কুষ্টিয়ায় কিছুদিন

মূল কুঠিবাড়ির প্রবেশদ্বার। ছবি: প্রথম আলো
মূল কুঠিবাড়ির প্রবেশদ্বার। ছবি: প্রথম আলো

রবির বাড়ি যেতে তৃষিত ছিলাম কত দিন! রবি মানে আমাদের কথায়, গানে, কবিতায়, গল্পে যেজন বাস্তবিক রবি হয়েই নিরন্তর আলো দিয়ে যাচ্ছেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনে সাধ ছিল তার কুঠিবাড়িতে কিছু সময় কাটাব কোনো দিন। কিন্তু তা যদি সত্যিই ঘটে যায়, সেদিন আমার কী অনুভূতি হবে তা ভেবে কুলোতে পারিনি।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ব্যাপারটি একদিন সত্যি সত্যি ঘটল। যেদিন ঘটল, সেদিন আমাদের গাড়িটা কুঠিবাড়ির সীমানা ঘেঁষে যাচ্ছে। কিছু দূরেই লাল রঙা সেই স্বপ্ন দালানের হাতছানি। আমাদের গাড়িচালক দেখি সেই দালান পাশ কাটিয়ে অন্য পথ ধরলেন।

চালককে বললাম, হায় হায় ড্রাইভার সাহেব কী করেন! অন্য রাস্তায় কেন?

আমাদের শামিম নামের অতি ভালো মানুষ গাড়িচালক মিষ্টি হেসে বললেন, স্যার আগে পদ্মার পাড় ঘুরিয়ে আনি। না হলে পরে রোদ উঠে যাবে, নদীর পাড়ে ঘোরার আর পরিবেশ থাকবে নানে।

‘পরিবেশ’ শব্দটা ব্যবহার করা ওনার একটা মুদ্রাদোষ। গত দুই দিন ওনার সব কথায় পরিবেশ শব্দটি শুনে অভ্যস্ত হয়েছি এবং এখন বেশ ভালো লাগছে।

পদ্মা পাড়ে গেলাম এবং একটা বড়সড় ধাক্কা খেলাম। রাজশাহীতে, রাজবাড়ীতে পদ্মা আমি দেখেছি। বিভিন্ন মুভিতে কত জায়গার পদ্মা দেখেছি। কিন্তু এত পূর্ণ পদ্মা, এত উত্তাল পদ্মা, এত ঘূর্ণি নাচন পদ্মা তো কোথাও দেখিনি।

ড্রাইভার সাহেব বললেন, তা স্যার পরিবেশটা হচ্ছে, এটা তিন চারটা নদীর জংশন।

কোন কোন নদীর জংশন, এই প্রশ্নের জবাবে বললেন, পদ্মা, গড়াই এবং ইত্যাদি।

যা হোক, যত ইত্যাদি নদীর সংযোগে এই উত্তাল পরিবেশ হোক না কেন, সেটার বিস্তারিত খবরে আমার কাজ নেই। আমি শুধু এই উত্তালতার পাশে একটু বসতে চাই। একটু ভেবে দেখতে চাই, শতবর্ষ আগে আরও কত বেশি ফেনিল ছিল এই পদ্মা পাড়ের জল। ঘনঘোর কোনো বর্ষা দিনে, মেঘের ছায়ায় ঢাকা সেই উত্তাল কৃষ্ণ রং জল ভেঙে পদ্মা বোট এসে যখন ভিড়ত এই পাড়ে, আমার কেন যেন মনে হয়, সেদিন, সেই সৌম্য তরুণ বোটের ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসতেন না। তিনি হয়তো বোটের পাটাতনেই দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতেন। ভরা পদ্মার রুদ্ররূপ আর একটিবার দুই চোখ মেলে দেখে নিয়ে আস্তে করে নেমে আসতেন পাড়ে। এ কালকে সেকাল ভেবে নিয়ে, পদ্মায় পা ডুবালাম আমি আর ঊর্মি। স্রোতের বড় টান। পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে দু–চারটি জলজ গুল্ম!

যে সময়ের পদ্মা পাড়টি আমার অদেখা, যে পদ্মা বোট আমার অধরা, সে অদেখা অধরা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভাব বিলাস চালানো যেত। কিন্তু ড্রাইভার সাহেব তাড়া দিলেন যে, এখনই নাকি কুঠিবাড়িতে যাওয়ার সবচেয়ে উত্তম পরিবেশ।

কুঠিবাড়ির সম্মুখ দরজার কাছে বসে আছেন এক কুলফি বিক্রেতা। তার কাছে দুই পদের কুলফি আছে। কুলফিয়ে আম আর কুলফিয়ে খাস। কুলফিয়ে খাস, মানে স্পেশাল কুলফি দিয়ে তিনি আমাদের আপ্যায়িত করতে একান্ত ইচ্ছুক। ওটা না খেলে নাকি আমাদের কুষ্টিয়া আসাই বৃথা! আমি মিষ্টি তেমন খাই না। ঊর্মির জন্য সেই খাস বস্তুটি কিনে ঢুকে গেলাম কুঠিবাড়ি চত্বরে। সামনে তাকাব, এমন সময় সেই খাস কুলফির কিছুটা ঊর্মি দিল আমার মুখে পুরে। তীব্র ঠান্ডায় আমার মাথা দুলে উঠল, তবু বুঝলাম এটা আসলেই অন্য জিনিস। বাজারি আইসক্রিমের সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে না। একমুখ ঝাঁজালো শীতলতা আর অমৃত স্বাদ নিয়ে সামনে তাকালাম। সেখানে কুঠিবাড়ি আমার একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে।

দুই.

দোতলা বাড়ি। সেটি অতি বড় নয়, ছোটও নয়, ছিমছাম সৌষ্ঠব। বেশ কিছু বারান্দা, ঝুল বারান্দায় আর ঘরগুলোতে অনেক বেশি দরজা জানালা থাকায় প্রচুর আলো বাতাস খেলছে। ঘর বারান্দা সবখানে কত আসবাব, ছবি, কবির ব্যবহার্য কত উপকরণ। সবটা জুড়ে কবির সময়টি ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা। দোতলার ওপরে একটা চিলেকোঠা আছে। তবে সেটাতে যাওয়ার দরজা গত আট বছর ধরে বন্ধ।

একটা অক্টাগোনাল টেবিল ঊর্মির খুব মনে ধরল। দেখামাত্রই সে বলে উঠল, অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ আমি এই টেবিল নিমু!

অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ হচ্ছে তার বায়না করার নিয়মিত সুর!

আমি থুতনিতে হাত দিয়ে খুব সিরিয়াস হওয়ার ভাব ধরলাম। যেন সরকারের কাছ থেকে টেবিলটা কীভাবে নেওয়া যায় সেটা নিয়ে খুব ভাবছি।

কবিগুরুর ব্যবহৃত খাট: ছবি: প্রথম আলো
কবিগুরুর ব্যবহৃত খাট: ছবি: প্রথম আলো

কবির সময় বিচারে সেখানে কিছু যন্ত্রপাতির সমারোহে বেশ অবাক হয়েছি। ইস্পাতের ওয়াটার ফিল্টার, লন রোলার, লন মোয়ার এসব আছে সেখানে। লন মোয়ারটি দেখলাম নিউইয়র্কের চ্যাডবর্ণ অ্যান্ড কোল্ডওয়েল কোম্পানির। ভারতবর্ষে এসবের নিয়মিত ক্রেতা সেসময় তেমন থাকার কথা নয়। হয়তো কবি সরাসরি আমেরিকা থেকেই এসব কিনে এনেছেন। এটা সম্ভব এ কারণে যে, তিনি আমেরিকা থেকে কিছু কৃষিযন্ত্র কিনে এনে নওগাঁর পতিসরে চালু করেছিলেন বলে পড়েছি। কবি খুব বাস্তবমুখী ছিলেন আর প্রজাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কৃষিতে যন্ত্রায়ন চাইতেন।

জীবনের পড়তি বেলায় এসে কবি অনেক ছবি এঁকেছেন। বেশির ভাগই আত্মপ্রতিকৃতি। এ ছাড়া তাঁর ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কিছু ছবিও আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই সমস্ত চিত্রকলা বা ফাইন আর্টস আমার মোটা মাথায় কোনো দিন ঢোকে না। আমি বরং ফটোগ্রাফগুলোর দিকে মন দিলাম। ওসব আমার সঙ্গে অনেক বেশি কথা বলে।

একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। খুব ঘরোয়া, খুব আটপৌরে ছবি। ছবিটা এই কুঠিবাড়িরই কোনো ঘরে তোলা! তরুণ বয়সী কবিসহ মোট চারজন মেঝেতে পাত পেড়ে খেতে বসেছেন। এক পাশে একটা মেয়ে তালপাখা হাতে বসা। ঘটনাচক্রেই হবে, কবি ঠিক মাঝে বসেছেন মধ্যমণি হয়ে। তার গায়ে ঢিলেঢালা শ্বেত বাস, কোনো অজানা কৌতুকে তিনি ঘাড়টি একদিকে বাড়িয়ে হাসছেন। সামনে খাবার পরিবেশনকারীকে দেখা যাচ্ছে দাঁড়ানো অবস্থায়। পরিবেশনকারী অতি সুশীলা, অতি সুদর্শনা।

ছবিটির সামনে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উর্মি মুখ টিপে হাসছে, ঊর্মি বরাবর বলে আমি নাকি রূপের পাগল। আচ্ছা, রূপের পাগল কে নয়। রূপ কী কোনোই গুণ নয়!

তিন

কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এবার বাইরে চত্বরে মন দিলাম। বিশাল বিস্তার জুড়ে বাগান, দিঘি, টেনিস কোর্ট আরও কত কী। একটা স্পাইরাল স্টেয়ারকেস ভবনের ওপর থেকে নিচে নেমে এসেছে। ঊর্মি আর থাকতে পারল না, আবার শুরু করল, অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ আমি এই বাড়ি নিমু, নিমু, নিমুই!

অনেকগুলো বুড়ো ল্যাংড়া আম গাছ দেখলাম। গাছগুলোয় সাঁটা আছে, কবির স্মৃতিবিজড়িত গাছ। বালক বয়সে কবি দুরন্ত ছিলেন জানি, কিন্তু জানি না এই ভবনে তিনি বালক বয়সে কোনো দিন এসেছিলেন কিনা। এসে থাকলে এই গাছগুলোতে সারা দিনমান দাপাদাপি করে থাকবেন হয়তো!

চার.

কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এই সবগুলো জেলাতেই দেখলাম চাল কুমড়োর খুব চল। একটু গ্রাম এলাকা হলেই হলো, প্রতিটা বাড়ির চালে অন্তত বিশটা চাল কুমড়ো শুয়ে আছে। প্রতিটা চাল কুমড়ো আকারে বড় তরমুজের চেয়েও বড়।

আমাদের গাড়িচালক ব্যাখ্যা দিলেন, পরিবেশটা হচ্ছে এখানে কুমড়ো বড়ি খুব তৈরি হয়। এ ছাড়া চাল কুমড়োর নাকি লোকাল অনেক লোভনীয় রেসিপি আছে। দেশি ছোট মাছ দিয়ে পাকা চাল কুমড়োর কী এক রান্নায় নাকি টক টক কী একটা জাদুময় স্বাদ হয়। বর্ণনা দিতে গিয়ে উনি মুখ দিয়ে টকাস করে সুস্বাদের একটা শব্দ করলেন। আমারও জিভে জল এল!

এখানের কৃষকেরা অনেক ছাগল আর ভেড়া পালন করেন। ভেড়াগুলো দুই জাতের। একটা ছোট অন্যটা বড়। চালক বললেন, এখানের ছাগলগুলো অন্য যেকোনো এলাকার ছাগলের চেয়ে গুণে মানে সেরা। তার কথা আমার বিশ্বাস হলো। দেখেছি, তিনি বাজে কথার লোক নন। আর যেসব রেস্তোরাঁয় তিনি আমাদের নিয়েছেন, তাতে বুঝেছি উনি শৌখিন আর স্বাদ খুব ভালো বোঝেন।

পুরো এলাকায় প্রচুর কদম গাছ। গাছগুলোর চারপাশে বেড়া দেওয়া। কদম গাছের এত সযত্ন লালন দেশের আর কোথাও দেখিনি। শুনলাম, দেশের ক্যারাম বোর্ডগুলো কুষ্টিয়া থেকেই যায়। আর এই বোর্ড তৈরির অন্যতম উপকরণ হলো এই কদম গাছ।

কুষ্টিয়ার আবহাওয়া খুব গরম। এমনকি এই শরতের শেষে এসেও দিনের বেলা গরমে বাইরে বেরোনো দায়! দিনের বেলা তাই শহরটা থাকে সুনসান। শহরটা উদ্দাম হয়ে ওঠে সন্ধ্যার পর। মানুষে, রিকশায়, গাড়িতে রাস্তাগুলো এতটাই সরগরম হয়ে পড়ে যে, সে সময় রাস্তা পেরোনোর চিন্তা বাদ দেওয়াই ভালো। তার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো রাস্তার পাশে একটু পর পর যেসব চায়ের দোকান আছে সেসবে। গরুর খাঁটি দুধে চা পাবেন ওসবে। দোকানিসহ বেশির ভাগ মানুষ খুব ভদ্র ও আন্তরিক। এদের চেহারায় আশ্চর্য মিলও পেলাম। বেশির ভাগ ছেলেগুলোই শ্যাম, একহারা আর একটা মিষ্টি ভাব আছে তাদের চোখমুখে!

কোর্ট রেলওয়ে স্টেশনের কাছের রেস্তোরাঁগুলো ছিল আমাদের সন্ধ্যার পরের ঠিকানা। কাবাব, ভুনা মাংস, পরোটা এসব এত স্বাদু আর সস্তা আর কোথাও দেখলাম না।

ঊর্মি দেখি আবার সেই অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ সুর তুলছে! কী জানি বাবা, এবার সে পুরো কুষ্টিয়া কিনে নিতে চায় কিনা কে জানে!
...

হিশাম আল রাব্বী: আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ফিলিপাইনে অন জব ট্রেইনি হিসেবে কর্মরত।