বই আর মেলা বইমেলা

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

ফেব্রুয়ারি আমার সবচেয়ে প্রিয় মাস। একে তো শীতের বুড়ি বিদায় হয়ে ফাগুনের মাতাল করা হাওয়ায় ঢাকা হয় আন্দোলিত। এর মাঝে উপরি হিসেবে আছে বইমেলা। অমর একুশের চেতনায় একুশে ফেব্রুয়ারিতে তা উৎকর্ষের সীমা ছাড়ালেও মাসের প্রথম দিন থেকেই স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ আবারও হবে মুখরিত। এই মেলার সঙ্গে আমাদের বেশির ভাগের প্রাণের যে যোগ আছে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমরা যারা নিজেদের তারুণ্যবেলার সবটুকু সময় কাটিয়েছি।

বইমেলা যত এগিয়ে আসছে তত বাড়ছে আমার অস্থিরতা। ছটফট করার আমার ন্যায্য কারণ আছে। প্রথমত, আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ঠিকঠাক মতো বইমেলায় যাব। দুই বছর আগে অবশ্য একদিনের জন্য গিয়েছিলাম। তবে ওটাকে যাওয়া বলে না। তালিকা হাতে ঢুকে বই কিনে দৌড়ে বের হওয়াকে বইমেলায় যাওয়া বলা সম্ভব না। অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসার তাড়া ছিল। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, পাঁচ বছর পর বইমেলায় এবারে আমার দুটি উপন্যাস (নিষিদ্ধ দুপুর ও কফিশপ) আসতে যাচ্ছে। সুতরাং অস্থির হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

দেশের বাইরে আসার পর যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মিস করি, সেটা হচ্ছে বাংলা বই। বই পড়াতো আর বন্ধ করা সম্ভব নয়, তাই ইংরেজি বই পড়ি। ওতে সবই থাকে, দেশের গন্ধ থাকে না। এলো চুলের তরুণীর দীর্ঘশ্বাস অথবা ত্যক্তবিরক্ত কেউ ঢাকার জ্যামে বসে কল্পনার জাল বোনে না। অস্থিরতার তৃতীয় কারণ হচ্ছে, বহুদিন পর হাতভর্তি করে বাংলা বই কেনা হবে এই কল্পনার। তবে হোঁচট খাওয়া ছাড়া গতি নেই, তাই খেলাম।

সামান্য লেখালেখির অভ্যাস থাকায় অনেক লেখকের সঙ্গে অনলাইনে পরিচিত হয়েছি। বইমেলায় তাঁদের অনেকেরই বই আসছে। তাঁরাও আমার মতোই উত্তেজিত। তবে মাঝে মাঝে অনেক দুঃখের কথাও শুনতে পাচ্ছি। দুঃখ বা ক্ষোভের প্রথম কারণ, সৌজন্য কপি চাওয়ার হিড়িক। দ্বিতীয় কারণ, পিডিএফ চাইবার প্রবণতা। আমার এক সিনিয়র ডাক্তার আপুর প্রথম বই বেরিয়েছে। তিনি তাঁর চারপাশের মানুষ নিয়ে হতাশ। সকলেই অভিনন্দন জানাচ্ছে এবং সঙ্গে বলছে, এক কপি দিস, পড়ে ফেরত দেব অথবা সৌজন্য কপিগুলো কই? কিছু গায়ক ক্ষেপে গিয়ে সরাসরি তাদের গান অনলাইনেই মুক্তি দেন। কেন দেন এবারে বুঝতে পারছি।

কারণ জানা নেই, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সৃজনশীলতাকে আমরা মূল্যায়ন করতে পছন্দ করি না কিংবা জানি না। শুধু লেখালেখির ক্ষেত্রে নয়, আমি অনেক গুণী চিত্রশিল্পীকেও এই দুঃখের মাঝ দিয়ে যেতে দেখেছি। মেধা, শ্রম, সময় ও একাগ্রতা দিয়ে দীর্ঘ সময়ে আঁকা ছবির উপযুক্ত মূল্য দিতে নারাজ বেশির ভাগ মানুষ। তবে বিনা মূল্যে তা নেবার আগ্রহের কোনো কমতি দেখা যায় না ছবিটি নিজ নিজ ঘরের দেয়ালে টাঙানোর জন্য। অদ্ভুত বিপরীতমুখী মানসিকতা বটে।

লেখিকা
লেখিকা

আমি মূলত একজন পাঠক, দীর্ঘ অনেক বছর ধরেই পাঠক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাকার টানাটানিতে থাকা পাঠক। সুতরাং ভাববেন না যে টাকার মূল্য আমি বুঝি না। বরং অনেকের চেয়ে একটু বেশিই বুঝি। হঠাৎ করে শূন্য থেকে জীবন অনেকেরই শুরু করতে হয় না। সেটিও বিদেশে প্রথম জেনারেশন হওয়ার কারণে আমার করতে হয়েছে। সুতরাং বিষয়টি টাকার নয়, বিষয়টি মানসিকতার। তবে পাঠক হিসেবে আমি জানি যে, নতুন লেখকদের বই কেনার মতো ভরসা আমরা সব সময় করে উঠতে পারি না। ব্যাপারটি যে খুব অযৌক্তিক, তাও কিন্তু নয়। কেন বলছি তা ব্যাখ্যা করি।

প্রতিবছর বইমেলায় যাওয়ার সময় আমার তালিকায় তিন ধরনের বই থাকত। হিমুর ওপরে লেখা বই (হুমায়ূন আহমেদ), কিশোর উপন্যাস (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) ও অনুবাদ। এই তিন ধরনের বই কিনে হাতে পয়সা থাকলে তবেই অন্য বই। প্রকাশকেরা যে নতুন লেখকদের বই বের করতে দশবার চিন্তা করবেন, সেটা সহজেই বোধগম্য। আগে ব্লগ ছাড়া অন্যদের লেখা পড়ার তেমন সুবিধা ছিল না। ফেসবুক লেখালেখির একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম হওয়ায় এখন বেশ সুবিধা হয়েছে। তারপরেও কীভাবে বুঝব যে, এর লেখা আমার পছন্দ হবে আর ওর লেখা হবে না? কারণ এক হাজারজন একজনের লেখা ভালো বললেও আমার তার লেখা পছন্দ নাও হতে পারে। লেখকের মতো পাঠকের রুচিও ভিন্ন। কেউ কেউ পড়েন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তর্ক করার জন্য, আর কেউ কেউ পড়েন শুধুমাত্র আনন্দ লাভের জন্য। অনেকে আছেন আমার মতো সর্বভুক, কিন্তু তারপরেও অন্তত একটি দুটি খাবার তথা বিষয়ে অরুচি থাকবেই। আমি যেমন রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে কোনো আগ্রহ পাই না। সুতরাং কেউ একজন লিখে পুরস্কার পেলেও সম্ভবত সেই বইটি আমার পড়া হবে না। তাহলে আমি করি কী?

প্রথমত ফেসবুকে বিভিন্ন সাহিত্য গ্রুপ থাকার কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। কারও বইয়ের খবর শেয়ার হলে আমি কেনার তালিকায় তুলি তার লেখা পড়ে। প্রথমেই গ্রুপগুলোর একটিতে গিয়ে সার্চ দিয়ে বের করি, যেই বইটি ছাপা হচ্ছে তার কিছু অংশ অনলাইনে দেওয়া হয়েছে কিনা। দেওয়া হয়ে থাকলে বড্ড সুবিধা। তিন থেকে পাঁচ চ্যাপটার পড়াই যথেষ্ট বোঝার জন্য যে তার লেখা এবং বিষয় আমার রুচিমতো হচ্ছে কী হচ্ছে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমি কী আরও পড়তে আগ্রহী কিনা।

বই কেনার আগে এই রিসার্চের ব্যাপারটি আমি প্রথম টের পেয়েছিলাম গুডরিডস থেকে। দুজন লেখক আমাকে তাদের বইয়ের কিছু অংশ পাঠিয়ে বলেছিলেন, তারা নতুন লেখক ও ফিডব্যাক পেলে কৃতজ্ঞ থাকবেন। একটি লেখা ছিল সায়েন্স ফিকশন। সাত পর্ব পড়ে আমার কালা ঘাম ছুটে গেল। এই বই আমাকে পড়তেই হবে; দরকার হলে এখনই কিনব এমন অবস্থা। বইটি শেষ পর্যন্ত কিনতে পারলাম না, কারণ তারা ইউএস বেসড এবং নতুন লেখক বিধায় অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব নয়। এখনো সেই লেখাটার জন্য বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে খচখচ করে।

আর যদি প্রকাশিতব্য বইয়ের কিছু অংশ না পাই, তবে তার লেখা অন্য কিছু পড়ে বোঝার চেষ্টা করি যদি সময় থাকে। যেহেতু আমি মোটামুটি ব্যস্ত একজন মানুষ, সেহেতু প্রায়শই সরাসরি ফেসবুকে সেই লেখকের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে দিই যে, তার বইয়ের কিছু চ্যাপটার অনলাইনে দেওয়া আছে কিনা, পড়তে আগ্রহী। মেসেজ যদি দেখা হয়, তবে কোনো লেখকই তাতে না বলেন না, যদি অনলাইনে দেওয়া থাকে। কারণ লেখক হওয়ার আগে প্রতিটি মানুষকে আগে হতে হয় পাঠক। যত বই পড়া যাবে, তত মাথা খুলবে। একজন পাঠক যদি পাঠকের মন না বোঝেন, তাহলে বুঝবেন কে?

তারপরেও আমি বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র একপক্ষের পরিবর্তনে সামগ্রিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অনেকেই এখন মোবাইলে বা ট্যাবে বই পড়তে পছন্দ করেন বেশি। আবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক ছাত্র বই কিনতে পারে না বাজেটের কারণে। নিজের উদাহরণই দিই। বই কেনাটা পড়ার মতোই আমার কাছে নেশা। নেশাগ্রস্ত মানুষ পৃথিবীর যেখানেই যাক না কেন, তারা নেশার জিনিস খুঁজে বেড়াবে সেটিই স্বাভাবিক। আপনারা যারা বাইরে থাকেন, তারা জানেন, নতুন হার্ড কভারের বই ত্রিশ-চল্লিশ ডলারের কমে পাওয়া যায় না। আমি এমনও সময় কাটিয়েছি যখন চল্লিশ ডলার একটা বইয়ের পেছনে দিলে কয়েকদিন খাওয়ায় টান পড়বে। স্বভাবতই সব সময় আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি সব নতুন বই হার্ড কভারের কেনার। আমি তখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতাম তিন-চার মাস, কারণ তারপরেই পেপারব্যাক বের হয়। পেপারব্যাকে দামটা কমে পনেরো থেকে বিশ ডলারের মাঝে চলে আসে। সকল গোত্রের পাঠকদের জন্যই ব্যবস্থা বাইরের প্রকাশনীগুলো করে। পাঠকরাই বইয়ের প্রাণ, তাদের কাছে সহজে বই পৌঁছাতে না পারলে চলবে কী করে?

আমি আশায় আছি সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন আমরাও হার্ড কভারের পাশাপাশি পেপারব্যাক ও ই-বুক হিসেবে বই প্রকাশ করতে পারব। একটি বই কেনার জায়গায় একজন ছাত্র হাসিমুখে চারটি বই কিনে ঘরে ফিরবে। বাসে-ট্রেনে সর্বত্র মোবাইলে গেমস খেলার পরিবর্তে তারা এসব ডিভাইসে বই পড়বে। আমার মতো কিছু মানুষ তাদের পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে হার্ড কভারের বইয়ে ডুবে থাকবে। এক ফাঁকে কৌতূহল নিয়ে শুধাবে, ‘আচ্ছা আপনি কী বই পড়ছেন বলুন তো?’ ভ্যাপসা গরমের ক্লান্তিকর দৈনন্দিন যাত্রায় সেই কথোপকথন শীতল বাতাসের পরশ বোলাবে।

গভীর আগ্রহ নিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রতীক্ষায় আছি। আবার সেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ...ঝকঝকে বই আর বন্ধুরা...আহ, ভাবতেও আনন্দ।
...

সামারা তিন্নি: চিকিৎসক।