আমার গ্রাম

কানাডায় লেখকের বাড়ির পাশের পার্কে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে তাঁর মেয়ে
কানাডায় লেখকের বাড়ির পাশের পার্কে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে তাঁর মেয়ে

আমার ছেলেবেলার প্রথম পনেরো বছর কেটে ছিল আমাদের গ্রামে। তারপর আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহরে আসি। এরপর আরও ষোলো বছর চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে থাকার পর আমি পাড়ি জমায় কানাডায়। এ বছর জুনে আমার কানাডার ষোলো বছর পূর্ণ হবে। এভাবে ষোলো ও ষোলো আমার বাংলাদেশ আর কানাডার শহরে কেটে গেছে, কিন্তু আমার স্মৃতিতে এখনো সেই প্রথম পনেরো বছর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে।

বাংলাদেশে কিছু ব্যবসার সুবাদে এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে এখনো প্রতি বছর একবার দুবার দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়। প্রতিবারই চেষ্টা করি কয়েক দিন গ্রামে থাকার। এখনো শহরের চেয়ে আমার সময়টা গ্রামেই বেশি ভালো লাগে, প্রধানত নির্মল বাতাস হাঁটতে পারার কারণে।

তা ছাড়া নেই তেমন কোনো গাড়ি আর যানবাহনের শব্দ। কিন্তু আজকে যে কারণে আমার লিখতে বসা তা হচ্ছে, একটা বিষয় আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলছে। গ্রামের রাস্তাগুলোর ধারে তাকালে আজকাল যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট অথবা মোড়ক।

পার্কে হাঁটা ও সাইকেল চালানোর জন্য পথ
পার্কে হাঁটা ও সাইকেল চালানোর জন্য পথ

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের গ্রামের বাজারে সব ধরনের পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরি হতো, যা এক ধরনের বাদামি কাগজের প্যাকেটে অথবা পুরোনো খবর কাগজের প্যাকেটে করে বেঁধে দিত। খাবারগুলো ছিল টাটকা ও সুস্বাদু। সেই সব দোকান এখন আর নেই। এখন সব ধরনের পাউরুটি ও বিস্কুট মূলত আসে শহর থেকে। আমি ধরে নিচ্ছি এই চিত্র বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই একই রকম। গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চিপস, চকলেট ও আরও অনেক চকচকে মোড়কের পণ্য গ্রামের মানুষের কেনার সামর্থ্য হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা যদি আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার দিকে নজর না দিই, তাহলে এসব ছড়ানো-ছিটানো প্লাস্টিকের মোড়কই আমাদের গ্রাস করে ফেলবে। শুধু তাই নয় আমাদের চারপাশের গাছপালা, আমাদের পশুপাখি আমাদের পুকুরের মাছ সবগুলোকেই ক্ষতি করবে।

লেখকের গ্রামের রাস্তার পাশে আবর্জনা
লেখকের গ্রামের রাস্তার পাশে আবর্জনা

কীভাবে আমরা কাজটা শুরু করব? প্রথমত, আজকে থেকে অঙ্গীকার করি আমরা কোনো মোড়ক পথে বা ফ্লোরে বা বাইরে ফেলব না। আমরা আমাদের ঘরে একটা মোড়ক জমানোর বিন বা বালতি রেখে সেখানেই সব মোড়ক জমিয়ে রাখব। এরপর মাসে একবার বা দুবার এসব জমানো মোড়ক আমরা গ্রামের সবাই মিলে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় প্রসেস করার জন্য পাঠাতে পারি।

আমাদের মানসিকতারও আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এখনো আমরা শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেকেই মনের অলক্ষ্যে কোনো ক্যানডি খেয়ে মোড়ক ফ্লোরে ফেলে দিই, বিশেষ করে যখন রাস্তায় হাঁটি। এ বিষয়ে আমাদের খুবই সচেতন হতে হবে।

এরপর যেসব মোড়ক ও প্লাস্টিক এখনো গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমরা স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা উদ্যোগ নিয়ে এগুলো পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করতে পারি। এ ছাড়া প্রতিটি গ্রামের চেয়ারম্যান ও মেম্বার বিভিন্নভাবে আমাদের গ্রামগুলোকে স্থায়ীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগে সহযোগিতা করতে পারেন। আমাদের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে অনুরোধ তারা যেন এসব পরিচ্ছন্নতার ওপরে নিয়মিত সচেতনতা তৈরি করে।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় একটি পরিচ্ছন্ন রাস্তা
চট্টগ্রামের পটিয়ায় একটি পরিচ্ছন্ন রাস্তা

আমি টরন্টো থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, মিলটন নামের এক ছোট শহরে থাকি। আমাদের বাসার পাশেই আছে একটা পার্ক, একটা ফুটবলের মাঠ ও একটা বাস্কেট বলের মাঠ। এই পার্কেই আছে পাঁচ-ছয়টা ময়লা ফেলার বিন। যা অনেকটা দেখতে ড্রামের মতো। এই বিনটা একটা প্লাস্টিকের পলিথিন মোড়ানো থাকে। ফলে যখনই কর্মীরা এগুলো পরিষ্কার করতে আসেন তারা সহজেই পুরো ব্যাগটা উঠিয়ে আরেকটা নতুন ব্যাগ ভেতরে সাজিয়ে দিতে পারেন। এই চিত্র প্রতিটা পার্কে একই রকম।

বছরের মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই পার্কে ছেলেমেয়েরা খেলতে পারে। বাকি সময় সাদা বরফে ঢাকা থাকে অথবা শূন্যের নিচে তাপমাত্রার কারণে কেউ পার্কে খেলতে আসে না। এখানের নির্মল বাতাস আমাকে এখনো আমাদের গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিশেষ করে যে সময়টা এখানে আমরা পার্কে খেলতে পারি না। আমার মনে হয় বাংলাদেশ কী ভাগ্যবান, আমাদের গ্রামগুলোতে সারা বছরই আমরা বাইরে খেলতে পারি, শুধু বর্ষার সময় অধিক বৃষ্টির দিনগুলো বাদ দিলে। আমরা যদি আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখি আমাদের গ্রামগুলো হতে পারে কানাডার শহরের মতো পরিচ্ছন্ন ও নির্মল বাতাসে ভরা।

আমার লেখাটা শেষ করতে চাই পবিত্র কোরআনের একটা আয়াতের অর্থ দিয়ে। সুরা বাকারা ২২২ আয়াত শেষে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং যারা নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখেন।’ আসুন আমরা আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশকে পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি।

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ: ইমেইল: [email protected]