ক্ষণকাল বৈশাখী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আকাশে কাজল মেঘ। নতুন চুনকাম করা কলেজ ভবনটা চকচকে রূপালি সাটিন হয়ে উঠেছে। ঢং ঢং করে কলেজের ঘণ্টা বাজতেই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে ওঠে অনিরুদ্ধের। এ সময় ঘরে থাকলে চোখ বন্ধ করে নিশ্চিত দিদির হাত চেপে ধরে পায়ের কাছে বসে থাকত সে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে আজ। এখন আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। থমথমে আকাশের আয়নায় দিদির অসহায় উৎকণ্ঠিত চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পায় সে।

কলেজ চত্বরের কোণে লম্বা ছাপড়ার নিচে আধখোলা ক্যানটিন। ক্লাসের অবসরে ছাত্রছাত্রীদের আড্ডা জমে এখানটায়। কলেজ ভবন থেকে নেমে পায়ে-পায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায় স্নাতকের ছাত্র অনিরুদ্ধ। নতুন ভর্তি হয়েছে কলেজে। এখানকার আবহ পরিবেশ বুঝে নিলে হয়তো একটু সহজ হতে পারবে সে।

বরাবর দিদির কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছে অনিরুদ্ধ। কলেজে আসার আগে দিদি তাকে মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছেন, এখন বোশেখ মাস, সামান্য মেঘ করলেই যেন বাড়ি ফিরে যায় সে। দিদির কথাটা তার মনে আছে। কিন্তু ঝুপ ঝুপ করে নেমে আসা পায়রাকে মাঠের সবুজে চড়তে দেখে তার আর ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশ দেখা হয়নি।

ছাপড়ার প্রত্যন্ত কোণে একটি ফোল্ডিং চেয়ার টেনে নিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় অনিরুদ্ধ ক্যানটিনের কর্মকাণ্ডে। মাঝখানে গোটা কয়েক টেবিল জোড়া দিয়ে আয়তাকার হয়ে আসর জমিয়েছে কিছু ছাত্রছাত্রী। আশপাশে দু-একটি টেবিলে কেউ কেউ বাসি দৈনিকের ঘোলাজলে অলসভাবে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে ভরপেট মাছরাঙার মতো। দূরে দু-একজন সুশীল ছাত্রের সঙ্গে নিশ্চিন্তে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চলেছে কিছু নিরুপদ্রব মাছি।

ক্যানটিনে হইচই আছে। টুকরো টুকরো অনেক অগোছালো সংলাপের ভেতর থেকে বারবার ভেসে আসছে একটি সাধারণ নাম—উষা। আটপৌরে হলেও শতমুখে এই নামটির প্রাচুর্য ভালো লাগে না অনিরুদ্ধের। উদাসীনভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় পায়রাগুলোর দিকে। চা-পানে অভ্যাস নেই তার। তাই ট্রাইশো থেকে একটি আইসক্রিম সংগ্রহ করে নিজ আসনে ফিরে আসে সে। এবার লক্ষ্য করে, বহুল উচ্চারিত নামের সেই নেত্রী গোছের মেয়েটি একরকম স্থিরদৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই সে চেয়ার ঘুরিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় কলেজ ভবনের দিকে।

আকাশের অবস্থা দেখে গনগনে চুলো নেভানোর ব্যস্ততার মধ্যেও একজন বেয়ারা এসে হেঁড়ে গলায় সাবধান করে দেয় টেবিলের সবাইকে, ‘আপনেরা দালানে গিয়ে উঠেন, ঝড় আসতিছে।’ নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল ক্যানটিন, শুধু উৎসুক সেই মেয়েটি বিক্ষিপ্ত চেয়ার টেবিলের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এল তার দিকে। কাছে এসে গভীরভাবে তাকাল তার ঝড়-বিহ্বল চোখের দিকে। ধীর শান্ত গলায় অনুরোধ করে বলল, 'কিছু মনে না করলে আইসক্রিমের শেষটুকু কি আমি পেতে পারি?’

অদ্ভুত ব্যবহারে মৃদু হাসল অনিরুদ্ধ, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই, এই নিন, কিন্তু কারণটা কি আমার জানার অধিকার আছে?’

‘হ্যাঁ, কারণটা আপনিও জানেন, হয়তো এখনই ঝড় উঠে আসবে আর সেই ঝড়ে এই ছাপড়াটি ভেঙে পড়বে আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মতোই।’

দুই.

আইসক্রিম ফ্যাক্টরি! বিন্দুবিসর্গ কিছুই বুঝল না অনিরুদ্ধ। শুধু কোথাও একটু খটকা লেগে বর্তমানটা তার এলোমেলো হয়ে পড়ল। সংশয়ের সূত্র খুঁজতে খুঁজতে কলেজ ভবনের দূরবর্তী কোণের দিকে পা বাড়াল সে। পেছনে না তাকিয়েও অনুভব করতে পারল, গৌণ অস্তিত্বে মেয়েটি ঠিক তার পেছনেই হেঁটে আসছে। ভবনের বারান্দায় উঠতেই প্রচণ্ড বেগে এক নিশ্বাস দমকা হাওয়া বয়ে গেল ঝড়ের। মাঠের পায়রাগুলো উড়ে গিয়ে বসল দোতলার রেলিংয়ে। মুহূর্ত পরেই মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল ছাপড়ার ক্যানটিন। ভেতর থেকে ক্যানটিনের কর্মচারীদের আর্তচিৎকার ভেসে আসতেই সজোরে পার্শ্ববর্তিনীর হাত চেপে ধরল অনিরুদ্ধ। মট মট করে ভেঙে পড়ল তার কাচের চুড়ি। কিন্তু এই অভূত ব্যাপারটা সহজভাবে মেনে নিল মেয়েটি, অভিযোগ অনুযোগ করল না, যেন এমন হওয়াটা ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক।

একটু পরেই ঝড়ের প্রকোপ কমে গেল, শুরু হলো বৃষ্টি। সংবিৎ ফিরে পেয়ে বিনীত ক্ষমা চাইল অনিরুদ্ধ। ‘দেখুন, আমি এক প্রকার সহজাত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’

‘আমি তা জানি রুদ্ধ, সেই কৈশোর থেকেই, সে কারণেই তোমার পেছন পেছন হেঁটে এসেছি।’

তিন.

রুদ্ধ নামটি শুনে চমকে ওঠে অনিরুদ্ধ। তার চোখের সামনে থেকে কলেজ ভবনের বিশাল কলেবর মুছে গিয়ে জেগে উঠল কৈশোরের স্কুলগৃহ।

ঢং ঢং করে ছুটির ঘণ্টা বাজতেই এক ছুটে খেলার মাঠ পার হয়ে কাজল মেঘ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে রুদ্ধ। না, কালবৈশাখী মেঘ দেখে ভয় পায়নি সে। এমন মেঘ দেখে প্রথম যেদিন সে ভীত হয়ে দিদির কোলে মুখ লুকিয়েছিল সেদিনই জেনেছে, এমনি এক ঝোড়ো বিকেলে তার জন্ম হয়েছে গ্রামের বাড়িতে, উঠানের প্রসূতি ঘরে। সে ঘরের চাল উড়ে গেছে ঝড়ে, ঢেউটিনে টুকরো হয়েছে মায়ের শরীর, তবু শিশুটিকে কেড়ে নিতে পারেনি।

স্তম্ভিত কালবৈশাখীর দিকে রুষ্ট চোখে তাকাল সে। এখন সে আর সদ্যঃপ্রসূত ছোট্ট শিশুটি নয়, অনেক বড় হয়েছে, নিক না উড়িয়ে তাকে! সদর রাস্তা পার হয়ে সুরকি ঢালা গলিপথে ছুটছে অনিরুদ্ধ। সিকি মাইল দূরেই বিস্তৃত নারকেল বাগান। বাগানের ধার ঘেঁষে গলিপথ সোজা গিয়ে মিশেছে এক পুরোনো চৌচালা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে। সেখানেই অপেক্ষা করছে উষা। কাল বিকেলে খেলা শেষে কথা হয়েছে, উষা আজ তাকে আইসক্রিম কিনে খাওয়াবে। এ কথা ভাবতেই লাল স্যাকারিন আইসক্রিমের শীতল ঘ্রাণটা তার নাকে এসে লাগে।

কিন্তু এমন ঝড়ের দিনে ভয় পেয়ে উষা যদি না আসে তাহলে! মনে মনে রেগে যায় সে, কাল তবে জন্মের আড়ি নিয়ে নেবে। কিন্তু সঠিক কোন আঙুলে যে জন্মের আড়িটা নিতে হয় ভেবে স্থির করতে পারে না সে। টিফিনের ছুটিতে স্কুলের গেট থেকে কেনা বৈঁচির মালাটা ফেলতে গিয়েও অন্য হাতে সরিয়ে নেয় সে। ছুটতে ছুটতে আসন্ন আড়ির মুদ্রাটা ঝালিয়ে নিয়ে একপ্রকার স্বস্তি বোধ করে সে।

চার.

গলি সোজাসুজি ফ্যাক্টরির বারান্দায় খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে অভিমানে ফুঁসছিল উষা। আজ যদি রুদ্ধ না আসে তবে সে আর জীবনে কোনো দিন আইসক্রিম খাবে না। মুঠি খুলে জমানো পয়সাগুলো দেখে সে, ইচ্ছে হয় ফেলে দিতে। ‘আজ ও আসবে না’ কথাটা ভাবতেই বুকে ভেতরটা মুচড়ে ওঠে উষার, অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে গলিপথে।

বইখাতা জামার ভেতরে ঢুকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে একটি ছেলে। ঝড়ের পূর্বাভাস দেখে ফ্যাক্টরির দরজা-জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে কর্মচারীরা। মেয়েটিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন এসে বলে, ‘বাড়ি ফিরে যাও খুকি, ঝড় আসছে।’ সে কথা উষাকে স্পর্শ করে না, তার দৃষ্টি গলিপথে, ছুটন্ত কায়ার দিকে।

একলাফে বারান্দায় উঠতেই ফ্যাক্টরির দরজা খুলে বের হয়ে এল উষা, হাতে স্যাকারিনের দুটি লাল আইসক্রিম। তার চোখে জল, ‘আমি জানতাম তুই আসবি রুদ্ধ।’ রুদ্ধ একহাতে আইসক্রিম নেয় আরেক হাতে তার ববকাটা চুল ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়।

একরাশ ধুলা উড়ে গেল বারান্দার ওপর দিয়ে। আইসক্রিমে জিভ বুলাতে গিয়ে কিচিকিচে ধুলোর অনাহূত স্বাদে কাঁটাগাছে ভরে গেল তাদের শরীর। নারকেল বাগানের ওপর দিয়ে ডান কাত হয়ে তীরবেগে ভেসে গেল একঝাঁক কাক-চিল। মট মট করে উঠল ফ্যাক্টরির চৌচালা।

রুদ্ধের হাত ধরে উৎকণ্ঠিতভাবে উষা তাকে টেনে নামাল বারান্দা থেকে, ‘চল বাগানে গিয়ে দাঁড়াই।’

রুদ্ধ ভীষণ বিভ্রান্ত, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কারপর বলে, ‘এখানেই থাকি দুজন, বাগানে নারকেলের বাখড়া, ঝুনো নারকেল পড়ে মাথা ফেটে যাবে।’

উষা টেনে হিঁচড়ে তাকে বাগানের দিকে নিয়ে চলেছে পাগলের মতো। রুদ্ধ তার চুল ধরে সজোরে কিল বসিয়ে দিল পিঠে। ‘উহ কী নিষ্ঠুর...’ ককিয়ে উঠল উষা। তার চোখে জল এসে গেল কিন্তু তবু হাত ছাড়ল না রুদ্ধের। দুজন ঢালু এক নারকেল গাছের নিচে পৌঁছতেই ফ্যাক্টরির চালাঘর ধসে পড়ল মড়মড় করে। ঝড়ের শব্দ ভেদ করে ভেতর থেকে কর্মচারীদের চিৎকার ভেসে আসতেই উষাকে আঁকড়ে ধরল রুদ্ধ, ‘আমরা বেঁচে আছি উষা।’ হাত ছাড়ল না উষা, মনে হলো তার, যুগ্ম নিরাপত্তাবোধ যেন অনেক অনেক বেশি। দুটি ছোট্ট হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ঝড়-মত্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দিল কী ভীষণভাবে বেঁচে আছে আছে তারা।

ঝড় শেষ হলো কয়েক মিনিট পরেই, বৃষ্টি তখনো ঝরছে। আশপাশের কিছু লোক ধ্বংসস্তূপের মাঝখান থেকে টেনে বের করছে ক্ষতবিক্ষত অর্ধমৃতদের, তাদের গায়ে যেন লেগে আছে লাল স্যাকারিন। খেয়াল হতেই তাকিয়ে দেখল রুদ্ধ, আইসক্রিম গলে গেছে, হাতে রয়ে গেছে আইসক্রিমের কাঠি, ফ্যাকাশে লাল।

পাঁচ.

কলেজের বারান্দায় রুদ্ধের আঁকড়ে ধরা হাতে বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উষা। ভেঙে পড়া ক্যানটিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিছু ছাত্র। উষার মনটাও মুহূর্তে তার হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে চায় স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে, কিন্তু রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আর যেতে পারে না। চুড়ি ভেঙে উষার হাত কেটে গড়িয়ে পড়ছে এক ফোঁটা লাল রক্ত। রুদ্ধের যন্ত্রণার আকাশ থেকে নোনা জল ঝরে ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে রক্তবিন্দুটা।
...

জায়েদ ফরিদ: রিয়াদ, সৌদি আরব।