গণপরিবহনের উন্নয়ন

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের গণপরিবহন (পাবলিক ট্রান্সপোর্ট) ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য জীবনের চলার পথে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ ছোট আকারে বলব। এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার যদি এতটুকু উন্নতি হয়, তবেই সার্থকতা।

চীন দিয়েই শুরু করি। চীনে প্রচুর জনসংখ্যা। যে কারণগুলোর জন্য এই বিশাল জনসংখ্যাকে নিয়ে দেশটি হোঁচট না খেয়ে এগোচ্ছে, তার একটি হচ্ছে এদের সবার ইউনিক আইডি আছে। চীনে আপনি যেকোনো কাজে যাবেন, এই আইডি নম্বর লাগবেই। কাউন্টার থেকে অথবা অনলাইনে টিকিট ক্রয় করবেন, এটা লাগবে। বিদেশিদের অবশ্য পাসপোর্ট নম্বর ব্যবহার করতে হয়। হোটেলে রাত যাপন করবেন, সেখানেও লাগবে। আর এদের রাস্তাঘাট, বাস-ট্রেন সবকিছুই সিসিটিভির আওতায়। এর ফলে কেউ অপরাধ করে পালাতে পারে না। সবকিছুই খোঁজ করা যায়। আমাদেরও এখন সবার ইউনিক আইডি (NID) আছে এবং ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য সম্প্রতি এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিগগিরই এটার সুফল জনগণ ভোগ করবেন।

চীনের তুলনায় ডেনমার্ক আকারে অনেক ছোট দেশ। জনসংখ্যাও অনেক কম। এখানেও সবার ইউনিক আইডি নম্বর আছে (CPR)। কিন্তু এখানে ট্রেনের টিকিট কাটতে এই আইডি নম্বর লাগে না। তবে এখানে প্রতিটা সরকারি ও বেসরকারি কাজ এই আইডির সঙ্গে যুক্ত। সরকার জানে, গ্রামের কোনো নির্জন এলাকায় কোনো একটি বাড়িতে কোনো লোক বসবাস করছে কিনা এবং করলে সেই ব্যক্তিটি কে?। আপনার আইডি নেই মানে আপনি ইনভ্যালিড একটা লোক। আপনি না পারবেন কাজ করতে, না বেতন তুলতে, না ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে, না বাসা ভাড়া নিতে, না ডাক্তার দেখাতে ইত্যাদি।

যা হোক, টিকিটিং সিস্টেম নিয়ে বলি। ডেনমার্কের টিকিটিং ব্যবস্থায় কিছু অ্যাডভান্সমেন্ট এসেছে। এটা হচ্ছে, ওয়্যারলেস স্মার্ট কার্ড। বাস, ট্রাম, ট্রেন যেটাই ব্যবহার করা হোক, ওঠার ও নামার সময় কার্ড ছোঁয়াতে হবে। আরও অ্যাডভান্সড যেটা এসেছে, সেটা হলো মোবাইল অ্যাপ। যে কেউ অ্যাপের মাধ্যমে ঘরে বসেই টিকিট কেটে ফেলতে পারেন। ভ্রমণের নির্দিষ্ট সময়ের আগে অ্যাপে টিকিট ক্রয় করলে রয়েছে ডিসকাউন্ট। এটাকে অরেঞ্জ টিকিট বলে। ডেনমার্কের বাস-ট্রেনও সিসিটিভির আওতায়। জনগণ যেহেতু টিকিট কেটে পরিবহন ব্যবহার করেন, বিনিময়ে পান আন্তরিক যাত্রী সেবা, বিনা মূল্যে ইন্টারনেট, ঝকঝকে টয়লেট, পরিচ্ছন্ন কেবিন ইত্যাদি।

আচ্ছা সবাই কি এই ভদ্রতার খাতিরেই টিকিট ক্রয় করে? না, কেউ কেউ ভয়ে করে। দুই মিনিটের বাস জার্নি। টিকিট না করলেও চলে। কিন্তু তবুও ক্রয় করে। কেন? কারণ জরিমানা। জরিমানা কী রকম—ধরি টিকিটের দাম ১০০ টাকা। জরিমানা হবে ১০ হাজার টাকা। প্রথমবার ধরা পড়লে এই পরিমাণ। পরেরবার ধরা পড়লে দ্বিগুণ হবে এবং পর্যায়ক্রমে জরিমানার পরিমাণ বাড়তে থাকবে। জরিমানা করার জন্য কিছুই করার দরকার নেই। শুধুমাত্র সেই ব্যক্তির আইডি নম্বরটা জানত হবে। জরিমানা অটোমেটিক তার নামে লিপিবদ্ধ হয়ে যাবে।

দুনিয়া আসলেই কত সহজ হয়ে গেছে। আচ্ছা আমাদের টোল প্লাজাগুলোতে কি টোল নেওয়ার জন্য জ্যাম তৈরি হয়? এটারও অটোমেশন করা যায়। গাড়ির উইন্ডশিল্ডের ও স্টিয়ারিংয়ের মাঝে ছোট্ট একটা ডিভাইস, দ্যাটস ইট। এতে করে রাস্তায় যান চলাচল বিঘ্ন হবে না। তোলাবাজি বন্ধ হবে।

লেখক
লেখক

টিকিটের ধরন আবার ভিন্নভিন্ন হয়। এই যেমন কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ড ঘুরে এলাম। সেখানে আগে থেকেই মামা আমাদের জন্য দুই দিনের টিকিট কেটে রেখেছিলেন। একটি টিকিট, যেটা দিয়ে বাস, ট্রাম, সকল ধরনের রেল, ফেরি, জাহাজ সবকিছুতেই ভ্রমণ করা যায়। এটা পুরো সুইজারল্যান্ডের জন্য। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য কী দারুণ একটা ব্যবস্থা।

উন্নত বিশ্বে দিনের টিকিট, মাসিক টিকিট, বাৎসরিক টিকিট পাওয়া যায়। যার যেটা প্রয়োজন তিনি সেটা ক্রয় করবেন। কেউ যদি মাসিক টিকিট ক্রয় করেন, তবে খরচ অনেক কমে যায়। আর বাৎসরিক টিকিট ক্রয় করলে খরচ আরও কম। টিকিট ক্রয় অথবা ফুয়েল খরচ যেটাই হোক না কেন, যেহেতু জনগণ তার আয় থেকে ব্যয় করছে, তাই ডেনমার্কে বাৎসরিক ভ্রমণের ওপর রয়েছে ট্যাক্স মওকুফের সুবিধা।

জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা মোটাদাগে নিজ নিজ স্টেটে ফ্রি ট্রান্সপোর্ট উপভোগ করে। ডেনমার্কে ২৬ বছরের কম অ্যাডাল্টদের ভাড়া অনেক কম। এখানে বাসে অথবা ট্রেনে বসে কী কী খাওয়া যাবে, কী কী যাবে না সেটা উল্লেখ করা আছে। ব্যতিক্রম ঘটলে, ড্রাইভার ব্যবস্থা নেবেন। টিকিটের মূল্য অনেক সময় সিটির ওপর নির্ভর করে। যেমন, ইতালির ভেনিসে একজনের ২৪ ঘণ্টার টিকিট ৩০ ইউরো। সেই একই টিকিট রাজধানী রোমে ৪৮ ঘণ্টার জন্য ১২ দশমিক ৫ ইউরো। একেক দেশের একেক পলিসি। আমাদের উচিত বেটার পলিসিগুলোকে অ্যাডাপ্ট করে নেওয়া। এসব অ্যাডাপ্ট করা তখনই সম্ভব হবে যখন পুরো পরিবহন ব্যবস্থাকে একটি ছাতার তলায় আনা যাবে। আমরা কি পারব এমনটা করে দেখাতে?

বিভিন্ন দেশে খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগ করা নিয়ে আমরা প্রায়ই হাসি তামাশা করে সেই দেশকে ছোট করি। আচ্ছা, আমাদের ট্রেনগুলোর টয়লেট কী উন্নত হয়েছে নাকি আগের মতোই সারা এলাকায় মল ছড়িয়ে ছিটিয়ে বীরদর্পে এগোতে থাকে? আমাদের ইন্টারসিটি বাসে একটা বড় সমস্যা, টয়লেট নেই। বিশেষ করে যাদের সকালে ঘুম ভেঙে টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস, তারা রাতে জার্নি শুরু করলে ভোরে বা সকালে কেলেঙ্কারি অবস্থা হয়। আচ্ছা, বাদুড়ঝোলা হয়ে বাস, ট্রেনের ছাদে চড়ে ভ্রমণ কি বন্ধ হবে না? আমাদের উচ্চপর্যায়ে কেউ কি নেই যিনি এগুলো নিয়ে ভাবেন, কথা বলবেন, সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবেন?

ড. মো. নাহিদুল ইসলাম: ওডেন্স, ডেনমার্ক। ফেসবুক: <nahidul.atique>