কথার আছে সঠিক বাণী

নায়াগ্রা ফলসে সপরিবার লেখিকা
নায়াগ্রা ফলসে সপরিবার লেখিকা

‘কথার আছে সঠিক বাণী, যদি আমি কইতে জানি’—ছোটবেলা থেকে এটাই শুনে এসেছি। আজ আমি আমার জীবনের গল্প দিয়ে বলব কীভাবে কথাটার মর্ম বিদেশে এসে বুঝেছি।

অল সেট

প্রথম আমেরিকাতে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব রকম নিয়মকানুন চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে আগেই। কী কী কাগজপত্র নিয়ে আসতে হবে, প্রথম দিন কোন অফিসে যেতে হবে, কীভাবে কী করতে হবে, একেবারে পরিষ্কার করে লেখা আছে। আমি সেই মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে প্রথম দিন সকালে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট আফেয়ার্স অফিসে গেলাম আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে। ফ্রন্ট অফিসের মেয়েটা সুন্দর হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। আমার কাগজপত্র চাইলেন। সব দেখলেন। পাসপোর্টে একটা ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন এবং বলে দিলেন ইমার্জেন্সি হলে কাকে ফোন করতে হবে বা কোথায় যেতে হবে। মোটকথা সব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়ে আমার কাগজপত্র আমার হাতে দিলেন এবং তারপরে বললেন ‘অল সেট’।

আমি তখন আমার সব কাগজপত্র চেক করে দেখি যে, এগুলোতো সেই সেটই, যেগুলো আমি তাকে দিয়েছি, তিনি আবার কোন সেট চান?

আমি তখন তাকে আমার সবগুলো কাগজ আবার দেখিয়ে বললাম, yeah, this is the set.

তিনি তখন আবারও হাসি দিয়ে বললেন, ইয়া, অল সেট।

আমি আবার আমার সব কাগজপত্র চেক করলাম। এখন তো আমি বুঝতে পারছি না। আমার কাছে তো আর কোনো সেটও নেই। আমি তাকে কীসের সেট দেব?

তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, do you need any more thing?

তিনি আবারও হেসে বললেন, Nope অল সেট।

তখন আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম যে আমি তো আবারও জিজ্ঞাসা করলাম পরিষ্কার করে, তার মানে তার আর কোনো কাগজের দরকার নেই। তাহলে কি আমার কাজ শেষ?

এবার আমি বললাম, am I done?

তিনি তখন আবারও হাসি দিয়ে বললেন, ইয়া, অল সেট।

এবার আমি অল সেটের মানে বুঝতে পারলাম। এই সেট বাংলাদেশের কাগজপত্রের সেট না, এটা হলো আমেরিকার অল সেট।


প্যাটিস শপ

কানাডাতে এসে আমি সরকারি অফিসে কাজ পাই। কাজে যোগদানের প্রায় সপ্তাহখানেক পরে আমাদের ডিরেক্টরের সঙ্গে আমাদের ইউনিটের মিটিং। খুব মনোযোগ সহকারে সব শুনছি, নোটবুকে লিখে রাখছি। একপর্যায়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডিরেক্টর বললেন যে, ‘I will go down to Patties shop and get that memo, no worries.’

আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই গুরুত্বপূর্ণ কাগজ তিনি কীভাবে প্যাটিস–এর দোকানে পাবেন? তাহলে কী প্যাটিসের দোকানে ফটোকপি মেশিন আছে বাংলাদেশের মতো? হয়তো কাগজটা ওনার কাছে আছে, ফটোকপি করবেন? তখন মনে হলো, ও আচ্ছা, মেইন ফ্লোরে একটা দোকান দেখেছিলাম, শিঙাড়া বিক্রি করে, মনে হয় ওখানে যাবেন।

নানানরকম চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকল। মিটিং শেষ হলো। লাঞ্চের সময় আমি মেইন ফ্লোরের দোকানটার আশপাশে ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম, কোনো ফটোকপি মেশিন আছে কিনা। কিছুই দেখলাম না। দোকানটায় সবাই লাইন দিয়ে শিঙাড়া-রোল কিনছেন। চিন্তিত অবস্থায় ফেরত এলাম। কাউকে লজ্জায় জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না। এমন একটা অবস্থা, বুঝতেও পারছি না আবার জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না। আর আমার মাথায় ব্যাপারটা ঘুরতেই থাকল, এই গুরুত্বপূর্ণ কাগজ তিনি কীভাবে প্যাটিসের দোকানে পাবেন?

দুই দিন পর দেখি, ডিরেক্টরের ইমেইল এসেছে। সাবজেক্ট লাইন দেখে বুঝতে পারলাম সেই memo–র ব্যাপার। খুবই আগ্রহ সহকারে তাড়াতাড়ি খুললাম, memo পড়তে লাগলাম, একেবারে শেষে নাম আর সিগনেচার দেখি—Patti। এতক্ষণে রহস্য সমাধান হলো। ওই ডিরেক্টর এর নাম হলো ‘Patti’ আর ওনার অফিস হলো ২৩ তলায়। আমাদের ২৫ তলায়।

তাই তো আমার ডিরেক্টর বলেছিলেন যে, I will go down to Patti’s shop and get that memo. এখানে যে কারও অফিস কে শপ বলতে পারে, আমার মাথাতেই আসেনি! উনি বলেছেন Patti's shop বা office আর আমি বুঝেছি ‘Patties shop’ বা প্যাটিসের দোকান। আমি আমার স্বাভাবিক বাংলাদেশের ধারণা অনুযায়ী প্যাটিসের দোকান খোঁজাখুঁজি শুরু করেছি!

এরপর থেকে বুঝলাম, কথার আছে সঠিক বাণী, যদি আমি বুঝতে জানি।