খেটে খাওয়া মানুষেরা সালাম তোমাদের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকসহ ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তদের সঙ্গে সস্ত্রীক হুমায়ূন আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকসহ ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তদের সঙ্গে সস্ত্রীক হুমায়ূন আহমেদ

অনেক সম্ভাবনাময় প্রাণের বাংলাদেশটা নানা কারণে মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সকল কিছুর জন্য সারা দেশের মানুষকে ঢাকায় যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থা আর চাকরিজীবন সব মিলিয়ে ঢাকায় আমার আট বছরের বসবাস। তখন ১৯৯৬ সাল। জেলা শহরের কলেজ থেকে পাস করে দেশের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। শিক্ষার উপকরণের সহজলভ্যতা, গুণী শিক্ষকের আধিক্য, আর্থিক সচ্ছলতা ও বিভিন্ন কারণে ঢাকার ছাত্রছাত্রীরা মেধায়-মননে এগিয়ে, তা অনস্বীকার্য। বিশেষত নটর ডেম কলেজ আর ঢাকা কলেজের সুনামতো সবার জানা। আমি মফস্বল থেকে আসা অনেকের একজন। মফস্বল থেকে ঢাকায় পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের স্মার্টরা সংক্ষেপে নাম দিয়েছে মফ। যেমনটি একসময় কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে এলে তাদের বলা হতো কলু বা পিলু।

ভালো ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দরকার কঠিন অধ্যবসায়। পেছনে ফেলে আসা বছরগুলোর অজানা একাডেমিক বিষয়ে স্মার্টদের সঙ্গে সমতা আনতেই বেশ বেগ পোহাতে হয় মফদেরকে। সঙ্গে চলতি ক্লাসের কঠিন কঠিন বিষয়গুলোতে আছেই। গরিব বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য একাডেমিক, আবাসন আর খাওয়ার খরচের দুশ্চিন্তা সবকিছুর ওপরে। আমি নিম্নমধ্যবিত্তের একজন। জীবনের তাগিদে রসায়নের রসবিহীন শক্ত বিষয়গুলো আয়ত্তে আনার পাশাপাশি আয় করারও দরকার ছিল। হন্য হয়ে টিউশনি খুঁজি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরগুলোতে টিউশনি পাওয়া কষ্টকর হয়। ভাগ্যের ব্যাপার অনেকটা। একবার সেটা পেয়ে গেলে পরিচিতি বাড়ে। অভিজ্ঞতা আর সুনামে পরেরবার পেতে সহজ হয়ে যায়। আমি ভাগ্যবানদের দলে। বাবা-মায়ের দৈন্যদশায় তাঁদের কষ্টের বোঝা বাড়ায়নি।

এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে অনেক ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছি। তখন আমি একজন প্রাইভেট টিউটর। পড়াই আর বিনিময়ে টাকা পাই। দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিনিয়ত কঠিন অধ্যবসায়ে নিজেকে এগিয়ে রাখার সদা চেষ্টা করেছি। টিউটর হিসেবে কদর বেড়েছে। ঢাকা কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব দিতে সরকারের খুব উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা যেদিন ফজলুল হক হলে এসে এই মফকে নিয়ে গেলেন, আত্মবিশ্বাসটা সেদিন অনেক বেড়েছে। পথ চলতে একদিকে যেমন অভাবী ভুখানাঙ্গা ও দিন মজুরশ্রেণির মাটির মানুষের সঙ্গে মিশেছি, অন্যদিকে সমাজের অনেক উঁচু দরের যোগ্যতাসম্পন্ন অথবা বিত্তবান মানুষদের সঙ্গে মেশারও এক অসাধারণ সুযোগ হয়েছে আমার। মিশ্র অভিজ্ঞতা। ভালো লাগা, খারাপ লাগা। বিবেককে নাড়া দেওয়া বা অনুভূতিতে দোলা দেওয়া কয়েকটা ঘটনা শেয়ার করতে শুরু করেছি এই লেখা, ফিরে আসি তাতে।

শান্তিনগর রোড এলাকায় পীর সাহেবের গলির বিল্ডিংয়ে নটর ডেম কলেজের এক ছাত্রকে পড়াই। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে তাকে রসায়ন পড়াচ্ছি। জৈব রসায়নের বেসিক জিনিসগুলো সহজ করে বোঝালাম। ভালো ছাত্র সে। আর এ বিষয়ে খুব আগ্রহ তার। পড়ানোর সময় প্রাসঙ্গিক শত প্রশ্ন। খুব স্বচ্ছ ধারণা তার চাই। তার এই জানার আগ্রহে আমি আরও উৎসাহিত হই। তাই অনেক সময় দিয়ে পড়াই। এ আমার ভালো লাগা। সন্ধ্যা সাতটা। বাইরে বেশ আঁধার। পড়ানো শেষে গলি পেরিয়ে শান্তিনগর রোডে হাঁটছি। পেছন থেকে একজন এসে আমাকে থামায়। আরেকজনকে দেখিয়ে বলে, শুনুন উনি কী বলবেন। অবাক হই আমি। সেই আরেকজন নালিশ করল, হাঁটার সময় তার হাতে ব্যথা দিয়েছি। নাহ এটা আমি করিনি! বুঝলাম এটা ফাঁদের একটা কৌশল। মুহূর্তে আরও তিনজন এসে ঘিরে ধরল। মিষ্টি খেতে টাকা চাই তারা। দিলাম ব্যথা, খেতে চাই মিষ্টি-আজব বৈকি।

বাইরের মানুষের বোবার উপায় নাই আমি এই পাঁচজনের ফাঁদের জালে। ঘিরে রেখেছে আমাকে। বন্ধুদের মাঝে আড্ডা দিচ্ছি, হেঁটে যাওয়া কোনো পথিকের এটাই ভাবাই স্বাভাবিক। মাত্র এক শ টাকা আছে জানালাম ওদের। ‘আপনি মিথ্যা বলছেন’ বলল একজন। মানিব্যাগ দেখে সত্যতা যাচাই করবে। একজন সেটা নিয়ে আরেকজনকে দিল। কিছুক্ষণ পরেই মানিব্যাগটা ফেরত দিয়ে বলল, তারা ফকির না! একজন আরেকজনের কাছে মানিব্যাগটা দিয়ে এক শ টাকাটা ওরা সরিয়েছে। মুক্তির পরে তা আমি বুঝেছি। আমি ছাত্র, পকেটে বিশ কী ত্রিশ টাকার বেশি থাকে না। ওই দিন এক শ ছিল। ওদের কৌশলের কাছে আমি হেরে গেছি। ধুরন্ধর এই ছিনতাইকারীরা প্রমাণ করল, তারা সত্যিকারের ফকির! ওরা কারা? ছিনতাই করাই কী তবে ওদের পেশা, আর একাজেও ঢাকায়?

না, মানবতা হারিয়ে যায়নি। বিপদে সহায়তার হাত বাড়াতে দেখেছি খেটে খাওয়া ভুখানাঙ্গা কোনো এক দিনমজুরকে। অতি কষ্টকর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাঝেও তারা এগিয়ে আসেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা। ধ্রুব ও উতলকে পড়াচ্ছি। আমার টিউটর জীবনে এই দুই সহোদর খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। রক্তের না, তবে এরা আমার ছোট ভাই। প্রায়ই সময়ই অতিরিক্ত পড়িয়েছি। আমার সৌভাগ্য, তাদের বাবা ও সচিব মা আমাকে তাঁদের আরেক ছেলেই জানতেন। খেয়াল নেই, কখন নয়টা বেজে গেছে। একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছি। আর নয়, ফিরতে হবে। বাসা থেকে দ্রুত বের হলাম।

এটা ২০০১ সালের শীতের এক রাত। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। স্থান বেইলি রোড। সরকারি কোয়ার্টার এলাকা। রিকশা ও গাড়ি চলাচল কম। পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর হালকা গড়নের এক রিকশাওয়ালাকে পেলাম। ভাড়া দাম-দরের সুযোগ নেই। অন্ধকার রাতে ফাঁকা রাস্তায় একজন রিকশাওয়ালাকে পেয়েছি এই ঢের বেশি! বাংলামোটর পর্যন্ত যাব রিকশায়। গন্তব্য মিরপুর। পরে বাংলামোটরে বাসে উঠব এই ইচ্ছে। হাতে টিউশনির টাকা দিয়ে কেনা আমার মোটোরলার নতুন ফোনটা।

আমি ছাত্র। পকেটে বিশ কী ত্রিশ টাকার বেশি থাকে না! রিকশায় বসে ফোনে কথা বলছি। মগবাজার রোড হয়ে নিউ ইস্কাটন দিয়ে এগোচ্ছি। একসময় টের পেলাম ডান পাশের রিকশাটা একই গতিতে চলছে। সেই রিকশার দুজন যাত্রীর একজন আমাকে সালাম দিল লম্বা টানে। আমি বিস্মিত হই। ‘ভাই কী হাতিরপুল যাইবেন’, পরক্ষণেই সে প্রশ্ন করে আমাকে। বুঝলাম সমস্যা আছে। পেছনে ফিরে দেখি আরেক রিকশায় তাদের আরও দুজন সহযোগী। বেশ ঠাহর করতে পারলাম, আমি বিপদে। বুদ্ধির খেলা দরকার এখন। ওরা টের পেল তাদের শিকার বুঝে গেছে, তৎক্ষণাৎ বলল 'ভাই দৌড়ানি দিয়েননা'!

মুহূর্তেই আমার রিকশাচালকের জামার কলারটা পেছন থেকে আমি টান দিই। সে তার গতি কমায়। কপাল ভালো, বামপাশে একটা ছোট মার্কেট দেখছি। আমি ভোঁ দৌড়ে সেখানটায় ঢুকে পড়লাম। বেশির ভাগ দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, খোলা আছে দুই-তিনটা। সাহায্য চাই ওখানে একজনের কাছে। ল্যান্ডফোন ব্যবহার করা দরকার। সচিব আন্টিকে কল দিই আমি। অল্পক্ষণেই রমনা থানার পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে। পুলিশ আসার আগে তখনো ছিনতাইকারীদের উপস্থিতির তথ্য আমার রিকশাচালকের কাছে পেয়েছি। এই রিকশাচালকের কাছে আমি ঋণী। সে শুধু সহযোগিতা করেছে তা নয়, ঘটনার আকস্মিকতায় ভাড়ার কোনো টাকাই তাকে আমার দেওয়া হয়নি! শ্রদ্ধাভরে তোমায় স্মরণ করি হে খেটে খাওয়া দিনমজুর ভাই আমার, মাফ করো আমায়। ছিনতাইকারী তোরা অধম, জাতির কলঙ্ক, দেশের জঞ্জাল। তোরা মানুষ হ।

দারিদ্র্যতা আসে নিজেদের অকর্মণ্যতায়, দুর্নীতিবাজদের শোষণের শিকারে আর ক্ষমতাবানদের আগ্রাসী থাবায়। একে জয় করতে দরকার পরিশ্রম, সততা, সাহস আর বুদ্ধির প্রখরতা। খেটে খাওয়া দিনমজুরের মাঝে আমি তা দেখেছি। রাত সাড়ে দশটা। অক্টোবর ২০০২। বের হলাম গ্যোটে ইনস্টিটিউট থেকে। সহধর্মিণী ইভা ও আমি দুজনে ওখানে জার্মান ভাষা শিখি। সেদিন সে সঙ্গে ছিল না। একা বের হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা রিকশা নিলাম। ঝিমিয়ে পড়া রাতের ঢাকা শহর। চলছি মিরপুর রোডে। গন্তব্য ওয়ারী। টের পেলাম, অপর রিকশার যাত্রী দুজনের মতিগতি ভালো না। বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে।

লেখক
লেখক

ফিসফিস ইশারায় আমার রিকশাচালককে আগাম ধারণা দিলাম। তরতাজা যুবক সে। আমার কথায় সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। আমি নিশ্চিত হই, সে তাদের দলের সদস্য না। হঠাৎ রিকশার গতি বাড়ায় সে। গতি বাড়ে সেই রিকশারও। হাতের নাগালে পেতে বাম বরাবর চলছে তারা, একটু পরেই ছোবল মারবে। বুদ্ধিমান যুবক রিকশাচালক, সে হঠাৎ গতি কমায়ে বাঁক নিয়ে গলিতে ঢুকে পড়ে। দ্রুতগতিতে চলতে থাকা ইতরেরা তার বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানে। আমি বেঁচে যাই। আমি সহাস্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি এই পরোপকারী রিকশাচালককে। তার সাহসিকতার মুগ্ধ হয়ে হাতে গুঁজে দিই ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা। স্যালুট তোমায় হে যুবক। সেলাম তোমায় হে খেটে খাওয়া মানুষ।

স্মৃতির পাতায় সেই আট বছরের ঢাকা জীবন। আমাকে দিয়েছে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, শিক্ষা, ভালো ফলাফল, বিবেক, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, পরিচিতি, জীবনসঙ্গী আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার শক্তি। মৃত্যুর আগে না মরার দৃঢ় মনোবলটুকুও। মানুষের হাসিমাখা মুখ দেখতে ভালো লাগে। ভাড়া ঠিক করার সময় রিকশাচালকের সঙ্গে দর কষাকষি করলেও, গন্তব্যে পোঁছার পর সুন্দর করে ধন্যবাদ দিয়ে কিছু টাকা বেশি দেবেন। তারপর তাকিয়ে দেখবেন, তার চোখেমুখে পরিপূর্ণ তৃপ্তির অমায়িক হাসিটা। আমি দেখেছি অনেক দিন, অনেকবার।

একটি সুন্দর জাতি গঠনে গুণগত শিক্ষা অপরিহার্য। জন্ম নেওয়া একটি শিশুর প্রথম স্কুল হলো তার পরিবার। বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়ের যে কেউ হতে পারে আমাদের জীবনের সবচেয়ে আদর্শের শিক্ষক। কথা বলা, বর্ণ শিক্ষা, নীতি ও আদর্শের শিক্ষাতো পরিবার থেকেই। বাল্যবয়স ও কৈশোরে স্কুল আর সমাজ সমানভাবে শিক্ষা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অবশ্যই আলাদা। এখানে মুক্তচিন্তার নিজেকে ফুটিয়ে তোলার সময়। জাতি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে নিজ নিজ বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জনের সময় এটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের প্রাণ, আমাদের গর্ব। বেশ কিছুদিন ধরে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওতে দেখা গেল বর্তমান উপাচার্য বলেছেন, দশ টাকায় এক কাপ চা, একটি শিঙাড়া, একটি চপ এবং একটি সমুচা পাওয়া যাবে ঢাকা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে। এটি গর্বের ও এটি ঐতিহ্যের। আন্তর্জাতিক সংস্থা জানতে পারলে গিনেস বুকে রেকর্ড হবে এও বলেছেন।

না এটা ঠিক নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের গর্বের বিষয় হতে হবে শিক্ষকের যোগ্যতা, শিক্ষার মান আর গবেষণা। আর এসব দিয়ে যথোপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানেরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়বে।
...

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জৈব রসায়ন, টরন্টো, কানাডা।
ইমেইল: <[email protected]>
আমার ছবি-