কানাডার বর্ণবাদবিরোধী কথাসাহিত্যিক

জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক
জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক

কানাডার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক সমকালীন সাহিত্যে এক ভিন্নধারার প্রবর্তক। তাঁর সাহিত্যকর্মের ভিন্নতা আফ্রিকান ইতিহাস এবং স্বতন্ত্র কৃষ্টিনির্ভর নান্দনিক ও জটিল বাস্তবতার আবহকে আমাদের অনুধাবন করতে শেখায়। একই সঙ্গে বিশ্ব দরবারে কানাডার সুবিধাবঞ্চিত কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের ওপর ঘটে যাওয়া বর্ণভিত্তিক নির্মম বিভাজন, হতাশার ইতিহাস ও অসন্তোষের চিত্রকে অসামান্য স্পষ্টতা দান করে। বর্ণবাদ ও মানবাধিকার হরণের নানা বিষয় তিনি দার্শনিক জীবন জিজ্ঞাসা, সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরে নানা প্রশ্নের অবতারণা করে ভিন্নধারায় হৃদয়গ্রাহী রূপ দিয়েছেন । তাঁর প্রণীত এই ধারা কানাডীয় প্রচলিত সাহিত্যে নব 'আফ্রিকাডিয়ান’ ধারা হিসেবে বিশেষভাবে নিজের এক আলোকিত আসন সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে তিনি বলেছেন মানবতার কথা। অকপটে তুলে এনেছেন বর্ণের বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি নিত্যদিনের নিগ্রহের ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের নির্মম দিকগুলো।

জর্জ এলিয়ট ক্লার্ককে বলা হয় কানাডীয় সাহিত্যের নব অধ্যায়ের পথিকৃৎ। সাহিত্যে অবদানের জন্য কানাডার সরকার তাঁকে ২০১৬ সালে দুই বছরের জন্য পার্লামেন্টের সভাকবি বা পোয়েট লরিয়েট হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানে অভিষিক্ত করে। পোয়েট লরিয়েট হিসেবে তাকে কয়েকটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। জর্জ এলিয়ট তাঁর কবিতা, উপন্যাস ও নাটকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বর্ণবাদের নির্মমতা ও কানাডীয় কৃষ্ণাঙ্গদের নিত্য জীবনধারা, রাষ্ট্র ও সমাজে কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের প্রতি বৈষম্যের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং একই সঙ্গে প্রকৃতি, মানবপ্রেম, যৌনতা, মানবাধিকার বিভিন্ন দিকের বৈচিত্র্যময় ও সফল সমন্বয় ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন রচনা সৃষ্টিতে সুনিপুণভাবে ও প্রাঞ্জল শব্দচয়নে চিত্রশিল্পীর মতো বর্ণিল ভাষার ও জীবনবোধের মাধুর্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কানাডার সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের হতাশা, বঞ্চনা, গ্রাম ও শহরের জীবনধারা, দারিদ্র্যপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জীবনের অপ্রাপ্তির বিস্তৃত এক উজ্জ্বল সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। যার প্রকাশ সাহিত্য অনুরাগী পাঠক মাত্রেই খুঁজে পাবেন তাঁর বিভিন্ন কবিতার উপমা, শব্দ, কাব্য ছন্দে।

জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক
জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক

কানাডার উইন্ডসর নোভা স্কোশিয়া অঞ্চলে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক। আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের সপ্তম প্রজন্মের একজন সদস্য হিসেবে জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের শৈশব অতিবাহিত হয় নোভা স্কোশিয়ার রাজধানী হালিফ্যাক্সে। তাঁর মা জেরাল্ডিন শিক্ষকতার একটি বিশেষ সার্টিফিকেট নিয়ে হালিফ্যাক্সে শিশুদের মানসিক উন্নয়নে একটি দিবাযত্নকেন্দ্র পরিচালনা করতেন। বাবা উইলিয়াম কানাডার রেলওয়ে বিভাগের সাধারণ একজন কর্মী ও বিশেষ এক শৈল্পিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি কাচ শিল্পের ওপর তেল রঙের প্রাধান্য এনে ও জল রঙের ছোঁয়ায় এক অসাধারণ বিমিশ্রণ ঘটিয়ে চিত্র শিল্পের এক বৈচিত্র্যময় প্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন। অবধারিতভাবে বাবা মায়ের কর্মজীবন ও সংগ্রাম ক্লার্কের সৃষ্টিশীল সত্তাকেকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার নানার পরিবারের সদস্যরা অন্য বর্ণের মানুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ছিলেন।

জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক মাত্র পনের বছর বয়সে ‘স্ক্রিবলিং পোয়েট্রি’ বা অনিয়মিতভাবে খানিকটা খাপছাড়াভাবে কবিতা লেখার অভ্যাসটি রপ্ত করেন। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের ইতিহাস সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা কাজ শুরু করেন। নিকট আত্মীয়দের প্রতি অত্যাচার, বৈষম্য, নিগ্রহ, অনাচার, মা-বাবার কাছ থেকে শোনা নানা বঞ্চনার ঘটনা, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রতি নিগ্রহের ইতিহাস ক্লার্কের মনকে সকল সময় বিশেষভাবে আলোড়িত করত। এই অনুভব থেকে তারই হৃদয়ে এক তাড়নার জন্ম দেয়। এভাবে বিকশিত হয় তার বর্ণবাদের ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস রচনা করার চিন্তা। সেই সময় তাঁর প্রকাশিত ‘সল্ট ওয়াটার স্পিরিচুয়ালস’ ও ‘ডিপার ব্লুজ’ সাহিত্যের মুখ্য বিষয়বস্তু হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি একাধারে সম্পাদক, আফ্রিকাডিয়ান সমাজধারার একজন সমাজকর্মী, অটোয়ার পার্লামেন্টের বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৯৩ সালে রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'হোয়াইলাহ ফলস’। পরবর্তীতে এ কাব্যগ্রন্থ আর্চবিল্ড লাম্পমান সম্মানে ভূষিত হয়।

জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক তাঁর কর্মময় ও বৈচিত্র্যময় সাহিত্য জীবনে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনার কাজ করেছেন। ১৯৯৩ সালের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর তিনি আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও কানাডিয়ান স্টাডিসের শিক্ষক নিযুক্ত হন। সেই সময় শিল্প সাহিত্যে তার বহুমুখী ও সর্বোৎকৃষ্ট অবদানের জন্য ‘পোর্শিয়া হোয়াইট এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ এবং 'রকফেলার ফাউন্ডেশন বেলাজিও ও সেন্টার ফেলোশিপ পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর ওই সময়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো তিনটি নির্বাচিত কবিতা সংকলন ও ‘এম্পটিন এসেস’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ।

জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের সঙ্গে লেখিকা
জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের সঙ্গে লেখিকা

১৯৯৯ সালে আমেরিকা থেকে কানাডায় প্রত্যাবর্তনের পর পরিচালক ক্লিমেন ভার্গো পরিচালিত তার রচিত গীতিনাট্য ‘ওয়ান হার্ট ব্রোকেন’ কানাডার সিবিসি টিভিতে প্রদর্শিত ও লেখক পুরস্কারে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি সাড়া জাগানো কাব্যসংগ্রহ 'এক্সকিউশন পোয়েমস’। এটি কানাডার গভর্নর জেনারেল অ্যাওয়ার্ড ও ন্যাশনাল ম্যাগাজিন গোল্ড অ্যাওয়ার্ডে সম্মানপ্রাপ্ত হয়। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় তার গ্রন্থ ‘ওডিসিস হোম: ম্যাপিং আফ্রিকান কানাডিয়ান লিটারেচর’। এই গ্রন্থটি ২০০৪ সালে ‘মার্টিন লুথার র কিং জয়েন্ট অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ ও ২০০৫ সালের ট্রুডো ফেলোশিপ পুরস্কারে ভূষিত হয়।

অনন্য প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্ব বর্তমানে কানাডীয় সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। তিনি পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কানাডীয় সাহিত্যে তার অসামান্য অবদান রেখা চলেছেন। অনুপ্রাণিত করছেন অগণিত পাঠক, সমাজকর্মী, সমসাময়িক ও নবীন কথাসাহিত্যিকদের। সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেছেন সম্মানসূচক অনেক ডিগ্রি। ২০১৭ সালে হালিফ্যাক্সের ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট বা ‘আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে’ ভূষিত করে।

কানাডার নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের বর্ণবাদের প্রেক্ষাপটে জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘জর্জ অ্যান্ড রু' প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। এ উপন্যাসে তিনি সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক বাস্তবধর্মী প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। উপন্যাসটির প্রথম ভাগে দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষা ও সুবোধনির্ভর চেতনা বঞ্চিত বাবা-মার নানা জটিল সম্পর্কের আবর্তে একটি পারিবারিক কাঠামো চমৎকার উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। প্রথমভাগে মৃত্যু আর সমাপ্তিতেও মৃত্যুর উপস্থাপন ভগ্ন এক সমাজ কাঠামোর দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কথাই ইঙ্গিত করে। একই সঙ্গে অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহীন হয়ে বর্ণ বিভাজন আর হতাশা ও বঞ্চনার আবহে বেড়ে ওঠা, মৌলিক অধিকার বঞ্চিত দুই ভ্রাতার কথা আলোচনা করার সময় এলিয়ট ক্লার্ক ইতিহাসের নানা প্রাসঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহকে উপজীব্য করে অবতারণা করেছেন নানা দার্শনিক চিন্তানির্ভর নৈতিক প্রশ্ন। এই উপন্যাস রচনায় নেপথ্যে কয়েকটি দিক সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। সেই দিকগুলো হলো নিজেরদের ঐতিহাসিক বঞ্চনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কোনো রচনা সৃষ্টির একটি তাগিদ আর মা ও নিকটজনদের সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথন এবং যাপিত জীবনের বৈষম্যের নিত্য পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।

জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের ‘জর্জ অ্যান্ড রু’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ
জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের ‘জর্জ অ্যান্ড রু’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ

উল্লেখ্য, এ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হতভাগ্য দুই হ্যামিল্টন ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ জর্জ হ্যামিলটন ও রুফুস হ্যামিলটন জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের মাতৃসূত্রে দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। জর্জ তার মায়ের আর নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে এই বিয়োগান্ত পরিণতির সম্পূর্ণ অবগত হওয়ার পর থেকেই সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই উপন্যাসটির মূল প্রেক্ষাপট সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন। উপন্যাসটির রচনার গবেষণা কর্মে সংযুক্ত হয় নানা সাক্ষাৎকার ও ঘটনাস্থল স্থানীয় জনগণের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী কথোপকথন।

এ উপন্যাসের ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট ছিল নোভা স্কোশিয়ার হান্স কাউন্টির উইন্ডসোরের থ্রি মাইলস প্লেইন্স কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকা। তবে জর্জের উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে বর্ণবাদ কানাডার ও বৈশ্বিক স্বরূপে ক্ষেত্রবিশেষে আলোচিত হয়। এই দুই ভাইয়ের জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি তিনি বিস্তৃতভাবে তদানীন্তন শ্বেতাঙ্গ কানাডীয় কর্তৃক নির্যাতন ও বিভাজিত নিপীড়িত শিক্ষা খাদ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ জীবনধর্মী বর্ণনা সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। এই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা মূলত সামান্য খনির শ্রমিক বা বস্ত্র কারখানার কর্মী অথবা মানবেতর কোনো কর্মে সম্পৃক্ত থাকতেন। উপন্যাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে নানা ব্যঙ্গাত্মক উপমায় আর কবিতার ছন্দে তিনি নানা প্রশ্ন তুলেছেন। যা তার লেখনশৈলীর স্বতন্ত্রতা ও গভীরতাকে তুলে ধরে। প্রতিটা অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ক্রমান্বয়ে এক পরিণত রূপলাভ করে জটিল নাটকীয়তা আর বাস্তবতার হৃদয়স্পর্শী অনুষঙ্গ।