চূড়া থেকে দেখা

ক্যালটন হিলের চূড়া
ক্যালটন হিলের চূড়া

মাঝে মাঝে উদ্ভট কিছু ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে বেড়াতে গেলে এ ধরনের ইচ্ছের পোকাগুলো একটু বেশি কামড় দেয়। সেবার এডিনবরা শহরে (স্কটল্যান্ডের রাজধানী) গিয়ে ফট করে মনে হলো সব সময় তো লিস্ট করে রাখা জায়গাগুলোকে একেবারে কাছে থেকে দেখি। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। এবার সেটা না করে একটু অন্যরকম কিছু করলে কেমন হয়? প্রতিবারের মতো শহরের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো সামনে থেকে দাঁড়িয়ে দর্শন না করে কোনো একটা পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো শহর দেখলে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগবে। আলাদা করে এক একটা জায়গায় যাব, কিছু ছবি তুলব, এ আর নতুন কী? আর যুক্তরাজ্যের সব শহরতো কম বেশি একই রকম দেখতে। আলাদা করে দারুণ তখন লাগবে, যদি সেটা কোনো একটা পাহাড় থেকে দর্শন করা যায়। পুরো শহর এর ঝলক একবারে, একসঙ্গে দেখা যাবে। মন্দ হবে না নিশ্চয়।

ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর
ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর

যেমন ভাবা তেমন কাজ।

উঠে পড়লাম ক্যালটন হিলে। অবশ্য উঠে পড়ার কাজটা ততটা সহজ ছিল না। ছোট বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে অতগুলো সিঁড়ি বাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। উঠছি তো উঠছিই। শেষ আর হয় না। অবশেষে শেষ ধাপ পেরিয়ে যখন ক্যালটন হিলে পৌঁছালাম ততক্ষণে ভ্রমণের এনার্জির প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। বসে একটু রেস্ট নিয়ে, পানিটানি খেয়ে নিজেদের আবার রিচার্জ করে যখন উঠে দাঁড়ালাম, দেখি আকাশ একদম ঝকঝক করছে। যাত্রা শুরুর সময় একটু মেঘলা আকাশ দেখে মন যেটুকু খারাপ হয়েছিল। তা নিমেষেই ভালো হয়ে মুখের হাসি ফিরিয়ে দিয়ে গেল। বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে আমরা ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। সে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। অসম্ভব ভালো লাগল পাহাড় থেকে পুরো শহর দেখতে। ক্যালটন হিল এডিনবরা শহরের সেন্ট্রাল হিল। এটি ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। স্কটিশ পার্লামেন্ট বিল্ডিং ও আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ভবন যেমন হলিরুড প্যালেস এই হিলটির পায়ের কাছে অবস্থিত। ক্যালটন হিলে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভসহ আরও বেশ কিছু বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সিটি অবজারভেটরি।

ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর
ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর

ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর, সুদূর প্রসারিত স্কাই লাইনের দৃশ্য ছাড়াও স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান এডিনবরা ক্যাসেলের অনেকখানি দেখা যায়। যা খুবই আকর্ষণীয় যেকোনো পর্যটকের জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ওখান থেকেই এডিনবরা ক্যাসেল দেখতে বেশি ভালো লেগেছে কাছে থেকে দেখার চেয়ে। ক্যালটন হিল রাতেরবেলাতেও বেশ সুন্দর। প্রতিবছর বেশ অনেকগুলো ইভেন্ট হয় এখানে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বেলটেন ফায়ার ফেস্টিভ্যাল। যেখানে প্রায় বারো শরও বেশি মানুষ একত্রিত হন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব দশেরা প্রতিবছর অক্টোবরের শুরুতে এই ক্যালটন হিলে উদ্‌যাপিত হয়।

ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর
ক্যালটন হিল থেকে এডিনবরা শহর

ক্যালটন হিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এডিনবরা শহরের পেইন্টিং ও ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে।

বেলটেন ফায়ার ফেস্টিভ্যাল
বেলটেন ফায়ার ফেস্টিভ্যাল

সত্যিই এটি চিত্রশিল্পীদের জন্য আদর্শ জায়গা। আর ফটোগ্রাফারদের জন্য যে ভীষণ ডেলাইট ফুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের সামনে দুজন প্রফেশনাল ছবিয়াল ছিলেন। মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাদের কাজ দেখলাম। কত কায়দা করে যে তাঁরা একেকটা ছবি তুলছিলেন। শট নেওয়ার জন্য এমন এমন সব অ্যাঙ্গেল তারা বের করছিলেন, যেগুলোর কথা আমরা ভাবতেও পারব না। আমাদের সঙ্গে এক তরুণ চাইনিজ দম্পতি ছিলেন, তারা ছিলেন ছবিয়ালের ওপর যদি কিছু থাকে সেটা। অতি উৎসাহী এই দম্পতি শুয়ে, বসে, বেঁকে, সোজা হয়ে, মাটিতে গড়াগড়ি করে, হামাগুড়ি দিয়ে এমন কোনো ভঙ্গি নেই যে ভঙ্গিতে নিজেদের ছবি তুলতে বাকি রাখছিলেন। আমাদের ভ্রমণের আনন্দের সঙ্গে এক অন্যরকম এন্টারটেইনমেন্টও যোগ হয়েছিল তাদের কারণে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমাদের নিজেদের আনাড়ি মনে হচ্ছিল তাদের দেখে। না জানি পোজ দিতে, না বুঝি ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল। হাসতে হাসতে ভাবছিলাম তাদের না দেখলে জীবনের অনেক কিছুই অজানা রয়ে যেত। সব মিলিয়ে দারুণ সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে আবহাওয়াকে আমাদের অনুকূলে রাখার জন্য। সেই সঙ্গে ওই চাইনিজ দম্পতিকে ধন্যবাদ আমাদের কিছু মজার সময় উপহার দেওয়ার জন্য। ভ্রমণটা এমনিতেও সুখকর ছিল, তাদের কারণে আরও উপভোগ্য হয়েছিল।

ক্যালটন হিলের চূড়া
ক্যালটন হিলের চূড়া