নন্দিত জাপান নিন্দিত জাপান

ছবি দুটি দেখুন। তামাচান ও মারুফ। ওরা দুজন। দুজনই জাপানে অভিবাসী। তামাচান সামুদ্রিক ম্যামালস প্রজাতির সিল (seal) গোত্রের সামুদ্রিক প্রাণী আর মারুফ আবদুল্লাহ ভাগ্যান্বেষণে বাংলাদেশ থেকে আসা একজন অভিবাসী। তামাচানকে জাপানের প্রতীকী নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ অভিবাসী মারুফকে হাতে হাতকড়া পড়িয়ে কোমরে রশি লাগিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।

প্রশান্ত মহাসাগরের বোরিং প্রণালি থেকে ভেসে আসা সিল ২০০২ সালের ৭ আগস্ট টোকিওর অদূরে মারুকো সেতুর নিচে তামা নদীতে ভেসে ওঠে। তামা নদীতে আশ্রয়স্থল বলে নামকরণ করা হয় ‘তামাচান’। তামাচানকে নিয়ে সারা জাপান জুড়ে সে কী উত্তেজনা! কয়েক দিন পর তামাচান অদৃশ্য হয়ে আবার ২০০৩ সালের এপ্রিলে টোকিও পার্শ্ববর্তী সাইতামা জেলার আসাকার ‘আরা‘ (arakawa) নদীতে ভেসে ওঠে। তখন তামাচানকে নিয়ে সে কী মাতামাতি! একনজর দেখতে হাজার হাজার মানুষ সেখানে জমায়েত হন। তামাচান প্রতি মুহূর্ত কী করছে তা নিয়ে লাইভ ব্রডকাস্টিং।

পরে তামাচানকে প্রতীকী নাগরিকত্ব দেওয়া হলো। গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ পেল। অথচ ভিসা প্রত্যাশী মারুফকে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি নিয়ে আজ হাসপাতাল, কাল কোর্ট, পরশু জেলের জাবর কাটতে হচ্ছে।

জাপানকে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কিছু আমরা নিয়মিত পড়ি ও শুনি। এত কিছু ভালোর মধ্যেও কিছু কিছু মন্দ দিক যা আলোচনার বাইরে থেকে যায়। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভেসে আসা সিল মাছের জন্য জাপান ঘটা করে নাগরিকত্ব দেয় আবার দশ-বিশ বছর জাপানে শ্রম দিয়ে কেবলমাত্র ভিসা না থাকার অপরাধে তাকে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়।

জাপানে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি মারুফ আবদুল্লাহকে কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া পরিয়ে (গত অক্টোবরে) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মারুফ জাপান ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে আটক একজন অভিবাসন প্রত্যাশী। একজন undocumented allian. তিনি চোর নন, খুনি নন, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নন। তার অপরাধ, তার বৈধ কাগজপত্র নেই। হয়তো বৈধভাবেই এসেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর অবৈধ হয়ে গেছেন। তিনি বৈধ হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। আবেদন গৃহীত না হলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে এটাই রীতি। বিশ্বব্যাপী অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এটিই রুটিন নিয়ম।

স্পিডবোটে ওপর বসে আছে তামাচান
স্পিডবোটে ওপর বসে আছে তামাচান

অভিবাসন আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে জাপানের আইন ভীষণ সেকেলে, অনড়, অমানবিক ও কোনোরকমে সংস্কারের উদারতা দেখাতে অপরাগ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে অবৈধ শ্রমিকদের আইনি সংস্কার করে বিশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতার ব্যবস্থা করা হয়। ভাগ্যহীন অবৈধ অভিবাসীদের অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতির (temporary stay permission) ব্যবস্থা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কোমরে দড়ি বেঁধে, হাত করা পরিয়ে তাকে কেন হাসপাতালে নিতে হবে? বিশ্বমানবতা নিয়ে জাপানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যথেষ্ট উদার পরিচিতি আছে। অথচ নিজ দেশে একজন অভিবাসীর প্রতি চরম অমানবিকতার কী জবাব?

আশাহি ওডা নামের একজন মানবতা কর্মী জাপানে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আটকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি ভিকটিমের অনুমতি নিয়ে তার ছবিটি তোলেন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন। জাপান টাইমস ফলোআপ রিপোর্ট প্রকাশ করে।

মারুফ চান, আটক অভিবাসীদের সঙ্গে কী অন্যায় আচরণ করা হয় তা জনগণ জানুক। তার ভাষায়—‘বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমি অপরাধী নই। হাতকড়া ও দড়ি পরানোকে চরম অপমানজনক বলে মনে করি।’

মারুফের ছবি প্রকাশের পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির অভিবাসন কেন্দ্রগুলোতে আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে এমন দুর্ধর্ষ অপরাধীর মতো আচরণ মেনে নিতে পারছেন না অনেকে।

জাপান টাইমসে প্রকাশিত রিপোর্ট
জাপান টাইমসে প্রকাশিত রিপোর্ট

বাংলাদেশ সরকার কি একজন প্রবাসীর প্রতি অপমানকর এই অমানবিক আচরণের জন্য প্রতিবাদ জানাবে? দূতাবাসের শ্রম কর্মকর্তা তার সঙ্গে দেখা করে নিরেট সহানুভূতিটুকু কি জানাবেন?

উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৯৫ সালে এক আসামিকে হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালে নেওয়ায় ওই বিবাদীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ওসাকা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট। বলা হয়েছিল, ওভাবে বেঁধে নিয়ে যাওয়ায় আসামির ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। পরে আদালতের ওই রুলটি বহাল রাখে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।

এই আইনের আওতায় দূতাবাস অথবা কোনো মানবিক সংস্থা মারুফের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারে। আমরা কেউ কি অভাগা মারুফের পাশে দাঁড়াতে পারি?

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>