বরফের দেশে জীবনযুদ্ধ আর মানবতা
শীতকাল। কানাডায় এখন প্রচণ্ড ঠান্ডা। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সময়টায় অত্যধিক ঠান্ডা থাকে। তাপমাত্রা অনেক কম। আকাশ থেকে তাকালে দেখা যায় এই জমিন সাদা চাদরে ঢাকা। প্রায় নয় বছর আগে জাপান থেকে বরফের দেশ কানাডায় এসেছি।
তখন ছিল সেপ্টেম্বর মাস। কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শীতকালীন সেশন শুরু হবে। এমএস গবেষণা শেষে পিএইচডি শুরু করবে ইভা। অনেক স্মৃতিবিজড়িত জাপানের আটটি বছরকে পেছনে ফেলে সামনে বাড়ার সময়। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমি তখন ওখানেই এক রিসার্চ ফার্মাতে কর্মরত। আমাদের দুজনের ছোট সংসারে তখন আট মাসের বাবু নাবিহা। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেতে হবে সবাইকে।
হালকা শার্ট পরে টোকিও থেকে বিমানে উঠলাম। মাঝারি জ্যাকেট পরে কানাডার ক্যালগেরি বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ ওখানে শেষ। তারপর গন্তব্য এখন রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যালগেরি থেকে ছেড়ে আসা ডোমেস্টিক বিমান যখন তার গন্তব্যের কাছাকাছি, তখন শীতের শুরুতেই চারপাশে শুধু সাদা দেখেছি। বরফে ঢাকা এক শান্ত শহর। ভারী জ্যাকেট গায়ে সাস্কাচেওয়ান প্রদেশের রাজধানী রেজাইনাতে বের হলাম। তখন ২০১০। শুরু হলো বরফে জীবন। হিমশীতলকে জয়ের সূচনা।
বিমানবন্দর থেকে কলমি বন্ধু তানবীর আমাদের সরাসরি তাঁর বাসায় নিল। ভালো ছেলে। ঈদের সময় বলে কথা। আর মাত্র দুই দিন বাকি। সেই পর্যন্ত আমরা তানবীর ও শাহনাজের সঙ্গেই থাকলাম। কানাডায় প্রথম ঈদ, তা খারাপ কাটেনি। আমাদের জন্য এ এক নতুন দেশ। আর তাই শূন্যতা ও দুর্ভাবনাকে ওরা দূর করার চেষ্টা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভার গবেষণা শুরু হলো। আর সঙ্গে টিচিং আসিস্টেন্টশিপের একগাদা কাজ। দিনে ক্লাস ও গবেষণা। আর বাসায় এসে শিশু নাবিহাকে আগলিয়ে রেখে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সেশনাল ফ্যাকাল্টি, সপ্তাহে একদিন পড়াই। নতুন সংগ্রামে আমরা। এ এক কঠিন সময়। প্রতিকূল আবহাওয়া। কোনো একদিন তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে আমি হেঁটেছি প্রায় ২০ মিনিট। সে এক ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা। এ শান্ত শহরে বসবাসকারী মানুষেরাও তেমন শান্ত। একে অপরের সাহায্য করে। টোকিওতে সুখের জীবনকে স্বেচ্ছায় পেছনে ফেলে এসেছি। তবে কী ভুল? আমি জানি না। তবে এটা জানি, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের অনেক বড় বড় বাধাকে আমি জয় করেছি।
পরে গবেষণার কাজে আসি টরন্টোতে। তখন গ্রীষ্মকাল। এ এক ব্যস্ত শহর। টোকিও ছিল অতিব্যস্ত মেগাসিটি। অনেক কটা বছর কাটিয়েছি সেখানে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্যাটে স্যার আমার কাজ সম্পর্কে জানলেন। আমার টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালের পিএইচডি বস কিতাহারা সেনসের নাম শুনলেন, ব্যাস ঠিকঠাক। শুরু হলো সেখানে থাকা। আমার ছোট্ট মা নাবিহার জন্ম টোকিওতে। টরন্টোতে সময়ের ব্যবধানে আমাদের তিনজনের ছোট পরিবারে যোগ হয়েছে নাশিতা ও ইহানের। ওরা বেড়ে উঠছে শিক্ষা ও আদর্শে, ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতায়। আর্ট, নাচ, সায়েন্স অনেক কিছু করতে চায় তারা। প্রচণ্ড রাগী নাশিতা খুব চটপটে। আমরা সিটিজেন হওয়ার দিন, জজকে মুখের ওপর বলল, সে অলরেডি সিটিজেন, তার সার্টিফিকেট দরকার নাই! ওদের মেমোরি প্রখর। এইতো সেদিন এমপির অনুষ্ঠানে অডিয়েন্সকে অবাক করেছিল।
এই ওন্টারিও প্রদেশে তুলনামূলক কম ঠান্ডা, কম তুষারপাত। এবারের শীতকাল আগের কয়েক বছরের চেয়ে কিছুটা ভালো। গত কয়েক দিন থেকে তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ব্যস্ততা থেমে নেই। মানুষ ক্রমাগত ছুটছে। তবু এসবের মাঝে মানবতাও আছে। ভালো লাগার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করি।
বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। অন্যদিনের মতো গতকাল রাত চারটায় গাড়িটা পার্কিং করে বাচ্চাদের নিতে গিয়েছি। ওদের নিয়ে পার্ক করা গাড়িতে বসালাম। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। বুঝলাম অতি কম তাপে ব্যাটারির চার্জ গেছে। বুস্টিং দরকার। একজনের সাহায্য চাইলাম। কপাল ভালো, বুস্টার কর্ডটা তার ছিল। গাড়ি সামনাসামনি নিয়ে চার্জ শেয়ার করলেন। ভালো মানুষ তিনি। কষ্ট উপেক্ষা করে আমাদের উপকার করেছেন।
পরদিন মানে আজ, বিধাতা হয়তো আমার পরীক্ষা নিতে চেয়েছেন। সুপারমার্কেটের বাইরে গাড়িটা পার্ক করছি। এমনসময় পাশের সিয়েন্না গাড়ির ভদ্রমহিলা এসে একইরকম সাহায্য চাইলেন। বাচ্চাদের নিয়ে এই মা অত্যধিক ঠান্ডায় সাহায্য পেতে অপেক্ষায় ছিলেন। নিজ কপালে হাত দিলাম, আহ বুস্টার কর্ডটা আরেকটাতে রেখে এসেছি। তবে কি আমি হেরে যাচ্ছি? নাহ। বুঝেছি ভদ্রমহিলা অনভিজ্ঞ। তবে বললেন, তার কাছে কর্ডটা আছে। বাঁচলাম! তোমার গাড়িকে জীবন দিতে ঠিক ওইটাই এখন দরকার, বললাম তাকে। পাশাপাশি কানেক্ট করে তার গাড়িটা ঠিক করে দিলাম। বিপদের কালো মেঘটা সরে গেল। এই মা খুব সুন্দর করে ধন্যবাদ দিলেন। তার চোখেমুখে পরিপূর্ণ তৃপ্তির অমায়িক হাসিটা আমি দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে। অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম কর্মক্ষেত্রের এক বন্ধুকে। তার কাছে জেনেছি, বুস্টার কর্ড না থাকলে হাত ব্রেক উঠিয়ে গাড়ি স্টার্টের চেষ্টা করতে হবে। এই বিশাল দেশে জনবসতি কম, বেশির ভাগটায় জনমানবহীন ফাঁকা জায়গা। বিপদ আসতে পারে যে কারও, যেকোনো জায়গায়! মানুষ মানুষের জন্য।
(জানুয়ারি ১২, ২০১৯)
ড. মো. সাদেকুল ইসলাম: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জৈব রসায়ন, টরন্টো, ওন্টারিও, কানাডা।
ইমেইল: <[email protected]>