বান্ধবী বনাম বউ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রান্নাঘরে ঢুকে স্ত্রীকে রোমান্টিক সুরে প্রশ্ন করলাম, জান, কী কর?

: নাচতেছি।

: কী বল, আমি তো দেখছি তুমি রান্না করছ।

: তুমি যখন দেখছ আমি রান্না করছি, তাহলে আজাইরা প্রশ্ন কর কেন? ঝাঁজের সঙ্গে বলল।

: না মানে, স্ত্রীর খোঁজ খবর নেওয়া তো স্বামীর নৈতিক দায়িত্ব, তাই।

: তাই? কিন্তু তুমি তো এখন দায়িত্ব পালন করতে আসো নাই। তুমি আসছ তোমার ইফতারিগুলো ঠিকমতো বানানো হচ্ছে কি না, তার খোঁজ নিতে।

: ছি, তুমি আমারে ভুল বুঝলা! মনে বড়ই আঘাত পাইলাম।

: ঢং করবা না। শোনো রোজা রেখে প্রতিদিন তোমার হাজার পদের ইফতারি আমি বানাতে পারব না।

: কী যে বল। রোজার মাসে যদি একটু বেশি বেশি না খাই তাহলে কী হয়।

: তা তো অবশ্যই। সবাই রোজা রাখে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর তুমি রোজা রাখ ইফতারি খাবার লোভে।

: আফসোস। স্বামীরে এভাবে খাবারের খোঁটা দিলা।

: না, এটা খোঁটা না। যা সত্য তাই বলছি। রোজা মানে সংযম। আর তোমার? আমি নিশ্চিত তুমি মেপে দেখ তোমার ওজন গত দশ দিনের রোজায় তিন চার কেজি হলেও বাড়ছে।

: এ কী বললা। তাড়াতাড়ি আমার গায়ে একটু থুতু দাও। না হলে নজর লাগবে।

: থু।

: এটা কী করলা? সত্যি সত্যি থুতু দিলা!

: তুমিই তো বললা।

: আফসোস।

: শোনো ঢং করবা না। আমার সহজ কথা আমি রোজা রেখে রোজ রোজ এত রান্নাবাড়া করতে পারব না। একা একা এত কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি মাফ চাই।

: আমি জানি একা একা সংসারের সব কাজ করা কষ্টকর। তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

: তুমি আমাকে কাজে সাহায্য করবে! তুমি! তোমার মতো অলস মানুষ আমাকে সাহায্য করবে? আমাকে তাও বিশ্বাস করতে বল?

: আরে না। আমি তোমাকে সাহায্য করব কীভাবে। আমি কী রান্না পারি? আমি বরং তোমাকে এ কষ্ট থেকে মুক্তির পরামর্শ দিতে পারি।

: তাই! বল শুনি, তোমার পরামর্শ।

: দেখ এখন যদি আমার দু–একটা বাড়তি সাহায্যকারী থাকত, তাহলে তোমার কী এত কষ্ট করতে হতো, তুমিই বল? একজনে রান্না করত, একজনে কাপড়চোপড় ধুতো, একজনে ঘর পরিষ্কার করত। খেয়াল করে দেখ উপকার কিন্তু তোমারই হতো। আমার হয়তো একটু খরচ বাড়ত। তবে সেটা কোনো ব্যাপার না। কারণ তুমি আমার স্ত্রী, তোমার জন্য এ কষ্টটুকু আমাকে মেনে নিতেই হবে, ঠিক না?

কথা শেষ করতে পারলাম না। দেখলাম গরম খনতি হাতে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম অবস্থা সুবিধার না। এ মহিলার পক্ষে সবই সম্ভব। একটু আগেই থুতু দিয়েছে। অতএব এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়, দিলাম দৌড়।

পেছন থেকে স্ত্রী চিৎকার করে বলছে, তোর আবার বিয়ে করার শখ হইছে সেটা বললেই তো পারিস। 

ভয়ে বেড রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। হঠাৎ মনে পড়ল যে কথা বলার জন্য রান্নাঘর গিয়েছিলাম তাই তো বলা হয়নি। একটু পর সাহস সঞ্চয় করে আবার রান্নাঘরে গেলাম। উঁকি দিয়ে দেখলাম রান্নায় ব্যস্ত। রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললাম।

: জান, যদি অনুমতি দাও, একটা কথা বলতাম।

: অনুমতি দিলাম না।

: শোনো গণতন্ত্র বলেও তো একটা কথা আছে। কথা বলতে দেওয়া উচিত। রাখা না রাখা সেটা অন্য ব্যাপার।

: আমি এখন খুবই ব্যস্ত। ইফতারির প্রায় সময় হয়ে গেছে। এখনো রান্না শেষ করতে পারিনি। ঢং না করে কী বলবা বলে বিদায় হও।

: না মানে বলছিলাম কী, আমি জানি অনেক কিছু রান্না করছ। তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।

: ভণিতা রেখে মূল পয়েন্টে আসো।

: একটু কী ভর্তা বানানো যাবে?

দেখলাম কাজ বন্ধ করে আমার দিকে হতাশ ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়ে বলে উঠলাম, না না বানাতে হবে না। এমনিই বললাম। সরি আমার ভুল হয়ে গেছে। এত তরকারি থাকতে তো ভর্তা লাগার কথা না।

তারপর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

আসলে ছোটবেলা থেকেই ভর্তা আমার খুবই প্রিয়। যে কারণে বউকে প্রায় জ্বালাতন করি। অনেক অনুরোধ করার পর মাঝে মাঝে বানিয়ে দেয়। ছাত্র জীবনে এফ রহমান হলে থাকার সময় বান্ধবী নিতুকে বলতাম ভর্তা বানিয়ে দিতে। ও থাকত রোকেয়া হলে। প্রায় সময় বিভিন্ন রকমের ভর্তা বানিয়ে দিত। জানি না হলে কীভাবে বানাত। কিন্তু সে ভর্তা ছিল অমৃত। হলের রুমমেটদের ভাগ দেওয়ার ভয়ে অনেক কৌশলে সে ভর্তা লুকিয়ে খেতাম। নিতুর হাতের বানানো সেই ভর্তার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।

ভেবেছিলাম এত রান্নার পর আজ আর ভর্তা বানাবে না। কিন্তু রাগারাগি করলেও বউ ঠিকই ভর্তা বানিয়ে দিল। তারাবির নামাজের পর খুব আগ্রহ নিয়ে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে বসলাম। কিন্তু ভর্তা দিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই বুঝলাম এ জিনিস খাওয়া যাবে না।

: এটা কী বানাইছ?

: কেন? ভর্তা।

: এটাকে ভর্তা বলে!

: মানে কী?

: মানে এটাতো ভর্তার ভও হয় নাই।

: ভ হউক আর ব হউক, কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়।

: না, এই মাল তো আমি খাব না।

: খাবে না মানে? অবশ্যই খাবে।

: মানে কী? ভালো না হলেও এই জিনিস আমাকে খেতে হবে? তুমি কী আমাকে জোর করে খাওয়াবে।

: দরকার হলে জোর করেই খাওয়াব। রোজার মধ্যে অনেক কষ্ট করে বানাইছি। ফেলে দেওয়ার জন্য বানাইনি।

: তোমাকে কষ্ট করে কে বানাতে বলেছে? কষ্ট করে না বানায়ে যদি একটু দরদ দিয়ে বানাতে তাইলেই তো ভর্তাটা অমৃত হতো।

: আমার কাছে অত আজাইরা দরদ নাই। আমি অমৃত বানাতে পারি না। যে পারে তার কাছে যাও।

বউ এর কথায় হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, আফসোস। সেই হারানো দিনগুলি যদি আবার ফিরে পেতাম।

: তাই নাকি! কোন দিনগুলি? বউ টিটকারির সুরে প্রশ্ন করে।

: ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলি। আহ কী ছিল সেই সব দিন। হলে থাকতে নিতু ভর্তা বানায়ে দিত। নিতুর হাতের বানানো সে ভর্তার কথা মনে হলে এখনো জিভে পানি এসে যায়। সেগুলো তো ভর্তা ছিল না, ছিল অমৃত।

: তাই নাকি? শোনো ছেলেদের কাছে প্রেমিকার হাতের গোবরও অমৃত মনে হয়। আর বউয়ের হাতের অমৃত মনে হয় ছাগলের লেদা।

: এগুলো কী বলো?

: যা সত্য তাই বলি। প্রেমিকা যদি মুখের সামনে ঘাস ধরে ছেলেরা তৃপ্তি নিয়ে তাও খেয়ে ফেলবে।

: তার কারণ কী জানো? তার কারণ প্রেমিকার মনে থাকে মধু আর মধু। সেই মধুর ছোঁয়ায় ঘাসও অমৃত হয়ে যায়। আর স্ত্রীর মনে থাকে গরম ইস্তিরি। সেই ইস্তিরির ছ্যাঁকায় সব জ্বলে পুড়ে যায়।

: এত বুঝলে বিয়ে করছ কেন?

: ওইটাইতো ভুল করছিলে মা। আগে জানলে বিয়েই করতাম না।

: এই তুমি ওঠ তো, তোমার ভাত খেতে হবে না।

: মানে কী?

: মানে আমার অন্তরে যেহেতু মধু নাই, তাই আমার রান্না তোমার খাওয়ার দরকার নাই। তোমার জন্য আমি আর রান্না করব না।

: স্বামীরে না খাওয়ায় রাইখ না। স্বামীর সেবা কর, পরকালে এর প্রতিদান পাবা।

: গুল্লি মারি। তুই ওঠ খাবার টেবিল থেকে। খাওয়া বন্ধ।

টান দিয়ে খাবার প্লেটটা সামনে থেকে নিয়ে খাবারগুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিল। তারপর হনহনিয়ে বেডরুমে চলে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে বোকার মতো বসে রইলাম।

চিন্তা করে দেখলাম রোজার মাসে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। তাহলে না খেয়েই রোজা রাখতে হবে। তার চেয়ে বরং পরিবেশটা হালকা করে ফেলি। মিনিট বিশেক পরে বেডরুমে গিয়ে মিষ্টি গলায় বললাম, জান, কী কর?

: ফুটবল খেলি।

: মিথ্যে বলছ কেন? তুমি তো শুয়ে আছ।

: এই তোমারে না বলেছি আমারে আজাইরা প্রশ্ন করবা না।

: জান, কাল কিন্তু ২৩ মে।

: তো?

: কাল কিন্তু আমাদের বিবাহ বার্ষিকী।

: তো?

: তো তো কর না। দুনিয়ার সবাই বিয়ে বার্ষিকীতে ভালো মন্দ খায়। অথচ এই দিনে তোমার স্বামী না খেয়ে রোজা রাখবে। এটা কেমন কথা?

: না খেয়ে থাকবে কেন? যাও নিজে রান্না করে খাও।

: আমি জানি এটা তোমার রাগের কথা। আসলে আমারই ভুল হয়েছে। ভর্তাটা কিন্তু ততটা খারাপ ছিল না। আসলে কী জান, সব সমস্যা আমার এই জিহ্বার। আচ্ছা জিহ্বা কী পরিবর্তন করা যায়? তোমার জানাশোনা কোনো ডাক্তার আছে যে জিহ্বা ট্রান্সপ্লান্ট করে।

: তুমি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছ?

: না আমি সিরিয়াস। এই মাত্র ডিসিশন নিলাম ফিক্সড ডিপোজিটটা ভাঙিয়ে বিদেশে গিয়ে জিহ্বা ট্রান্সপ্লান্ট করিয়ে আনব। ভাবছি ছাগলের জিহ্বা লাগাব। দেখ না ছাগল যা পায় তাই খায়। তুমি কী বল? আইডিয়াটা দারুণ না।

: অবশ্যই দারুণ। তা লাগাবে যখন, তখন ছাগলেরটা লাগাবে কেন? কুকুরেরটা লাগাও।

: এভাবে বলছ কেন? তোমার ব্রেন ভালো। তাই তোমার কাছে একটা পরামর্শ চাইছি।

: ন্যাকামি করবে না। যতই তেল মার না কেন, আজ আর তোমার কপালে ভাত নাই। তার চেয়ে বরং সেহেরির সময় একটা নুডলস রান্না করে খেয়ো।

আর কথা বাড়ালাম না। মনে কষ্ট নিয়ে শুয়ে পড়লাম। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে খাবার টেবিলে যেয়ে দেখি বউ আর আমার পিচ্চি দুই মেয়ে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে।

: তা শেষ পর্যন্ত কী আমাকে নুডলসই খেতে হবে? ভাত কি আসলেই দিবা না? বউ কে প্রশ্ন করলাম।

: শোনো তোমার এই জিহ্বায় আমার রান্না ভালো লাগবে না। তুমি না বললে জিহ্বা ট্রান্সপ্লান্ট করাবে। আগে সেটা করো তারপরে আমার রান্না খেয়ো। আপাতত নুডলস দিয়ে কাজ চালাও।

বউ হেসে উত্তর দিল। মেয়েরাও মিটিমিটি হাসছে।

: কী আর করা! ভাত যখন দিবাই না, তাইলে নুডলসই খাই।

: হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। এখন খেতে বসো।

বউ মিষ্টি ধমক দিয়ে বলল। দেরি না করে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বউ উঠে রান্নাঘরে গেল। ছোট মেয়ে বলল, চোখ বন্ধ করতে। চোখ বন্ধ করলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখি সামনে বিশাল এক প্লেট। প্লেটের মাঝখানে মোমবাতি জ্বলছে, আর চারদিকে সুন্দর করে ভাগে ভাগে সাজানো কয়েক পদের ভর্তা।

: এত ভর্তা কোথায় পেলে?

: আম্মু বানিয়েছে। মেয়ে বলল

: না, নিরব হোটেল থেকে কিনে আনছি। বউ হেসে উত্তর দিল।

: কাজটা ভালো করোনি। নিরব থেকে আনলে কেন? বন্ধু ইয়াসিফের ভর্তা বাড়ি হোটেল থেকে আনতে। তাহলে ওর ও কিছুটা ব্যবসা হতো।

হেসে উত্তর দিলাম। বউও হেসে উঠল।

আব্বু এটা নাও। বলে ছোট মেয়েটি একটি খাম হাতে দিল। যত্ন নিয়ে খামটা খুললাম। বউয়ের লেখা চিঠি। তাতে লেখা, তুমি আমাকে আর কত জ্বালাবে? প্রতিদিন ভর্তা ভর্তা করো জ্বালাও, তাই ইচ্ছে করেই সন্ধ্যায় ভর্তাটা পঁচা বানিয়েছিলাম। আমি তোমার জন্য যখন যা বানাই প্রেমিকার মতো ভালোবাসা দিয়েই বানাই। স্বামী-স্ত্রী তো সবাই হয়। আমরা না হয় বন্ধু হয়েই থাকলাম। শুভ বিবাহ বার্ষিকী।

সময় নিয়ে ধীরে ধীরে চিঠিটি পড়লাম। চোখের কোণায় কী জল ছিল, জানি না। হঠাৎ বড় মেয়ে বলে উঠল, বাবা তুমি কি কাঁদছ?

: আরে না। তোমার আম্মু সম্ভবত ভর্তায় প্রচুর পেঁয়াজ দিয়েছে। ওর ঝাঁজে চোখ জ্বলছে।

দেখলাম দুই মেয়ে মিটিমিটি হাসছে। ছোট মেয়ে হাতে ছুরি দিয়ে বলল, থাক আর কাঁদতে হবে না। তুমি এখন ভর্তা কাটো।

ফুঁ দিয়ে বউ আর আমি মোমবাতি নেভালাম। এক সাথে ছুরি দিয়ে ভর্তা কাটলাম। তখন আমাদের দুই পাশে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল আমাদের দুই রাজকন্যা। সে এক অপার্থিব অনুভূতি। আচ্ছা পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন?

বি. দ্রষ্টব্য: ঝগড়া করতে করতেই অনেকগুলো দিন এক সাথে কাটিয়ে দিলাম। ভাবছি বাকি জীবনটাও এমনই ঝগড়া করে কাটিয়ে দেব। তবে সমস্যা হচ্ছে মেয়ে দুটো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। ওদের কারণে এখন আর প্রাণ ভরে ঝগড়া করতে পারি না। আফসোস।

বি. দ্রষ্টব্যের বিশেষ দ্রষ্টব্য: ও একটি কথা, বন্ধু নিতু আর আমার বউ কিন্তু একজনই। অন্য কাউকে যেন ভর্তা বানিয়ে খাওয়াতে না পারে তাই বন্ধু নিতুকেই বিয়ে করে ফেলেছিলাম।

ইমদাদ বাবু: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>