মেরিল্যান্ডে বাংলাদেশি জিনিয়াসদের কাছাকাছি

এনআইএইচ-এ বাংলাদেশি জিনিয়াসদের সঙ্গে লেখক
এনআইএইচ-এ বাংলাদেশি জিনিয়াসদের সঙ্গে লেখক

শীতপ্রধান দেশ কানাডা। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় এখানে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এ তিন মাস অত্যধিক ঠান্ডা। হয় ঘন ঘন তুষারপাত। দূর অবধি দুই চোখ যেদিকে তাকাই, শহর-বন্দর, খোলা মাঠ, চারিদিক যেন বরফের সাদা চাদরে ঢাকা। এ সময়টায় তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। প্রায়ই শূন্যের নিচে। নেগেটিভ সংখ্যা। এখন পর্যন্ত কানাডার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ইউকনে, মাইনাস ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিকূল আবহাওয়া। তাতে কী? জীবনযাত্রা থেমে নেই। মানুষ ক্রমাগত ছুটছে। অফিস, শিল্পকারখানা, ব্যবসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব চলছে নিয়মমাফিক। কিছুটা ধীর গতি কখনো। যেমন অতিমাত্রায় তুষারপাতে বা তুষারবৃষ্টির সময়ে।

এনআইএইচ, বেথেসডা, মেরিল্যান্ড। ইন্টারনেট উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া
এনআইএইচ, বেথেসডা, মেরিল্যান্ড। ইন্টারনেট উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া

উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ছুটির আমেজ শুরু হয়। ছুটি মূলত ডিসেম্বরের শেষ তৃতীয়াংশে। নতুন বছরের শুরু দিনটাও। বছরের প্রথম দিনটা ছুটি কেন? সুন্দর পৃথিবী গড়তে কাজপ্রিয় মানুষেরা এদিনে পুরো বছরের পরিকল্পনা করেন। ছুটির এই সময়টাকে কাজে লাগাতে অনেক ভেবেছি, কোথায় যায়।

জীবনসংগ্রামের অনেক বছর পার করেছি। কানাডাতেই প্রায় নয় বছর ছুঁই ছুঁই। ফিরব কী ফিরব না সেটা অমীমাংসিত রেখেই ২০১০ সালে জাপানের আকাশে উড়াল দিয়েছি। পরদিন সাস্কাচেওয়ানের আকাশসীমায় দুরুদুরু হৃদয়ে কানাডায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়েছি। এই সাস্কাচেওয়ানের রাজধানীতে সঞ্চিত আনন্দ-কষ্ট ও সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতিবহুল সময়ের কথা কিছুই মনে নেই আমাদের মেয়ে ছোট্ট নাবিহার। আমি দৌড়েছি সাস্কাচেওয়ান, আলবার্টা ও ওন্টারিও প্রদেশে। দেখেছি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা বিশাল এ দেশকে। ধারণা নিয়েছি মানুষের জীবনযাত্রার।

এনআইএইচ-এ সপরিবার লেখক
এনআইএইচ-এ সপরিবার লেখক

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগে ২০১১ সালে শুরু হয় এই নগরীয় জীবন। নাবিহা পায় খেলার সাথি ছোট ভাইবোন নাশিতা ও ইহানকে। সময়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা তিন সন্তানকে নিয়ে এত দিন ঘোরাঘুরি ছিল টরন্টো কেন্দ্রিক। আর তা মূলত গ্রীষ্মকালে। ওরা দেখতে চায় মা-বাবার লাল সবুজের বাংলাদেশকে। আরও দেখতে চায় আত্মীয়দের। আর তারা থাকে কে কোথায়। অতি ব্যস্ত জীবনে ডিসেম্বরের এই শীতকালের ছুটির সময়টাকে বেছে নিয়েছি বাচ্চাদের জন্য কাজে লাগাব বলে। শিক্ষা, বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দিয়েছি। জানব বিজ্ঞান, দেখব বাংলাদেশি জিনিয়াসদের। যাব এবার আমেরিকা, মেরিল্যান্ড—এই হলো সিদ্ধান্ত।

দুই.

ক্রিসমাসের দিনে সবাই যখন নিজ নিজ শহরে আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, ঠিক তখন আমরা গাড়ি চালাব নায়াগ্রা হয়ে আমেরিকার ইন্টার স্টেটের বড় বড় হাইওয়েতে। সাম্প্রতিক বছরের সঙ্গে অমিল রেখে গেল বছর ২০১৮ সালের ক্রিসমাসের দিনটাতে তুষারপাত হয়নি। তবে ঠান্ডার কমতি নেই। তাতে কী? এতগুলো বছরে তা আমাদের সয়ে গেছে। সকাল ৭টা ৩০ মিনিট। বের হলাম আমরা, মূল চালক আমি। সহধর্মিণী ইভা, সেও ভালো গাড়ি চালায়। যেতে হবে ৮০০ কিলোমিটারের পথ।

ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়াল
ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়াল

ওন্টারিওর গর্ব আমাদের হাইওয়ে ৪০১ দিয়ে চলছি। সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা টরন্টোর সিএন টাওয়ারকে পেছনে ফেলে মিসিসুয়াগা-ওকভিল-হ্যামিল্টন শহরের আলোক ঝলমলে সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোকে ডানে বামে রেখে সেন্টক্যাথরিনের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য পেরিয়ে খুব অল্প সময়ে সকাল ৯টায় নায়াগ্রার কানাডা-আমেরিকা সীমান্তে পৌঁছেছি। ভ্রমণের কথা ভেবে ভেবে উত্তেজিত বাচ্চারা আগের রাতে তেমন ঘুমায়নি। চলন্ত গাড়িতে ওদের গভীর ঘুমটা সীমান্তে এসে গাড়ির গতি শূন্যে এই বুঝি ভেঙে গেল। ফিরে দেখি ঠিক তাই। ওপাশে আমেরিকা জানার পর ওরা সমানে উত্তেজিত। নাবিহা আর নাশিতা আনন্দে বলল, ওহ ফাইনালি উই আর দেয়ার! ভেবেছে, তাহলে বর্ডার পার হলেই মেরিল্যান্ড—ইতি খালামণির বাসা। তাদের আমি বুঝিয়ে বলি, লং ওয়ে টু গো মাই মা। ইমিগ্রেশন পার হচ্ছি। ওখানেই প্রথম বুঝলাম কানাডীয় পাসপোর্টের গুরুত্বটা। সময় নিল মাত্র ২ মিনিট। আমাদের কাছে ড্রাই ফুডের সঙ্গে ছিল কলা ও কমলা। অফিসার কমলাগুলো ফেলে দিলেন, বললেন, হ্যাভ আ নাইস টাইম ইন আমেরিকা।

বাফেলোর হালকা বরফে ঢাকা বুকটা চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ওপরে নীলাভ সাদা আকাশটা। দেখতে পাওয়া বাড়িঘরগুলো কিছুদূর পরে আর নাই। আছে দুই পাশে জনমানবহীন শুধু গাছপালা-জঙ্গল। একটু কি ভয় পেলাম? ঠিক তাই। অজানা আশঙ্কা, যদি কিছু হয়—গ্যাস ফুরানো, ইঞ্জিন বিকল। শক্ত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি বটে। নতুন ব্রেক সিস্টেম, জ্যাক, বুষ্টার কর্ড, টুল বক্স। সঙ্গে বেসিক জ্ঞান। যা আমার জানার আগ্রহ সব সময়। আরও প্রায় ঘণ্টা পরে জনবসতি চোখে পড়ল। হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে গাড়ির ফুয়েল ট্যাংক ভরাট করলাম। আমরা নিলাম একটু বিরতি। শরীর হালকা করে তাতেও খাবার ফুয়েল দিতে হলো।

ভার্জিনিয়ায় এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামে
ভার্জিনিয়ায় এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামে

পিটসবার্গ অঙ্গরাজ্যের ভয়ংকর পিচ্ছিল পাহাড়ি পথের শুরু। চারদিকে পাহাড়, আঁকাবাঁকা পথ। আর তাতেও বরফের হালকা স্তর। অপ্রশস্ত পথ দিয়ে কখনো পাহাড়ে উঠছি, নামছি বা পাশ দিয়ে চলছি। এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। চালকের ভালো দক্ষতা অবশ্যই প্রয়োজন। চোখেমুখে ক্লান্তির ছায়া স্পষ্ট, তবুও ইভা চেয়েছে চালকের আসনে বসতে। আমি তাকে দিতে ভরসা পাইনি। তবে তার সাহসের প্রশংসা করি। ‘বাচ্চাদের যত্ন নিতে তুমি অনেক কষ্ট করেছ, ওটা আমি তেমন পারি না।’ গাড়ি ওর হাতে না দিতে আমি বোঝাই তাকে। কঠিন পথ, সন্দেহ নেই। তা আগেই জেনেছি। তবে এতটা কঠিন আশা করিনি। চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা দরকার, নিজের ওপর আস্থা বাড়ে। প্রকৃতির এই পাহাড়ি অপার সৌন্দর্য সবদিকে। দুই চোখ ভরে তা দেখেছি। গ্রীষ্মে কিংবা শরতে, তরতাজা আবহাওয়ায় প্রখর সূর্যালোকে এই প্রকৃতি অতি চমৎকার হবে এটা আমি নিশ্চিত। অসম পথ পেরিয়ে একসময় পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করি। বাফেলোর পর বিরতিসহ আরও কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। অর্ধেকের কিছুটা বেশি পথ পাড়ি দিয়ে নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলেছি। সন্ধ্যা হয়ে এল। ওয়াশিংটনের চওড়া হাইওয়ে দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে চালিয়ে যখন মেরিল্যান্ডে ঢুকছি, আনন্দটা বেড়ে গেল। অবশেষে সেখানে পৌঁছলাম। সব মিলিয়ে ১২ ঘণ্টা।

তিন.

ইতি ইভার ছোট বোন। হাসবেন্ড ড. আরিফ ও সে দুজনেই মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট। ওরা পিএইচডি করেছে জাপানে। এখন তারা মেরিল্যান্ড এনআইএইচ-এর সায়েন্টিস্ট। মেরিল্যান্ডের পৃথিবী বিখ্যাত এই বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে আমরা দেখব। আর বিজ্ঞানে আগ্রহী আমাদের স্কুল বয়সী দুই মেয়ে সঙ্গে থাকবে। প্রায় ৭০টি বড় বড় বিল্ডিংয়ের এই ইনস্টিটিউটগুলোর বিশাল ব্যারাকের ভিজিটর প্রবেশ পথে আমাদের গাড়িটাকে সিকিউরিটির লোকেরা তন্ন তন্ন করে চেক করল। আর আমাদের চেকিংটা ছিল—ঠিক যেন বিমানবন্দরের সিকিউরিটি পার হচ্ছি।

তুষারপাতে জমা বরফে বাচ্চাদের আনন্দ (টরন্টো)
তুষারপাতে জমা বরফে বাচ্চাদের আনন্দ (টরন্টো)

আমেরিকায় জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণার প্রতিষ্ঠান হলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ। সংক্ষেপে এনআইএইচ। জনস্বাস্থ্য ও বায়োমেডিকেল গবেষণার সাতাশটি প্রতিষ্ঠানের এই বিশাল কেন্দ্র মেরিল্যান্ডের বেথেসডায় অবস্থিত। বায়োমেডিকেল গবেষণায় বিশ্বে এটা সেরা। সব থেকে বড়। আবিষ্কারের নেশায় হাজার হাজার গবেষক এখানে রাতদিন পরিশ্রম করছেন। পোষ্টডক বা অন্য গবেষণার জন্য প্রাণরসায়নবিদ, রসায়নবিদ, অণুজীববিজ্ঞানী, মেডিকেল ডক্টরদের তুমুল প্রতিযোগিতা এখানে।

এখানকার বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের তুখোড় জিনিয়াসরাও আছেন। পৃথিবীর বড় বড় গবেষকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেধা আর যোগ্যতা প্রমাণ করে আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্যদের মাঝে সিনিয়র হিসেবে পেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো বন্ধু জুবায়ের ও তুষারকে। তারা একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। গর্বে বুকটা ভরে যায়! তারা সবাই বাংলাদেশের সোনার সন্তান।

গ্রীষ্মে বৃহত্তর টরন্টোর মিসিসুয়াগায় ওন্টারিও বিচের পাশে সপরিবার লেখক
গ্রীষ্মে বৃহত্তর টরন্টোর মিসিসুয়াগায় ওন্টারিও বিচের পাশে সপরিবার লেখক

বেথেসডার এনআইএইচ থেকে ওয়াশিংটন ডিসি মাত্র ২০ কিলোমিটার পথ। দেখতে যাব। মেরিল্যান্ডে কী সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল দিন! আবহাওয়া ভালো। তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টরন্টোতে তখন তাপমাত্রা শূন্যের নিচে। ইতির পরিবার নিয়ে সবাই একসঙ্গে ওয়াশিংটন যাব বলে উবারের বড় গাড়িতে উঠি। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সেই অলিগলি ভেদ করে ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবনের পাশ দিয়ে উবারের গাড়িটা ধীর গতিতে যেতে যেতে একসময় থামল। দেখলাম সেখানে লিংকন মেমোরিয়াল। সপ্তাহের সাত দিনই সেখানে মানুষের ভিড়। সেখান থেকে হেঁটে গেলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মেমোরিয়ালে। ওখানে সব কটি অঙ্গরাজ্যের নামফলকসহ ইতিহাসের কথা বলে। প্রচুর দর্শকের ভিড় সেখানেও। শীতকাল বলে পানির ফোয়ারাগুলোর আর্টিস্টিক ঝলকানিটা ছিল না। আরও দূরে ওই যে ওটা কী? আকাশ ছুতে চায়। সেটা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। পরে নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে আমরা যাই বিখ্যাত হোয়াইট হাউসের কাছে। দেখতে হলো একটু দূর থেকে বৈকি। আমেরিকানদের জাতীয় ক্রিসমাস ট্রি ওখানে। সেটা সুউচ্চ বটে। খুব সুন্দর করে সাজানো। প্রচুর মানুষের সমাগম। আশীর্বাদের আশায় মানুষের ফেলা কয়েনগুলোতে চারপাশটা যেন ভরপুর প্রায়।

ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্য খুব বেশি দূরে নয়। ৪৫ মিনিটের পথ। সেখানকার এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামে গেলাম আমরা। অসাধারণ সুন্দর করে সাজানো। বিমান ও স্পেসবাহনের আবিষ্কার, আর ক্রমোন্নতি দেখানো হয়েছে সেখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত অনেক কটা বিমান চোখে পড়ল।

চার.

বিজ্ঞানের আবিষ্কার সভ্যতার উন্নতি করে। এর অপব্যবহারে শুধু ধ্বংস। তা মুহূর্তে অথবা ধীরে ধীরে। এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকে বছরের পর বছর। পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা বিশ্ব দেখেছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। ধ্বংসে নয়, বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে হবে। আর তা আমাদেরই। দেখে এলাম বায়োমেডিকেল বিজ্ঞান গবেষণায় বিশ্বের সেরা বড় প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ)। এখানে বাংলাদেশি সোনার সন্তান, জিনিয়াসরা পিছিয়ে নেই। (জানুয়ারি ২৬, ২০১৯)

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জৈব রসায়ন, টরন্টো, কানাডা।
ইমেইল: [email protected]