রুনু আপা এবং আত্মহত্যা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমি মরে যাব। মরে গিয়ে দেখাব কেমন লাগে তার। মরণ ভিন্ন আমার অন্য পথ নাই। তারে বোঝাব, তারে আমি কত ভালোবাসি, আমার থেকেও বেশি। তখন আমার বেশি বেশি আবেগের দিন। বেশি বেশি দুনিয়াকে দেখিয়ে দেওয়ার দিন। যার জন্য মরতেছি তারে দেখিয়ে দেওয়ার দিন বুকের ভেতরে এক দুনিয়া প্রেম আমি পুষি। বুঝিস তুই? বুঝবি, আমি মরলে!

আত্মহত্যা! সেও তখন আমার কাছে ফ্যান্টাসি। হ্যাঁ, বিষণ্নতার ফ্যান্টাসি। আমার মতো যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারা ভাবে মৃত্যুর পর কার কী প্রতিক্রিয়া হবে। মৃত্যুর পর কে বেশি কষ্ট পাবে। সেই কষ্ট পাওয়া দু-একজনকে কিন্তু আমরা মরার পরিকল্পনা করবার সময় ‘মরে যাব দেখিস’ বলি। ওরা তা হেসে উড়িয়ে দেয়। গুরুত্ব দেয় না। আমাদের আরও অপমান লাগে। অযাচিত মনে হয় নিজেকে। আমি কারও কেউ নই। কেউ না! আমরা তখন আরেকটা কদম মৃত্যুর দিকে ধাবিত হই।

আমি মরলে, যে আমি মরে যাব শুনে Go ahead বলেছিল, সে সব থেকে বেশি বিস্মিত হবে। আমি তাই চাই। আমার কাছের বান্ধবী কেঁদে বুক ভাসাবে। আমার মা–বাবা স্মৃতি নামে দানবাক্স খুলবে। ওতে ক্ষণে ক্ষণে জমা পড়বে আমি ছিলাম। আমার অস্তিত্ব ছিল। সেই সব থেকেও না থাকা। স্মৃতি বাক্সে জমা পড়বে কত প্রবল রাগ, অনুরাগ, অভিমান ছিল আমার দেহের প্রতিটা অণুতে তন্তুতে। তারা কেউই বুঝল না! তার থেকে বড় কথা, আমি মরলে সব থেকে বড় শাস্তি পাবে সে। আমি নিজেকে হত্যা করে পৃথিবীকে বলে যাব, তোমরা কেউই কখন শাসন করতে হয়, থামাতে হয় জান না। কখন রাগ অভিযোগ–অভিমান ভুলে বুকে নিতে হয় শেখনি। আমি আমাকে খুন করে তোমাদের জন্য রচনা করব শিক্ষা।

আমার আদালতের বয়স তখন ষোলো। আমার বয়স ষোলো। সেই ষোলোর আইন মতে তাই ছিল বিবেচনা। যার জন্য মরে যাব সে আমার ছিয়াত্তরটা কল দেখেও নির্বিকার থেকেছিল। এর বিচার কে করবে? এই অবহেলা কে সইবে?

আমার কথাগুলো শুনে কষ্ট হচ্ছে না তোর? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, নাহ। হাসি পাচ্ছে। এই তুমি, সেই তুমি রুনু আপা? রুনু আপা এবার বিষাদে ডুবে গেলেন। বললেন, হ্যাঁ, আমি। আজ যা শুনতে হাস্যকর লাগছে। একটা সময় তাই ছিল আমার বাঁচা কিংবা মরার সংকল্প। ভয়াবহ বিষাদের উপাখ্যান। সে আমাকে ইগনোর করেছে। এর থেকে বড় অপমান আর কী হতে পারে? আমি পাগলের মতো ভালোবেসেছি। পাগল নয়তো কী? নিজের থেকে বেশি মানুষ অন্যকে ভালোবাসে নাকি? পাগল না হলে কেন বুঝিনি, বাতাস আর জল এই দুইয়ের অভাব না হলে তার ভেতরেই দিব্যি আছি। এই কথা কে বুঝেছে, কবে? তাইতো আমার এক বছরের তুমুল প্রেম তার কাছে এ আর এমন কী হলো। বন্ধুদের সঙ্গে বলে বেড়ায়, এক মেয়ে আমার জন্য পাগল। মরতেও পারে। কিন্তু সেই ছেলের সঙ্গে আলাপ ছাড়া কিছুই হলো না। আমাকে অপশনাল রেখে সখ্যতা করল অন্য একজনের সঙ্গে। এই অপমানে আমি মরে যেতে চেয়েছি। অপমানে কলিজা উগরে যখন বমি আসছিল, আমি কাউকে বলতে পারিনি। কেউ জানেনি আমার ভেতরের ভাঙচুর। আত্মার রক্তক্ষরণ।

আমি ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। ছাদে উঠি। তীব্র আশাহীন ও নেতিবাচক মন। আবদ্ধ ঘর আমাকে মরার আগেই মৃত্যুর অন্ধকার দেখিয়েছে। বিষণ্নতার থেকে মুক্তির উপায় আমি মৃত্যু দিয়ে সমাপ্ত করতে চেয়েছি। মরে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। আসলে তা বাঁচা নয়, জীবন থেকে পালানো। এটা বোঝার মানসিক শক্তি তখন আমার ছিল না।

আমি আত্মমর্যাদায় ভরপুর রুনু আপার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছি। রুনু আপা বলে যান। আমি মানসিক রোগী। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এই সহজ কথাটা নিয়েও আমার সমাজ ব্যঙ্গ করবে আমি জানি। মানসিক ডাক্তারের কাছে নিলে বলবে পাগল। আমার দরকার ছিল সাইকোথেরাপি। কথার চিকিৎসা। দরকার ছিল মানসিক সমর্থন। কেউ তা করেনি। বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্ত, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, উদ্বেগে আক্রান্ত রোগীদের মতো আমিও ছিলাম রোগী। অসুস্থ। অথচ সমাজের ভয়ে, অজ্ঞতার কারণে আমি চিকিৎসকের কাছেও যেতে পারব না? অদ্ভুত!

এই সমাজ অজ্ঞ। পাবনা বললে বোঝে পাগলা গারদ। আমার আত্মীয়স্বজনেরা বোঝেনি তা। আমার দরকার ছিল কগনেটিভ বিহেভিয়র থেরাপি। অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, হতাশা ও দুশ্চিন্তার জন্য মানসিক চিকিৎসা। আমার বয়স কমজনিত অপরিপক্বতা ও বয়সের ভুল। দরকার ছিল আমার অসংলগ্ন চিন্তাকে একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট ও মনস্তত্ত্ববিদের মাধ্যমে বোঝানো, আমি ভুল। কিন্তু কাছের মানুষেরা অনেকজন না হোক, অন্তত একজন আমাকে একটু সময় দিলে আমি এই টলমল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারতাম। নাহ, কেউ ছিল না।

লেখিকা
লেখিকা

দীর্ঘক্ষণ আমি ছাদে বসে আছি। অপেক্ষা মৃত্যুর। অপেক্ষা অন্ধকারের। মানুষের এত সুখ। ছাদে এসে বাদাম খায়, হাসে, যত্ন করে কাপড় উল্টে দেয়। আর আমি অপেক্ষা করছি জীবনকে উল্টে দেওয়ার। এরা যায় না কেন! সময়, সময় ও সময়। যখন সবাই চলে গেল, আমার সময় হলো। আমার পৃথিবী ধ্বংস। কোথাও কোনো আশা নেই। তখনই পৃথিবীর সব থেকে ছোট গল্পটা আমার পেছনে। আমার পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষ আমি। মরছি। তখনই হঠাৎ ছাদের দরজায় নক। কে? পেছন ফিরে দেখি, আমার নয় বছরের ছোট্ট বোনটা। যে ছিল আমার নেওটা। এই সম্পর্ক লুকাতে হিমশিম খেয়েছি যার কাছ থেকে সব থেকে বেশি। সারাক্ষণ আমার পাশে পাশে লেগে থাকে। কী এক জ্বালা! সে এসে পড়ল। আধো আধো স্বরে বলল, আপু সন্ধ্যা নামলেই তুমি ছোটবেলার মতো আমার জন্য আকাশ থেকে চাঁদমামা পাড়!

আমি সেদিন আর মরতে পারিনি। ছোট বোনটাকে কলিজাতে নিয়ে হু হু করে কেঁদেছি। ঘরে ফিরেছি। এই পৃথিবীর বুঝের মানুষেরা আমাকে ফেরাতে পারেনি। ফিরিয়েছে এই অবুঝ বাচ্চা। কারণ সে তখনো স্বপ্ন দেখতে জানে। তার আপু আকাশ থেকে চাঁদমামা পাড়তে পারে। এই বিশ্বাসটুকু তার কাছে আছে। যে বিশ্বাস, যে স্বীকৃতি জন্য আমি দুনিয়াতে আমার বেঁচে থাকাকেই অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলাম। যে আমি নিরাশাবাদীর খাতায় নাম লিখিয়েছি। স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম সেই আমি একটু একটু করে ডাইভার্ট হলাম। আমার সঙ্গে একটা মানুষ ছিল বলে। যে স্বপ্ন দেখতে জানে। দেখাতে জানে। আমার নয় বছরের ছোট বোন! যদিও সে ছোট ছিল তবুও এমন একজন মানুষ থাকা লাগে আত্মহত্যার চিন্তা করা মানুষের সান্নিধ্যে। অন্তত একটা মানুষ।

তারপর আমি শেষবারের মতো মৃত্যুচিন্তা বাদ দিলাম যেদিন পত্রিকা খুলে দেখি, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। আমি ভেবেছিলাম আমিই একমাত্র ব্যথী। দুঃখী। নাতো! তাহলে পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষেরই কিছু ব্যথা থাকে, কষ্ট থাকে। হয়তো কারওটা সাময়িক, কারওটা নয়। কিন্তু থাকেই। আমি আর সে পথে যাইনি। আমি চলে গেলে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে একটা মানুষ বাড়বে। এ ছাড়া আর কিছুই হবে না। কিন্তু আমি বেঁচে থাকলে অনেক কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

সেই স্পর্শকাতর সময়। ভুল সিদ্ধান্তের দিনগুলো কাটিয়ে উঠবার পরে আমি যেন এক ফিনিক্স পাখি! বিষাদের অনল প্রভা থেকে আমার নবজন্ম। তোদের আজকের রুনু আপা। যে একদিন ছাদে উঠেছিল মরতে। সে এখন সেই ছাদে ওঠে আকাশ দেখতে। আকাশসংস্কৃতির এই যুগে যার জন্য মরতে চেয়েছিল তাকেও দেখে। দুনিয়াটা এখন এত ছোট! যার জন্য মরতে চেয়েছিল, তার মানসিকতা দেখে। হায়, হায়! এই ছেলের জন্য আমি মরতে চেয়েছিলাম? আমার জগৎ আর তার জগৎ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আমি যখন মহাকাশে উড়াল দেওয়ার কথা ভাবি, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সে তখন কী করলে স্ত্রী বসে থাকবে তা ভাবে!

আমি মরে গেলে আমার নিজেরই এই প্রত্যাবর্তন কে দেখত? কে জানত ষোলো বছরের সেই আমাকে পঁচিশ বছর বয়সে এসে কেউ একজন তুমুল ভালোবাসায় ভাসিয়ে নেবে! ছিয়াত্তরটা কল নয় বরং ছিয়াত্তর হাজার মাইল দূর থেকে কেউ একজন আসবে একটিবার আমাকে দেখতে! আদরে আদরে দিশেহারা করে দিতে!

মানুষ তো এক মহাবিস্ময়কর প্রাণী। জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে তার জন্য অপেক্ষা করে বিস্ময়। তার কিছু তীব্র ব্যথার। কিছু তুমুল ভালো লাগার। বেঁচেই যদি না থাকি, নিজেই যদি হই নিজের হন্তারক। কীভাবে দেখব এই সব!

ওতেই রুনু আপার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে, আত্মহত্যা প্রতিরোধের প্রচলিত প্রবচন। ‘আত্মহত্যা হচ্ছে সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান’। সমস্যাটা একদিন চলে যায়। যাবেই। কিন্তু যে সমাধান চেয়েছিল সে দেখবে না আর। তাই এটা একটা যুক্তিহীন কাজ। তারপর রুনু আপা বুকটা ভরে নিশ্বাস নেন। খোলা আকাশে বুকটা মেলে দিয়ে চিৎকার করে বলেন, আত্মহত্যা আমার কাছে ছিল নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ফ্যান্টাসি। বেঁচে থাকা তার থেকেও বড় ফ্যান্টাসি! আত্মহত্যা হচ্ছে অসতর্ক সময়ের বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক তার। বেঁচে থাকা হলো সতর্কতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সেই তার পেরিয়ে আসা আলোর বানভাসি। জীবন তোকে ভালোবাসি! নিজেকে ভালোবাসি।