চাঁদের আলোয় কয়েকজন উদভ্রান্ত যুবক

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মাইকেল, ক্যামেরন, ফিল, হ্যারি ও কেলি সবাই হাইস্কুল পাস দিয়েছে সবে। আঠারো বছর পূর্ণ করে তারা সবে উনিশে পা রেখেছে। এত দিন তারা বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজালে বেড়ে উঠেছে। এখন থেকে তারা এক অর্থে স্বাধীন। তারা চাইলেই যেকোনো কিছু করতে পারে। তারা জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে মোটরওয়ে দিয়ে হুস করে চলে যেতে পারে। ইচ্ছে করলেই যেকোনো পানীয়ের দোকানে গিয়ে পানীয় কিনে সেটা খেয়ে রাস্তায় মাতাল হয়ে হাঁটলেও তাদের কেউ আর দেখতে আসবে না। ইচ্ছে করলেই সিগারেটের দোকান থেকে দামি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাঁটাহাঁটি করতে পারে। এক কথায় অবারিত স্বাধীনতা। তাই তারা বুঝে উঠতে পারছে না, আসলে ঠিক কোন কাজটা দিয়ে তাদের উদ্‌যাপন শুরু করবে।

তারা একইসঙ্গে সিগারেট ও পানীয় কিনে এনেছে। এই পার্কটাতে তারা দিনেরবেলায় এসে বসে প্রায়শই আড্ডা দিত। তবে আজ তারা এসেছে মাঝরাতের পর। কারণ আজকে তাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আর অভিভাবকেরাও জানেন, এখন ছেলেমেয়েরা সাবালক হয়ে গেছে। তাই তারাও ছাড় দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই সবাই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত পানীয়ের বোতলের প্রায় অর্ধেক খালি করে ফেলেছে। এর সঙ্গে চলছে সিগারেট ফোঁকা। এভাবে চলতে চলতে একসময় তারা বিরক্ত হয়ে গেল। শুরুতেই মিক কথা বলে উঠল। মাইকেলকে সংক্ষিপ্ত রূপে তারা মিক বলে ডাকে আর ক্যামেরন হয়ে গেছে ক্যাম। মিক বলল, ধুর এভাবে আর ভালো লাগছে না। এত সাদামাটাভাবে সাবালক হওয়ার দিন পালন করতে ভালো লাগছে না। ওর কথা শুনে ফিল বলল, ধুর এভাবে আর ভালো লাগছে না। তোরা কী বলিস? সেটা শুনে ক্যাম বলল, তোরা কী করতে চাইছিস শুনি। বন্ধুমহলে ক্যাম সব সময়ই ধীরস্থির বুদ্ধির। ক্যামের কথা শুনে হ্যারি বলল, এমন একটা কিছু করা দরকার যাতে সারা জীবন আমাদের মনে থাকে। বন্ধুমহলের একমাত্র মেয়ে কেলি বলল, আমি তোদের এই ব্যাপারটায় নেই। পানীয় খাচ্ছিস সিগারেট ফুঁকছিস ঠিক আছে, কিন্তু স্মরণীয় করে রাখার জন্য আর কী করতে হবে তোদের।

মিক বলল, আমি পরিকল্পনা ও সার্ভে করে ফেলেছি। এখন সেটা তোদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। আমার পুরো পরিকল্পনাটা বলা শেষ হলে তোরা কথা বলবি তার আগে না। বলেই মিক বলতে শুরু করল।

লংহার্স্ট রোডের সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটার নিচতলায় একটা পরিবার থাকে। ওই রাস্তা দিয়ে যে কেউ গেলেই ওই বাড়িটার দিকে একবার হলেও তাকাবেই। আমিও ওইদিক দিয়ে গেলে তাকাতাম। আগে ওই বাড়ির সামনে একটা পুরোনো মডেলের গাড়ি দাঁড় করানো থাকত। ইদানীং দেখছি আরও একটা নতুন গাড়ি দাঁড় করানো থাকে। তার মানে হচ্ছে সেই পরিবারের আয় বেড়েছে।

এর মধ্যেই আমি একদিন গিয়ে দেখে এসেছি তারা প্রায়ই তাদের বাসার জানালার কাচ সরিয়ে রাখে বাতাসের চলাচলের জন্য। তাই আজকে গেলেও হয়তো জানালার কাচ খোলা পাওয়া যাওয়ার চান্স আছে। আর ওটা যেহেতু গ্র্যানি ফ্ল্যাট তাই রুমের সংখ্যা হয়তোবা একটা বা দুইটা। তাই গাড়ির চাবি খুঁজে পেতে কষ্ট করতে হবে না আশা করি।

মিকের পরিকল্পনা শুনে হ্যারি বলল, আমি রাজি। ফিলও তাতে সায় দিল। ক্যাম বলল, আমি চিন্তা করছি ওখান থেকে আমরা পালাব কীভাবে যদি মালিক টের পেয়ে যায়। আমি ভাবছি আমাদের সঙ্গের দুইটা গাড়ি নিয়ে বাসার সামনের রাস্তায় থাকব। যদি পরিস্থিতি প্রতিকূল হয় তাহলে আমরা দ্রুতই সরে যেতে পারব। কেলি বলল, আমি তোদের এই কাজে নেই। যাওয়ার সময় আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যা।

সেটা শুনে সবাই চুপ থাকল মানে মিকের প্রস্তাব মেনে নিল। তারপর তাদের হাতের পানীয়র বোতল পার্কের পাশের কংক্রিটের ফুটপাতে সজোরে ছুড়ে ফেলে ভেঙে তারা একে অন্যের সঙ্গে হাই ফাইভ করে গাড়ির দিকে রওনা দিল।

দুই.

হাসানের স্ত্রী কাজ শুরু করার পর থেকেই তাদের বাচ্চাগুলোর জীবন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। সেই সাতসকালে কেয়ারে যায় আবার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সব মিলিয়ে দিনের চব্বিশ ঘণ্টার বারো ঘণ্টা ওরা কেয়ারেই কাটায়। আর বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণও ওদের ঠিকমতো সময় দেওয়া হয় না। কারণ বাসার কাজ নিয়ে তাদের দুজনকেই ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই স্কুল ছুটির আগের শুক্রবারে যখন তাদের মেয়ে তাহিয়ার স্কুল কর্তৃপক্ষ ওপেন এয়ার সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করল, হাসান তখন সানন্দে রাজি হয়ে গেল। অন্ততপক্ষে এই উপলক্ষে ওদের সঙ্গে কিছুটা ভালো সময় কাটানো যাবে।

তাই অফিস থেকে ফেরার পথে কেয়ার থেকে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে স্কুলের মাঠে হাজির হয়ে গেল। স্কুলের মাঠে বিশাল আয়োজন। ছবি দেখানোর আগে বাচ্চারা তিনটা গ্রুপে ভাগ হয়ে পারফর্ম করবে তার প্রস্তুতি চলছে। ওখানে গিয়েই দেখা হয়ে গেল বাপ্পি ভাইয়ের মেয়ে নাওয়ার সঙ্গে। নাওয়া জানাল ওর মা এসেছে। ওর মা বেঞ্চে বসে আছে বলে বেঞ্চের দিকে দেখিয়ে দিল। সাবরিনা আপুর বড় মেয়েটা এবার সবে ইয়ার ওয়ানে পড়ে। সেও এসেছে মায়ের সঙ্গে। সাবরিনা আপুর সঙ্গে দেখা হতেই কুশল বিনিময় হলো।

একটু পর বাচ্চারা সবাই সিনেমার পর্দাটাকে পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তাদের পরিবেশনা শুরু করল। হাসি ভাবি এসে কুশল বিনিময় করে বললেন, বাপ্পি ভাইয়ের আসতে একটু দেরি হবে, তাই তিনি এসেছেন। হাসানকে দেখে বললেন, আপনি আছেন এখন ভরসা পাচ্ছি। আমি একটু বাসায় যাব কিছু খাবার দাবার আনতে। ইতিমধ্যে যদি বাপ্পি চলে আসে ভালো, তা না হলে আপনি একটু নাওয়াকে দেখে রেখেন। বলে তিনি বাসার দিকে পা বাড়ালেন। হাসান স্টেজের সামনেই একটা জায়গায় মাদুর বিছিয়ে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে বসে পড়ল। পরিবেশনা শেষ করে নাওয়া এসে তাহিয়াকে নিয়ে স্কুলের ভেতরের পার্কেই খেলতে চলে গেল। হাসান রায়ানকে কোলে নিয়ে সেদিকে নজর রাখছিল।

বাপ্পি ভাই চলে এলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। তাঁর দুই কাঁধে চারটা পোর্টেবল চেয়ার। তাঁর ছেলে রাবাবের হাতে দুটি ব্যাগভর্তি বিভিন্ন রকমের শুকনো খাবার। হাসান তাদের ডেকে মাদুরের পেছনে চেয়ার পেতে বসতে বলল। একটু পরেই হাসি ভাবি ফিরে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছবি শুরু হলো। দেখানো হবে হোম অ্যালোন সিরিজের প্রথম ছবি। যেখানে একটা বাচ্চা কীভাবে একা দুজন চোরকে মোকাবিলা করে। ছবি চলল আর সেই সঙ্গে চলল বাপ্পি আর হাসি ভাবির আনা খাবারের শ্রাদ্ধ। এভাবে একসময় ছবি শেষ হলে তারা বাসার দিকে ফেরা শুরু করল। বাসায় ফিরে হাসান দেখল তাঁর স্ত্রী কাজ থেকে ফিরে ইতিমধ্যেই খাবার তৈরি করে রেখেছে। কোনোমতে সেসব খেয়ে সবাই ঘুমাতে চলে গেল। ঘুমাতে যাওয়ার সময় হাসানের স্ত্রী বলল, আমি গরমের জন্য জানালার কাচের স্লাইডিং সরিয়ে রেখেছি। হাসান যেন স্লাইডিং বন্ধ করে ঘুমাতে যায়। ক্লান্ত হাসান বলল, থাক খোলা থাক, একটু হাওয়া বাতাস আসুক।

তিন.

দুটি গাড়িতে করে মিকসহ চারজন নির্দিষ্ট বাড়িটার পাশের রাস্তায় এসে পার্কিং করে দূর থেকে বাসাটাকে দেখে নিল। তারপর মিক গাড়িতে রাখা ধারালো ছুরিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাসার সামনে পৌঁছে মিক খুশি হয়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে সেদিনও জানালার কাচের স্লাইডিং খোলা। সে ছুরির আলতো টানে জানালার নেটটা কেটে সেখান দিয়ে ঘরের ভেতরে রাখা সোফার হাতলে সন্তর্পণে পা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আসলেই তার ধারণা অনুযায়ী কক্ষগুলো অনেক ছোট। তার মনে হলো এটা মনে হয় ড্রয়িংরুম। সেখান থেকে একটা দরজা ভেতরের দিকে গেছে। সেটা দিয়ে পরের রুমে যেতেই তার চোখে আলো এসে লাগল। একটা ছোট আলো জ্বলছে আর নিভছে। মোবাইলে যেমন কোনো মেসেজ এলে সেটা যেমন আলো জ্বালিয়ে তার বহনকারীকে জানান দেয় তেমন আলো।

মিক সেদিকে এগোতেই মনটা আরও খুশি হয়ে গেল। সেটা আসলেই মোবাইল। তার পাশেই মানিব্যাগ ও গাড়ির চাবিগুলো রাখা। এ ছাড়া, একটা ছোট ল্যাপটপ। তার পাশের চেয়ারের ওপর দুটি ছোট ট্রাভেল ব্যাগ রাখা। মিক সবগুলো নিয়ে এক জায়গায় করল। তারপর মাথার ওপরের দিকে নজর যেতেই বুঝতে পারল এটা সম্ভবত এই বাসার রান্নাঘর। মিক দু–একটা কাপবোর্ড খুলে সেখানে কিছু না পেয়ে আসার রাস্তা অনুসরণ করে বাইরের রুমে এসে সদর দরজা খুলে বাসার বাইরে চলে এল। সবকিছু আশাতীতরকম সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বাইরে এসে লাইটের আলোয় ব্যাগ দুটি উল্টো করে ঝেড়ে কিছু পাওয়া গেল না। তাই বোঝা না বাড়িয়ে সেগুলো ফেলে এগিয়ে চলল। বাসার পেরিফেরিতে পা দিলেই সেন্সরের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলে উঠেছিল।

গাড়ির চাবিগুলোর লক আনলক বাটনে চাপ দিতেই একটা গাড়ির আলো জ্বলে উঠল। সেটাতে চড়ে বসে মূল রাস্তার দিকে এগোতে থাকল। মূল রাস্তার কাছাকাছি যেতেই খুশিতে হর্ন দিয়ে বাকিদের জানিয়ে দিল কর্ম সারা। তারপর তারা একেবারে রেসের ভঙ্গিতে গাড়ি চালিয়ে তিন চারটা সাবার্ব ছাড়িয়ে এসে একটা সাবার্বের বনের পাশে গাড়ি পার্ক করল। তারপর সবাই এসে মিককে অভিনন্দন জানাল এত সুন্দর একটা কাজ সমাধা করার জন্য। মিক বলল আসলেও আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে গেল। সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে। চল গাড়িটা ফেলে ভাগি। মোবাইলটা দেখে মনে হচ্ছে একদমই নতুন। হ্যাক করে ব্ল্যাক মার্কেটে বেচলে নিদেনপক্ষে এক হাজার ডলার পাওয়া যাবে। আর মানিব্যাগে কিছু পাওয়া গেলে সেটা বোনাস। আকাশে আধখানি চাঁদ আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। তার আলোয় বনের পরিবেশটাকে কেমন জানি অদ্ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। হ্যারি তার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করা সবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও একটা ধরাল। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গাড়িতে গিয়ে বসল। ফিল বলল, এবারের ক্রিসমাসের ছুটিটা ভালোই কাটবে।

চার.

ভোর রাতে হঠাৎ হাসানের স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। অন্যদিন ভেতরের কক্ষে ঘুমায়। সেদিন হাসানের স্ত্রী রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছোটা জায়গাটায় যেখানে তাহিয়ার জন্য একটা খাট ফেলা হয়েছে সেখানে শুয়েছিল। ঘুম ভাঙার পর তার মনে হলো অন্ধকারে হাসান রান্নাঘরে পায়চারি করছে। হাসানের স্ত্রী ভাবল, হাসান হয়তোবা পানি খেতে উঠেছে। হাসানের রাত জেগে লেখালেখির অভ্যাস। তাই সে অবাক হলো না। একটু পর হাসান বাইরে চলে যেতেই তার সন্দেহ হলো। এত রাতে তো তার বাইরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। সন্দেহবশত সে উঠে ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখে হাসান ঘুমাচ্ছে। তখনই হাসানের স্ত্রী বুঝে গেল বাসার ভেতরে কেউ ঢুকেছিল। হাসানকে ডেকে তুলে বাইরে গিয়ে দেখে কেউ একজন তাদের গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছে আর রাস্তার ধারে আরও দুটো গাড়ি পার্ক করে রাখা।

হাসান বাইরে বের হয়ে দেখে তাদের গাড়িটা নেই। চোর নিয়ে চলে গেছে। হাসান তাড়াতাড়ি তিন শূন্যতে কল দিয়ে পুলিশকে ঘটনা জানাল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশের দুটি গাড়ি এসে সেখানে হাজির হলো। পুলিশ হাসানের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। হাসানের স্ত্রীর ডাকে ওপর থেকে তাদের বাড়িওয়ালা নাজমুল ভাই আর তার স্ত্রী সন্ধ্যা ভাবি নেমে এলেন। এদিকে শব্দ শুনে হাসানের মেয়ে তাহিয়াও ঘুম থেকে উঠে পড়ল। সে অনেক ভয় পেয়ে গেছে। তার শিশুমন কোনোভাবেই ঘটনাটা নিতে পারছে না। সে বারবার তার মা–বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, চোর কেন তাদের বাসায় চুরি করল। আর হাসানের স্ত্রী শুধু বারবার একটা কথায় বলে যাচ্ছে, এই চুরি–ডাকাতি থেকে বাঁচার জন্যই অস্ট্রেলিয়া আসলাম। সেখানেও যদি এগুলো হয় তাহলে আর অস্ট্রেলিয়া এসে কী লাভ হলো।

চোর একটি গাড়ি নিলেও দুই গাড়ির পাঁচটি চাবি নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের দুজনের মানিব্যাগ। আরও দুটি হ্যান্ড ব্যাগও চোর নিয়েছিল। তবে সেগুলো বারান্দায় ফেলে গেছে। সেই সঙ্গে ল্যাপটপটাও। অনেক খুঁজে অন্য গাড়িটার একটা চাবি পাওয়া গেল যেটা অন্য চাবিগুলো থেকে একটু দূরে রাখা ছিল। চাবিটা পেয়ে হাসান আশ্বস্ত হলো কারণ, অস্ট্রেলিয়াতে গাড়ি ছাড়া চলাফেরা করা খুবই দুষ্কর। বিশেষ করে যাদের ছোট ছেলেমেয়ে আছে তাদের জন্য মোটামুটি অসম্ভব। মানিব্যাগ নিয়ে গেছে শুনে হাসান আরেকবার হতাশ হলো। যদিও তার মানিব্যাগে কোনো ক্যাশ টাকা থাকে না। তবে ক্রেডিট কার্ডসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সবগুলো কার্ডই ছিল মানিব্যাগে। আসলে অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাপনকে হাসান বলে কার্ডের জীবন। সবকিছুর জন্যই কোনো না কোনো কার্ড আছে। হাসান পুলিশের সঙ্গে কথা শেষ করেই ব্যাংকের অনলাইন নম্বরে কল দিয়ে ক্রেডিট কার্ডটা লক করে দিল। সবগুলো কার্ডের সঙ্গে এখানে চলাফেরা করার জন্য ব্যবহৃত ওপাল কার্ডও চোর নিয়ে গেছে। তাই হাসান ভাবছিল তাহলে কীভাবে তারা চলাফেরা করবে। এটা জেনে নাজমুল ভাই বললেন, কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমাদেরকে কিছু ক্যাশ এনে দিচ্ছি। লাগলে আরও নিয়ো। হাসান সেটা নিয়ে তালিকা করতে লাগল জরুরি ভিত্তিতে কী কী কেনা প্রয়োজন।

এভাবে একসময় ভোর হয়ে এল। হাসান ও তার স্ত্রী দুজনকেই অফিসে যেতে হবে। হাসান তার স্ত্রীকে ক্যাম্বেলটাউন স্টেশনে নামিয়ে ফিরে এসে বাচ্চাদের তৈরি করে তাদের কেয়ারে নামিয়ে অফিসের দিকে রওনা দিল। সবকিছুই এত আকস্মিকভাবে ঘটেছে যে হাসান তখনো ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছে না যে আর কী করা উচিত। অন্য দিনের মতোই আরও একটা দিন শুরু হলো। অফিসে শেষ করে ফেরার পথে হাসান পুলিশের একটা ভয়েস মেসেজ পেল। প্যাডস্টো নামে পাশের একটা সাবার্বের বনের পাশে তাদের গাড়িটা পাওয়া গেছে। তারা ইতিমধ্যেই সেটা তাদের মনোনীত টো কোম্পানির গ্যারেজে নিয়ে রেখেছে। তদন্তের সার্থে গাড়িটা তাদের কাছে রাখতে হবে কদিন। কিন্তু সেই কদিন ক্রিসমাসের ছুটির কারণে গিয়ে ঠেকল এক মাসে।

এই এক মাসে তাদের জীবন স্বাভাবিক নিয়মেই এগিয়ে চললেও কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। এখন তাহিয়া ঘুমাতে যাওয়ার আগে হাসানকে দিয়ে দরজা জানালাগুলো বন্ধ করা হয়েছে কিনা চেক করিয়ে নেয়। কারণ তার মনের ওপর চাপ পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া, হাসানের স্ত্রীও হঠাৎ হঠাৎ রাতে জেগে ওঠে। অনেক সাহসী হাসানের মনেও ভয় ঢুকে গেছে। সে ঘুমাতে যায় অনেক রাতে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজা জানালাগুলো আরও একবার পরীক্ষা করে নেয়। এমনকি ঘুমাতে যাওয়ার সময় সব লাইট বন্ধ থাকলে তার ভয় লাগা শুরু হয়। তাই সে রান্নাঘরের লাইট অন রেখেই ঘুমাতে যায়।

পাঁচ.

অবশেষে এক মাসের মাথায় হাসান পুলিশের কাছ থেকে কল পেয়ে গাড়িটা আনতে টো স্টেশনে গেল। গিয়ে গাড়িটা দেখেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারা গাড়িতে ফিংগার প্রিন্ট নেওয়ার জন্য এক ধরনের পাউডার মাখিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে কিছু ফর্মালিটি শেষ করে গাড়িটা ফিরে পেল। টো স্টেশনের নারী কর্মকর্তা ক্যাথি বললেন, তোমার গাড়ির ব্যাটারি ডাউন। আমি চার্জার দিয়ে স্টার্ট করে দিচ্ছি। তোমাকে অন্ততপক্ষে আধঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু রাখতে হবে। না হলে আবার ডাউন হয়ে যাবে। গাড়িতে ওঠার পর হাসানের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। কারণ ভেতরটাও অনেক নোংরা। সবকিছু আলুথালুভাবে ছড়ানো।

এমন গাড়ি চালিয়ে নিতে হবে হাসানের খুব খারাপ লাগছিল। টো স্টেশনের নারী কর্মকর্তা বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। কারণ বিকেল পাঁচটার পর তাদের অফিস বন্ধ করার কথা। কিন্তু হাসানের গাড়ি ডেলিভারি দিতে গিয়ে তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাসান কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করল। জিপিএসের চার্জারটাও তখন খুঁজে পাওয়া গেল না। তাই মোবাইলের গুগলে বাসার ঠিকানা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাসায় পৌঁছাল।