আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুলে বই উৎসব

বই হাতে শিক্ষার্থীরা
বই হাতে শিক্ষার্থীরা

নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে ওরা ফুলের মতো ফুটেছে। গল্প নয়, এটা সত্যি ঘটনা। যারা সেদিন ওখানে ছিল তারা সবাই দেখেছেন এ দৃশ্য। হ্যাঁ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুলের কথাই বলছি। অডিটোরিয়ামকে সেদিন ফুলের বাগান মনে হয়েছিল। এখানে ছোটরা বই পাওয়ার আনন্দে ছোটাছুটি করেছে। মঞ্চ থেকে মেলে ধরেছে সে বইটি। দেখিয়েছে দর্শকদের। গত ৭ জানুয়ারির এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। তিনি বক্তব্যে ছোটদের উদ্দেশে তাঁর ভালোবাসা ঢেলে দেন। বলেন, বড় সৌভাগ্য, বিনা মূল্যে তোমাদের হাতে একগাদা বই এল নতুন বছরে।

যায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা বিভাগের ড. অধ্যাপক হাবিব উল হক খন্দকার তাঁর ছাত্রজীবনের চিত্র তুলে ধরেন। বলেন, সেই সময়ে পুরোনো বই সংগ্রহ করে পড়তে হতো। এখন এ এক অপূর্ব সুযোগ পড়ার জন্য। বিশ্ব ব্যাংকের বড় অর্থনীতিবিদ, দেশ ও জাতির সেবার লক্ষ্যে ডাক্তার-প্রকৌশলী হওয়ার জন্য এ বই দারুণ কাজে আসবে। তিনি ছোটদের তাকান আর হাসেন।

বই হাতে শিক্ষার্থীরা
বই হাতে শিক্ষার্থীরা

স্বাগত বক্তব্য দেন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। তিনি বই বিতরণের অবারিত আনন্দ প্রকাশ করেন। শেক্‌সপিয়ারের নাম উল্লেখ করেন। বলেন, শিক্ষার্থীরা বই হাতে আজ আলোর পথিক। কাব্যময় হয়ে ওঠে সময়টা। সেই অনুভূতির ই প্রকাশ-তোমার তুলনা কী গ্রীষ্মের সমুজ্জ্বল দিন!

ফিতায় বাঁধা বইয়ের সেট আসে ছোটদের হাতে। নতুন বই পেয়ে তারা উচ্ছ্বসিত। বছরের শুরুতে শীতের পরশ মাখা স্নিগ্ধ সকালে এ ছিল এক অনবদ্য উপহার। বর্ণমালার গরব নিয়ে তখন তাদের আকাশ জোড়া আনন্দ।

সঞ্চালক বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের এই হাসির স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজ সেই বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছি আমরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আবু তাহের।

বই বিতরণ
বই বিতরণ

শিক্ষা লাভে অনন্য অভিজ্ঞতা ভাস্বর জনের! অতিথিরা নতুন বছরে তাঁদের ছাত্রজীবনের চিত্র তুলে ধরেন। একই ক্লাসে দুই সহোদর। এক সেট বই। পড়া শেষে প্রথমজন ছাড়লেই কেবল দ্বিতীয়জনের পড়ার সুযোগ হতো। এক অতিথির গল্প। তাঁরা চার ভাই এক বোন। তিনি ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয়। আগের দুজনের রেখে যাওয়া বই পড়তেন। এ শুধু তাঁর একার বেলায় বিষয়টি ঘটেছে তা নয়, বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই।

তাইতো অতিথি বলেন, পরম পাওয়া এ বই। এ জন্য এসব তাক বা আলমারিতে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। এ বই পড়ার, এ থেকে জ্ঞান অর্জন হবে মূল লক্ষ্য। তাঁরা আশা করেন, এর মর্মবাণী উপলব্ধি করে শিশুরা গড়ে উঠবে দেশ ও জাতির আকাঙ্ক্ষার সমান।

টানা দশ বছর বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে এ বই। প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীদের জন্য এবার ৩৫ কোটি বই দেওয়া হলো। দেশে শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিনেই এসব পেয়ে গেছে। বাইরে আসতে কেবল সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ দেরি হয়েছে। শতভাগ বই পৌঁছে গেছে এখন। কোটি কোটি বই ছাপানো এবং যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়া কম কথা নয়! এক কথায় বলতে হয়, এ এক মহাযজ্ঞ।

শিক্ষার্থীদের একাংশ
শিক্ষার্থীদের একাংশ

সর্বস্তরের শিশুদের হাতে চলে গেছে এ বই। নিজেদের ভাষায় এবারও বই পাচ্ছে পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। চাকমা, মারমা, মাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে তাই ব্যাপক আলোড়ন! আনন্দিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা! এর আগে অনেকের পড়ার আগ্রহ থাকলেও বই জোগাড় করা সম্ভব হতো না। এখন আর সে সমস্যা নেই।

ভালো মানের কাগজের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এখন। নবম-দশম শ্রেণির সুখপাঠ্য বইগুলো দামি কাগজে রঙিন ছবিসহ ছাপা হয়েছে। শিশুরা আনন্দে আনন্দে পড়বে এসব বই। নিমতলায় সমবেত হয়েছে তারা। জেবুন্নিসা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অনেকগুলো বই তার হাতে। চকচকে হাসি তার। দেখা হয় পঞ্চম শ্রেণির আবিদার সঙ্গে। বুঝলাম, খুশির আরেক নাম নতুন বই। বিবি কুলসুম অষ্টম মানে উঠল। বলল নতুন বই মানেই ভালো লাগা। তৃতীয় শ্রেণির আনিকা। সে দেখলাম খুশিতে আটখানা। আয়েশা সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে। ও দেখাল ওর প্রিয় বই। উল্টে উল্টে আমিও দেখি ওরই মধ্যে ওর পছন্দের ছবি।

মঞ্চ থেকে নামলেন অতিথিরা। নামলেন অন্যরা। শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে ভরে উঠল।

শহীদ মিনারের সামনে লেখকসহ অতিথিরা
শহীদ মিনারের সামনে লেখকসহ অতিথিরা

এরপর ভাস্বর জনেরা এলেন শহীদ মিনারের পাদদেশে। দুবাই থেকে এসেছেন ছড়াকার লুৎফুর রহমান। তাঁর লেখা ও নৃত্যশিল্পী তিশা সেনের আঁকা ছবি নিয়ে প্রকাশিত বই দিলেন প্রধান অতিথির হাতে। ক্যামেরা জ্বলে উঠল।

এরপর এমন খণ্ড অনুষ্ঠান হয় অধ্যক্ষের কার্যালয়ে।

সেখানে বন্ধুর আলাপ হয়। ড. হাবিব কথা বলেন লেখালেখি নিয়ে। তিশার সঙ্গে তাঁর মা বাবা। অন্যরাও প্রসঙ্গ জুড়ে দেন। সময় কাটে চা আর গল্পের আনন্দে। বিদায়ের বিউগল বেজে ওঠে।

অধ্যক্ষের কক্ষে কয়েকজন
অধ্যক্ষের কক্ষে কয়েকজন

আর থাকা নয়। অগত্যা উঠতে হয় গাড়িতে। গান বাজে, ‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটব, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশ জুড়ে উঠব।’

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন রথের সারথি নিয়োগ করেন তাঁর মিত্র কৃষ্ণকে। এখানে সেই দায়িত্বে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো এই আমি। অন্য গাড়িতে দুবাইয়ের ওঁরা। আমাদের অনুসরণ করছেন। কারণ এরপর আমরা আমাদের ছোট্ট কুটিরে এক হব। মীর আনিসুল হাসান শেক্‌সপিয়ার আর বই নিয়ে কথা বলেন, আমি শুনি। গাড়ি চলতে থাকে।