আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

দুই-তিন বা চার ঘণ্টা টানা পড়াশোনা করে আমাদের কী হয়! খুব ক্লান্ত ঘুম ঘুম চোখে পড়াশোনা শেষে রিওয়ার্ড বা পুরস্কার অথবা রিফ্রেশমেন্ট বিনোদন হিসেবে ফেসবুকে ঢুকে দেখি। ফেসবুকে আসলে কী থাকে? কে বিয়ে করল, কে বিরিয়ানি রান্না করল, কে বেড়াতে গেল, কার গোসল করতে বাথরুমে শীত লাগে, সেই সব পোস্ট, ছবি ও তথ্য। এই যে, আমাদের মস্তিষ্ক এতক্ষণ ধরে যে পড়াশোনা করেছে সেটা ঘুমের মাধ্যমে মস্তিষ্কে স্মৃতিতে জমা হয়। কিন্তু ঘুমানোর আগে এই যে, কে হানিমুন করল, কার বাচ্চা হলো বা কে কক্সবাজারের ছবি দিল, এই সব দেখে ঘুমাতে গেলে মস্তিষ্ক শেষ এবং ঘুমের ঠিক আগের কার্যক্রমগুলো সারা রাত ঘুমের মধ্যে প্রসেস করে বা স্টোর করে।

ফেসবুকের ভিজ্যুয়াল রঙিন ছবি ও লেখা খুবই সহজ এবং আকর্ষণীয় দেখে ক্লান্ত মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে অন্ধকার ঘরের মোবাইলের নীল আলো যেটা মেলাটনিন হরমোনের সঙ্গে মস্তিষ্ককে দিনের আলোর মতো অনুভূতি দেয়। যে কারণে কাগজের বই পড়তে গেলেই ঘুম আসে, ক্লান্ত লাগে। কিন্তু মোবাইলের নীল আলোতে সারা রাত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কোনো কিছু পড়লে বা দেখলে ঘুম আসে না। বরং ঘুম পালিয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন এত এত তথ্য, ছবি ও বিনোদন একজন ছাত্রের কতটা দরকারি। সেটা পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের জন্য কতটা জরুরি? কিছুই জরুরি নয় এমন না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া সারাক্ষণ আমাদের মন খারাপ করে দেয়। কেননা পত্রিকায় ভালো খবর যেমন থাকে, খারাপ খবরও থাকে। কিন্তু ফেসবুকে কে চাকরি পেল সেই পোস্ট থাকলেও, কে ফেল করল সেই পোস্ট থাকে না। জামাই বউয়ের হানিমুনের রোমান্টিক ছবি থাকে। কিন্তু কতবার ঝগড়া করে সেই ছবি থাকে না। তাতে নিজদের ভেতর একটা দুঃখ অনুভূত হতে থাকে। যে সবাই কত কী করে, কত জায়গায় বেড়াতে যায়, কত কী খায়, কত কী ভালো, কিন্তু আমার লাইফ কত বোরিং।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, যিনি খুব একটা সুখী সুখী ইমেজ ফেসবুকে দিয়ে রাখেন, তিনি হয়তো খুব ভালো অভিনয় করেন। আসলে তিনি সুখী না, বরং আপনি অনেক ভালো আছেন। কিন্তু শো অফ বা অভিনয় না জানার জন্য ফেসবুকের লাইক প্রশংসা এই সব মিলছে না। যা হোক, এ রকম একটা দুঃখী দুঃখী অনুভূতি বা মন খারাপ ঘুমের জন্য সুখকর নয়। ফলে ঘুমের আগে মস্তিষ্ক অবচেতনে ইনার চ্যাট শুরু করে নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে।

এখন এই যে, এত এত উদ্দীপক অনুভূতি, যেটা কিনা আগের পড়াশোনাগুলো মস্তিষ্কে প্রসেস করার আগেই এসে যায় বলে চার ঘণ্টা যে পড়াশোনা হলো সেটা মনে রাখার কার্যকারিতা কমে যেতে থাকে। আর পরদিন যদি পরীক্ষা থাকে তাতে আমরা এ রকম অনুভব করি যে, ধুর গতকাল রাতেই না পড়লাম, এখন মনে পড়ছে না কেন? নিজেরা হীনমন্যতায় ভাবতে থাকি আমার স্মৃতি খুব খারাপ কিছুই মনে থাকে না। কিন্তু আসলে তা নয়। তাহলে মিতা রিতার বিয়েতে কী রঙের লেহেঙ্গা পড়েছিল বা শচীন টেন্ডুলকার কোন বলে সেই চার বছর আগের ওয়ার্ল্ড কাপে কীভাবে আউট হয়েছিল, সেই স্কুলে ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে কী করেছেন সেটা কীভাবে মনে থাকে?

পড়াশোনার সঙ্গে কল্পনা বা ইমাজিনেশনের সংযোগ থাকলে পরবর্তীতে মনে রাখা সহজ। এ জন্যই গ্রুপ স্টাডিতে মনে রাখা সহজ একা একা দরজা বন্ধ করে পড়ার থেকে।

মস্তিষ্ক ও স্মৃতিশক্তির কার্যক্ষমতাকে বাড়াতে ও ঠিকঠাক ধরে রাখতে খুব ভালো ফ্রেশ ঘুম দিয়ে উঠলে যেরকম ভালো অনুভূতি হয়, সেটা রাত তিনটা অবধি জেগে থেকে কখনো হতে পারে না। এ জন্যই গুরুজনরা বলেছেন: early to bed and early to rise makes a man healthy wealthy and wise, এটার যোগসূত্র রয়েছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি আবার ফেসবুকে ঢুকে দেখি, মনে হয় এরপর সারা দিন অনেক পড়াশোনা করব বা প্ল্যানমতো চলব। সেখানেও সকালে একটা ভালো ঘুমের পর যখন আমাদের এনার্জি পিক লেবেলে থাকে তখন এই সোশ্যাল মিডিয়াতে কোথা থেকে এক ঘণ্টা পেরিয়ে যায় এবং সঙ্গে এনার্জি শেষ। এরপর ঘুম ঘুম ঝিমানিতে চোখ খুলে রাখা কঠিন। তখন পড়াশোনা লাটে।

সারা দিন সারা পথ বাসে রাস্তায় যদি কানে বা হাতে এই স্ক্রলিং বা চ্যাটিং চলে তো কী কী মনে রাখা বা জানা দরকার সেটারও কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না৷ মোবাইল যুগের আগে হাতে একটা ভালো বই বা পত্রিকা আমাদের যতটা সমৃদ্ধ করে সেখানে ফেসবুকের বেশির ভাগ অদরকারি তথ্য ভালো ও দরকারি তথ্য থেকে আমাদের দূরে রাখে। যেমন ছাপানো পত্রিকার সংবাদের একটা পলিসি আছে। মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বিনোদন ও তথ্যের গুণগত মান। শিক্ষা পাতা আছে, তরুণদের জন্য মোটিভেশনাল পাতা আছে যেমন: সফল যারা কেমন তারা এ রকম কলাম আছে। কিন্তু ফেসবুকে মাছের পাঁচ পা দেখা বা ক্যাটরিনা কাইফের জানালার পর্দার আড়ালে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা চাকরি-বাকরির দরকারি তথ্য কোথায় হারিয়ে যায়।

আমার এ রকম অনেক হয়েছে, একটা দরকারি কিছু তথ্য দেখতে ফেসবুকে এসে এত এত অদরকারি ছবি ও তথ্যের সমুদ্রে পড়ে, কী জন্য এসেছিলাম সেটা ভুলেটুলে ঘণ্টা পেড়িয়ে গেছে। এতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়া একটা ফেক আর্জেন্সি তৈরি করে। যেমন আজকে রাতেই দীপিকা পাডুকোনের বিয়ের শাড়ি বা সাকিব আল হাসান আর তার মেয়ের সেই আইসক্রিম পোস্ট না দেখলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। কিন্তু পরীক্ষার আগে পড়াশোনা না শেষ হলে কিন্তু ফেল।

ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, ইকোনমিকস, ল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলের মতো কোনো কঠিন বিষয় পড়তে বা ক্রিয়েটিভ কোনো কাজ যেমন কিছু লেখা বা গানের সুর করতে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ও প্রচুর চর্চা দরকার। যেটা বারবার মেসেজিংয়ের টুংটাং আওয়াজে মনোযোগ বিঘ্নিত করে। এ রকম গবেষণা আছে, ডাক্তারি করতে করতে বারবার ফেসবুকে মেসেজিং করলে ভুল ওষুধ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আর সাধারণ মানুষ ড্রেনে পড়ে যায়, এমনকি সেলফি তুলতে গিয়ে পড়ে মারাও গেছে, এ রকম প্রচুর সংবাদ আপনারাই পড়েছেন।

আবার মূল প্রসঙ্গে আসি। এই এত এত ডেস্ট্রাকশন-বিরতি; তাতে পুনরায় পড়াশোনা ও লেখা বা গানের সুরে ফিরে আসতে অনেক সময় বেশি লাগে। এর ফলে একসময় আগ্রহ কমে যায়। আর সারা দিন সারাক্ষণ এত এত অদরকারি ছবি ও তথ্যে মস্তিষ্ক জমা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে হ্যাং করে।

Multitasking is an illusion. If you study and otherside messaging are on, then thousands of messages from different groups will take you no there. As a result you are not learning 100% and efficiently so there are chances to forget it in the exam hall. Because your brain didn't get enough time to understand, store and process it all.

এভাবে আমাদের এনার্জি মনোযোগ, সময়, স্মৃতি, মনে রাখার ক্ষমতা সব বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ক্লান্ত হয়ে আমাদের কার্যকারিতা বা প্রোডাকটিভিটি কমে যাচ্ছে।

স্মার্টফোনের ইতিবাচক সব দিক আমরা সবাই জানি। নেতিবাচক দিকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য করি। খুব পুরোনো একটা বাণী দিয়ে শেষ করব। মোবাইল, স্মার্টফোন ইন্টারনেট, ডেটা ওয়াইফাই অর্থাৎ বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ!

সেই আবেগ হলো কাগজের চিঠি, মনোযোগ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, কাজের প্রোডাকটিভিটি, মেধার বিকাশ হওয়ার ক্ষমতা, ভালো স্মৃতিশক্তি, রাতের ঘুম, বন্ধুদের আড্ডা, সামনে বসে গল্প করার আনন্দ, অনেক কিছু।

শিশুদের বিকাশে এর নেতিবাচক প্রভাব বাদে কেবল বড়দের জীবনে এই নেশা সিগারেট বা আফিমের থেকে কিছু কম ক্ষতি করে না।