরে যায়। ফেরি ঘাটে একটু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলেও সমস্যা হবে না। সেখানে কারণ রাখা আছে অনেক বই। ওখান থেকে আপনি আপনার পছন্দমতো বই নিয়ে পাতা উল্টোতে পারেন।

আঙুর গাছ
আঙুর গাছ

মাটির রাস্তার দুই ধারে সারি সারি বাড়িগুলোতে রয়েছে হরেক রকমের গাছপালা। আমরা একটা বাড়িতে ধুতরা গাছ দেখতে পেলাম, যেখানে একই গাছে তিন রকমের রঙের ধুতরা ফুল ফুটে আছে। আর দেখলাম কচু ও কলার মোচা। এ ছাড়া, বাড়ির সীমানা বেড়ায় রয়েছে আঙুরের গাছ। সেখানে থোকায় থোকায় আঙুর ধরে আছে। দ্বীপে আছে বাচ্চাদের জন্য একটা পার্ক। তাহিয়া, রায়ান আর পলি সেটা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল দোলনা ও স্লাইডিং খেলতে। আমি আর গিন্নি ঘুরে ঘুরে বাড়িগুলো দেখছিলাম আর বাংলাদেশের গ্রামের বাড়িগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে খুঁজে বের করছিলাম। আর রাজীব দাদা ব্যস্ত ছিলেন ছবি তোলা নিয়ে। এভাবে কখন যে আমাদের সময় ফুরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। এবার ফিরতে হবে কারণ পনেরো মিনিট পরে ফেরি ছেড়ে যাবে। আমরা দৌড়ে ফেরির কাছে ফিরে এলাম। তবে মনে মনে পরিকল্পনা করলাম, আমরা আবার ওখানে যাব কয়েক দিন থাকার জন্য।

ফেরি ঘাটে সাইকেল স্ট্যান্ড
ফেরি ঘাটে সাইকেল স্ট্যান্ড

আমাদের ফেরির চালক গ্রিক হাসিখুশি মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। আমি তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। রাজীব দাদা আমাদের ছবি তুলে দিলেন। হকসবুরি নদীর সৌন্দর্যকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে আমি তাঁদের দুজনেরও একটা ছবি তুলে দিলাম। এভাবেই শেষ হলো আমাদের ডাঙ্গার দ্বীপের ঝটিকা অভিযান। কিন্তু এর রেশ নিশ্চিতভাবেই মনের মধ্যে থেকে যাবে বহুদিন। আবারও আমরা যখন ওখানে যাব তখন হয়তো আগেরবারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করব কী কী পরিবর্তন হয়েছে। তত দিনে যেমন আমরা বাংলাদেশে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে আগেরবারের সঙ্গে পরেরবার ভ্রমণের পরিবর্তনগুলো মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
...

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>