বৈচিত্র্যময় কাব্যের শহর সান অ্যান্তনিও

সান অ্যান্তনিও রিভার ওয়াকে লেখিকা
সান অ্যান্তনিও রিভার ওয়াকে লেখিকা

শীত এসেছে সাড়ম্বরে এখানে। পুরো ডালাস জুড়ে হিম হিম শীতের রাজত্ব চলছে। ভেবেছিলাম বাচ্চাদের ছুটির দিনগুলো শুধু কাঁথামুড়ি দিয়ে পার করে দেব। তা কিন্তু হলো না এবার। ভ্যাকেশন মানে তারা ঘুরতে যাবে দূরে কোথাও, এই বলে দিন রাত দাবি জানাতে থাকল তাদের পক্ষ থেকে।

এই আবদারে অস্থির হয়ে একদিন সকাল সকাল কুয়াশার চাদরে ডুবে থাকা ডালাস শহর থেকে যাত্রা শুরু করি সান অ্যান্তোনিওর উদ্দেশে। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ২৯৩ মাইল দক্ষিণে মেক্সিকো সীমান্তের কাছাকাছি এই শহরটি অবস্থান।

হাইওয়ে সাউথ ৩৫ ধরে ডালাস ছাড়িয়ে অস্টিন হয়ে যাচ্ছি সান অ্যান্তোনিওর পথে। চারদিকে ঝলমলে রোদ্দুর আর সবুজে ছাওয়া সমতলভূমি।

দুপুরে লাঞ্চ সেরে নিলাম সান অ্যান্তোনিওর সবচেয়ে জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট সান অ্যান্তোনিও রিভারওয়াক দেখতে দেখতে।

প্রথম দেখাতেই আমার মনে হলো, এক টুকরো ইতালির গ্র্যান্ড ক্যানাল যেন দেখছি।

ঐতিহাসিক দ্য আলামোর সামনে সন্তানের সঙ্গে লেখিকা
ঐতিহাসিক দ্য আলামোর সামনে সন্তানের সঙ্গে লেখিকা

সান অ্যান্তোনিও নদীর তীর ঘেঁষে তৈরি এই পাথুরে পায়ে হেঁটে চলার পথ। যার তীরে রয়েছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ, অফিস, গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, স্থানীয় শিল্পীদের আর্টওয়ার্ক ও আরও অনেক কিছু।

অনেকখানি হেঁটে দেখার পর, বোটে করে পুরোটা ঘুরে দেখলাম।

অবাক লেগেছিল, সেদিন বেশির ভাগ দর্শনার্থীরা লাল রঙের টি শার্ট পরে ঘোরাঘুরি করছিলেন। কারও কারও গায়ে লেখাও ছিল আইওয়া স্টেট।

বছরের শেষ আলামো বোল ফাইনালে আইওয়া স্টেট ও ওয়াশিংটন স্টেট খেলবে। তাই সমর্থকেরা জড়ো হয়েছেন এখানে সবাই।

সান অ্যান্তোনিও ডাউন টাউনটা দেখার মতোই, প্রচুর মানুষ আর দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই আছে। এত ভিড়ের মাঝেও দেখতে গেলাম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত ‘দ্য আলামো’। বহু শতাব্দী ধরে যা টেক্সাস বিপ্লবের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

পরদিন সকালটা ছিল বেশ ঝরঝরে। ডালাসের তীব্র শীতের কোনো দেখাই নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়ে বের হলাম ন্যাচারাল ওয়াইল্ড লাইফ রেঞ্জের উদ্দেশে।

ন্যাচারাল ব্রিজ ক্যাভারান
ন্যাচারাল ব্রিজ ক্যাভারান

এই ট্যুরে বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল টেক্সাস স্টাইলে আফ্রিকান সাফারি। ন্যাচারাল ওয়াইল্ড লাইফ রেঞ্জের ৪০০ একর এলাকাজুড়ে রয়েছে এই সাফারির সীমানা।

নিজস্ব গাড়ি করে ট্রেইল ধরে যাচ্ছিলাম আমরা। সাফারির সব প্রাণীদের জন্য কিনে নেওয়া খাবার ছিল আমাদের হাতে। একটু পরপর একেকটা প্রাণী দেখে আর বাচ্চার প্রচণ্ড উৎসাহে ছড়িয়ে দিতে থাকে খাবারগুলো।

দুপুরের খাবার সেরে দেখতে গেলাম ন্যাচারাল ব্রিজ ক্যাভারান। প্রাকৃতিক চুনা পাথরের গুহা। ভেতরে ঢুকতেই কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। সরু, অন্ধকার আর পিচ্ছিল পথ দিয়ে এগিয়ে যাই আমরা। গুহার ভেতরে কেমন যেন ভ্যাপসা গরম। চুনাপাথরের গা বেয়ে মাঝে মাঝে গড়িয়ে পড়ছে আগের রাতে হওয়া বৃষ্টির পানি।

মাঝে মাঝে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বহু বছর ধরে জমে থাকা চুনাপাথরের স্তম্ভগুলো যেন এক একটা শিল্পীর নিজের হাতের তৈরি করা ভাস্কর্যের রূপ নিয়েছে। আলো-আঁধারির অপূর্ব খেলা চুনাপাথরের দেয়ালজুড়ে।

কতক্ষণ হাঁটলাম জানি না। পুরোটা পথ যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইলাম।

সারা দিন ঘোরাঘুরি করে সবাই ছিলাম ভীষণ ক্লান্ত। ডিনার সেরে সন্ধ্যাবেলায় হোটেলে ফিরে এলাম। বাচ্চারা ডিজনি চ্যানেলে মুভি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ঘণ্টা দুই পর আমি একা বের হলাম কফি নেওয়ার উদ্দেশে। ভাবলাম রাতের শহরটাও একটু দেখে নেওয়া যাক।

সান অ্যান্তনিও রিভার ওয়াক
সান অ্যান্তনিও রিভার ওয়াক

কফি হাতে নিয়ে বাইরে বের হলে দেখতে পাই সান অ্যান্তনিওর রাতের শহর। আলো ঝলমলে চারদিকে। টুরিস্টদের ভিড় লেগেই আছে। কেউ হাঁটছেন, কেউবা গল্প করছেন।

কোজাগরী পূর্ণিমা শেষে আকাশে তখনো আধখানা চাঁদ ঝুলে আছে। মিষ্টি শীতের বাতাস বইছিল অবিরাম।

এই রাতেও দেখি দ্য-আলামোর সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই ছবি তুলছেন। মেক্সিকান হ্যাট পরে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন গাড়োয়ান। যদি কোনো দর্শনার্থী এখনো চড়তে চান।

একটু হেঁটে রিভারওয়াকের কাছাকাছি গেলাম। ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম নদীর ধারের রেস্তোরাঁগুলোতে হালকা মিউজিকের তালে জমজমাট খাওয়া-দাওয়া চলছে।

সান অ্যান্তনিও নদীটা তখনো জেগে আছে। বোটে করে তখনো কত মানুষের আনাগোনা, বিবশ হয়ে রই ভালো লাগার মুগ্ধতায়।

একটু পর হাত ঘড়িতে দেখি রাত দশটা বাজে। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে দ্রুত গতিতে হোটেলের পথ ধরি। পেছনে সেই চাঁদখানার ছায়া পড়ে রয় নদীর জলে, এক বৈচিত্র্যময় রাত দেখার সাক্ষী হয়ে রই আমি আর শীতের উদাসী বাতাস।