দুবাইয়ে প্রাণের মেলায় বুয়েটের প্রকৌশলীরা

দুবাইয়ে প্রাণের মেলায় বুয়েটের প্রকৌশলীরা
দুবাইয়ে প্রাণের মেলায় বুয়েটের প্রকৌশলীরা

একজন তরুণী মা। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হলো একটি শাল। তিনি সম্মানিত বোধ করলেন। এক তরুণী। এইতো বিয়ের প্রথম দশও অতিক্রম করেননি। তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন সম্মানের শাল। আরেক প্রকৌশলী। নারী তিনি। সবার দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ালেন। অর্থাৎ সবাইকে সম্মান জানিয়ে তিনিও সম্মানিত হলেন। হাতে তাঁর গর্বের শাল।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের মামজার পার্ক। দৃশ্যটি সেখানকার। ২৫ জানুয়ারি এখানে মিলিত হয়েছিলেন দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা। তাঁরা এক জায়গায় হলেন, একে অন্যের সঙ্গে কথা বললেন, সময়টি আনন্দময় করে তুললেন।

দুবাইয়ে প্রাণের মেলায় বুয়েটের প্রকৌশলীরা
দুবাইয়ে প্রাণের মেলায় বুয়েটের প্রকৌশলীরা

আনন্দের শুরুটা যেন কখন! কখন, কখন? ওই যে যখন থেকে কবি জসীমউদদীন ঢেউ তোলেন তাঁর মামার বাড়ি কবিতা দিয়ে। ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই’ আমন্ত্রণটি চতুর্দিকে ছড়াতে থাকে। অনলাইনের যুগ। বুয়েটিয়ানস ইউএই গ্রুপের মধ্য দিয়ে সবাই জেনে ফেললেন। কেউ আমরা দুই, কেউ একজন লিখলেন। আরেকজন, আমরা দুই যোগ এক। হ্যাঁ, এই এক আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর। বয়সের সীমারেখা প্রয়োজন। আসতে থাকল যোগদানকারী প্রকৌশলীদের পারিবারিক অংশগ্রহণের চিত্রটি।

বিজয় কৃষ্ণ মণ্ডল কথা ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, কবিতা ভাবি চা না আনলে কাটতি। বন্ধুর আলাপে সবাই শিশু হয়ে যায়। ঝগড়া কিংবা খুনসুটি না করলে যেন সময়টি জেগে ওঠে না! অমনি ভাবির পক্ষে বললেন মজিবুর রহমান, কালো চা এক দিরহাম, সাদা চা দুই দিরহাম। আদা চা তিন দিরহাম। শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত স্টক থাকে। এই নিয়ে চলল কিছুক্ষণ।

গাছপালা আছে। ঘাসগুলো সবুজ। পাখিরা ডাকছে। চিক চিক করা রোদটিও বড় মিষ্টি। তাঁরা আসছেন এক এক করে। ভরে যায় এঁদেরই পছন্দের জায়গাটি। গল্প, একসঙ্গে হেসে ওঠা—চমৎকার একটি আবহ তৈরি করে।

গর্বের শাল
গর্বের শাল

একই পার্ক কিন্তু কিছুটা দূরে ওই গ্যালারি। ওখানে ক্বচিৎ প্রদর্শনীর আয়োজনও হয়ে থাকে। সে চিত্রও ভেসে ওঠে সবার সামনে। এক সময় আজানের ধ্বনি আসে। মুমিনরা নামাজ আদায় করেন। দীর্ঘ পথে কেউ পা বাড়িয়ে যেতে পারে আরও খানিকটা। নিশ্চিত, নির্ভাবনার একটি সময়। বারে কী শান্তি!

আয়োজনে অনলাইন কুইজ আসর পেতে বসে। এবার এ আসর ৩৬ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়েছে। প্রকৌশলী তাঁর নিজস্ব আইডি থেকে উত্তর করেছেন। সর্বোচ্চ সময় ৪০ মিনিট।

এই সময়ের বেশি সময় নিলে সে উত্তর বাতিল হয়ে যাবে। এ নিয়ম আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। জটিলতা পিছু ছাড়ে না। বুঝতে পারেন কুইজ মাস্টার ওয়াইজ মাহমুদ। একই অংশগ্রহণকারী ছদ্ম আইডি দিয়ে পাঁচবার অংশ নিয়েছেন। অন্য আইডির মাধ্যমে প্রশ্নগুলো জেনে আসল আইডিতে শতভাগ সঠিক উত্তর নিশ্চিত করার অবস্থা তৈরি করেছেন। কে, তা বলা হয়নি। তবে এই উত্তরপত্র বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

কুইনিনে জ্বর সারে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে! সংযত এ প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ভিসির মধ্যে সর্বশেষ কে বিদায় নিয়েছেন? সেখানে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন আহমেদ নামটি ছিল না। কুইজ মাস্টার বন্ধুর আলাপে প্রশ্নের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন।

গর্বের শাল
গর্বের শাল

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী একজন। তিনি অংশ নিয়েছেন এ প্রতিযোগিতায়। তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।

একটা রশি দিয়ে ক্ষেত্র বানালে কোনটিতে সবচেয়ে বেশি আয়তন পাওয়া যাবে? এর উত্তর কী চতুর্ভুজ, ত্রিভুজ না বৃত্ত! মূল গণিতের প্রশ্ন। চমৎকার আরও কিছু সংযোজন ছিল। খেলার ব্যবস্থাটি আয়োজনকে বেশ প্রাণবন্ত করে তোলে।

আল আইন, আবুধাবি থেকে প্রকৌশলীরা এক হয়েছেন এই পার্কে। এক বন্ধু যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরছিলেন। তিনি এলেন এখানে এই চত্বরে। এভাবে আয়োজনে নতুন নতুন পালক যুক্ত হয়েছে।

ভাবিরা, দিদিরা, বউদিরা গোলবারে ফুটবল মেরে গোল নিশ্চিত করেছেন। গো–ও–ল ধ্বনি দিতে কেউ কার্পণ্য করেনি।

ভ্রাতারা, দাদারাও বল খেলেছেন। ছোটরা বল ছুড়ে টেবিল থেকে পেপসির ক্যান ফেলে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। সে কী নিরিখ! নিরিখ বান্ধরে দুই নয়নে, নিরিখ বান্ধরে...। হ্যাঁ, ওদের লক্ষ্য ছিল পেপসির ক্যান।

গত বছরের সঙ্গে এবারের আয়োজনের তুলনা করা হয়েছে। পন্ড পার্ক ছিল ছোট। আকারে ক্ষুদ্র ছিল বলেই মুক্তভাবে বিচরণ করা সম্ভব হয়নি। এবার বিশাল জায়গা, পাবলিক পার্ক। প্রকৃতির দান থেকে অবশ্য কোনো পার্কই বঞ্চিত হয়নি। পাখির কলতান, স্নিগ্ধ সূর্যের হাসি, সবুজের সমারোহ।...সবাইকে রেখেছে স্বপ্নঘেরা পরিবেশে। আশ্চর্যজনক এক ব্যাপারই বটে। খাল এসে এক জায়গায় থেমেছে। এর নাম ক্রিক। ছোট নৌকায় ভেসে বেড়ানোর এমন সুযোগ কয় জায়গায় মেলে!

গানের মানুষ এসেছিলেন। কিন্তু গান হয়নি। এখানে হারমোনিয়াম, তবলা কিংবা গানের যন্ত্র আনা যায় না। তাহলে আসর বসে কীভাবে! চন্দনা মজুমদারের গান শোনা হলো না। তাতে কী, তিনি যে সবার সঙ্গে থেকেছেন। সবার ভালোবাসা নিয়েছেন, সবাইকে শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা জানিয়েছেন।

প্রাণের মেলায় নারীরা
প্রাণের মেলায় নারীরা

বালি রানি পোদ্দার কী উপহার দিলেন! তাঁর হাতে তৈরি ব্যঞ্জন কিংবা মিষ্টান্ন থেকে কোনো এক অনুষ্ঠান বাদ পড়ে না। সত্যটা অন্য জায়গায়। ফুড ভিলেজ নিজেই এ ক্ষেত্রে অন্নপূর্ণার দায়িত্ব নেয়। এরই অংশ হিসেবে সকালে ভাজি-পরোটা, ডিম, মিষ্টি ও চা। দুপুরে স্টিম রাইস, মাটন বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানি, সবজি-ডাল, মিষ্টি আর কোল্ড ড্রিংক। বিকেলে ছোলা মুড়ি, চা, কমলালেবু, সমুচা, শিঙারা। বিপুল সরবরাহ। এক শ দশজন মানুষের আয়োজনে সব উপকরণই ছিল অঢেল?

বাঙালি মালিকানার এই প্রতিষ্ঠানটির অবদান কম নয়। প্রকৌশলীরা এই এখানেই বসেছেন। আয়োজনকে সুন্দর করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছেন। দীর্ঘ সময় মিটিং চলেছে। সেখানে সাদরে আপ্যায়িত হয়েছেন সংগঠকেরা। সত্যি বলতে কী, তাঁরা এখানে বসেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কত সাবলীল হয়ে ওঠে তাঁদের মতবিনিময়। ওমর ভূঁইয়া টমেটো ও আমের চাটনি যুক্ত করার কথা বললেন।

আরেকজন যোগ করলেন, সবাই তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারবে। অন্যদিকে, এখানে বসেই তাঁরা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।

সুব্রত মজুমদার অংশগ্রহণকারীদের তালিকা প্রকাশ করার অনুরোধ করলেন। বলা হলো, কারও নাম বাদ পড়বে না। আয়োজন নিয়ে পিঠা ভাবনায় আমরা পাই একরাশ কাব্য কথা। কাজী আবদুল বারী কবির মর্যাদা আদায় করতে পেরেছেন।

শীত যত বেশি হবে, পিঠে খেতে মজা পাবে।
গরম পিঠের ভাপ উড়বে, ছোটরা ঘিরে ধরবে।

প্রাণের মেলায় নারীরা
প্রাণের মেলায় নারীরা

'ম্যাথ' নিয়ে কাজ কারবার। সে কথা ভোলেন না। এ বুঝি ঐকিক নিয়ম!

কাব্যময়, ঐক্যময়, প্রাণময় হয়ে ওঠে। এই জায়গাটাই সেই সুযোগ করে দিয়েছে। সবার কাছে এ জন্যই ফুড ভিলেজ ভালো লাগার।

অনলাইন সংযোগ বন্ধ থাকে না। বন্ধুত্বের বন্ধন যার নাম।

হারুন-অর-রশিদ এনার্জি প্যাক থেকে সাফল্য কামনা করেন। আগের বছর তিনি ছিলেন পুনর্মিলনীতে। এবার দেশে। তাঁর শূন্যতা বোধ করলেন সংগঠকেরা। কলিমুল্লাহ খান না আসতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, মামজার পার্ক স্মরণীয় হয়ে রইল।

ওসমান গনি বললেন, মরুর বুকে বুয়েটের প্রকৌশলীদের পুনর্মিলনী যেন এক মরূদ্যান। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে কেটে যাওয়া সুন্দর একটা দিন। মোহাম্মদ উল্লাহ বললেন, এ যে প্রাণের মেলা।

আহমেদ ইখতিয়ার আলম কবিতা পড়লেন, বুয়েট গ্র্যাজুয়েটরা মিলিত হলেন। ভ্রাতৃত্ববোধের অনন্য এক নিদর্শন গড়ে তুললেন। তাঁরা ছাত্রজীবনে ফিরে গেলেন। বাহ্, এ যে সবার কথা!

ওয়াইজ মাহমুদ কুইজ নিয়েই বলবেন। কারণ কুইজ তাঁর চর্চার বিষয়। পুনর্মিলনীতে কুইজ পর্বে অংশগ্রহণ ছিল উপস্থিতির ৩৩ শতাংশের কম। বলেন, মনে হয় এঁরা বুয়েট জীবনের ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবুও মন্তব্য, পুরস্কার পেয়ে তাঁদের হাসি ছিল আকর্ণ বিস্তৃত।

মজিবুর রহমান বলেন, সংগঠকদের স্বেচ্ছাসেবা পুনর্মিলনীকে উপভোগ্য করে তুলেছে। অনলাইনে আলমগীর হোসেন বলেন, তিনি কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন ভবিষ্যতে। তা কী কুইজ মাস্টারকে খুশি করার জন্য, পরিষ্কার করেননি।

সকালে এসেছেন সবাই। সারা দিন চলল আলাপ ও গল্প। ভালোবাসার সময় বুঝি তাড়াতাড়ি যায়! খেলায় ছিল ব্যস্ততা। হলো পুরস্কার বিতরণী।

চায়ের চুমুকে এ সময় অমৃতের স্বাদ আসে। কেউ কেউ চা দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন। শীত শীত, মিষ্টি মিষ্টি অনুভব!

এখন ভাঁজ ভাঙার পালা! নারীরা শাল এবার গায়ে জড়ালেন।

শাল সম্মানের, শীত থেকে রক্ষা পাওয়ারও। মিতা সাহা মিষ্টি শীতের মতোই বললেন।

সাঙ্গ হয় প্রাণের মেলা।

বিদায়ী বেহালা বুঝি এইভাবে বাজে। মনের মধ্য দিয়ে এর সুর চিন চিন করে বেয়ে চলে। সে যে কী অনুভব, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।