স্মৃতির পাতায় স্মোকি মাউন্টেন

স্মোকি মাউন্টেনের প্রাকৃতিক রূপ
স্মোকি মাউন্টেনের প্রাকৃতিক রূপ

আমেরিকায় এসেছি বেশি দিন হয়নি। পিএইচডি করছি অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম সেমিস্টার শেষে দ্বিতীয় সেমিস্টারের মাঝামাঝি সময়। চারপাশে এত দিনে কয়েকজন সুহৃদও তৈরি হয়ে গেছে। তাদেরই একজন শাহরিয়ার। নিঝুম এক সাঁঝের বেলায় শাহরিয়ার বলল, ভাই যাবেন? বললাম কোথায়? শাহরিয়ার বলল, স্মোকি মাউন্টেন! বিলম্ব না করেই সায় দিলাম, যাব। আরও দুজন রসাল মানুষও সঙ্গে যাচ্ছে। প্রিয় অনুজ শামীম ও মজার কথক নাইজেরিয়ান বন্ধু ইসমাইল।

স্মোকি মাউন্টেনের প্রাকৃতিক রূপ
স্মোকি মাউন্টেনের প্রাকৃতিক রূপ

আরাধ্যের গ্রেট স্মোকি মাউন্টেন। টেনিসি স্টেটে অবস্থিত। অবার্ন শহর থেকে বের হয়ে ৮৫ ইন্টার স্ট্রিট ধরে সোজা আটলান্টা। তারপর গেইনসভিল, ফ্রাঙ্কলিন ও সিলভিয়া হাইওয়ে ধরে সরাসরি স্মোকি মাউন্টেন। সময় লাগবে ৫ ঘণ্টা ২৭ মিনিট। অবশেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর গোছগাছ করে বের হয়ে গেলাম। অবার্ন যখন ছেড়েছি তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। বাইরের পরিবেশটা খুবই চমৎকার। গাঢ় নীল আকাশ। ততক্ষণে সূর্যমামা খানিকটা তেজি হয়ে উঠেছে বৈকি। চিকচিকে রোদ। হিম হিম শীতল বাতাস। দূর আকাশের কোথাও মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। দূর প্রান্তরে কিছুটা কুয়াশার ওড়াউড়ি। ঠিক যেন শরতের ভাব! দ্রুত বেগে চলছি ইন্টার স্ট্রিট দিয়ে। পথের দুই ধারে বিস্তৃত বন। উঁচু উঁচু বাস-উড। সামনে অন্তহীন পথ চলে গেছে উঁচু–নিচু পাহাড় ডিঙিয়ে।

স্মোকি মাউন্টেনের প্রাকৃতিক রূপ
স্মোকি মাউন্টেনের প্রাকৃতিক রূপ

একসময় আটলান্টাকে পেছনে রেখে গেইনসভিলের হাইওয়ে ধরে চলছি আমরা। পথের দুই ধারে ছোট ছোট পাহাড়ের অনড় অবস্থান। অন্তহীন পথে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দিগন্তের উঁকিঝুঁকি। ঠিক যেন পাহাড়ে ঘেরা কোনো এক কাল্পনিক স্বর্গরাজ্য! আরও কিছুটা এগোতেই পথের বাঁকের পরিমাণ বেড়ে গেল। ততক্ষণে ফ্রাঙ্কলিনকে পেছনে রেখে চলে আসি প্রাকৃতিক রূপের স্বর্গভূমি সিলভিয়ায়। এখান থেকে স্মোকি আর শত মাইলের পথ। পাহাড়ি সর্পিল পথ ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকি। যতই ওপরে উঠছি ততই যেন স্মোকির স্নিগ্ধ রূপের বাহার একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। মুগ্ধ চিত্তে প্রকৃতির এত রূপ দেখতে দেখতে কখন যে নয়ন জোড়া শিথিল হয়ে পড়েছিল টের পাইনি।

পথের বাঁকে কেন্দ্রমুখী বলের ক্রিয়ায় একসময় পাতলা ঘুম ঘুম ভাবটা উবে গেল। বাইরের দিকে নজর পড়তেই মনে হলো অপরূপ স্নিগ্ধ প্রকৃতি যেন তার রূপ-সাগরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাহাড়ের ওপর পাহাড় ভর করে আছে। মেঘের ওপরে মেঘের ওড়াউড়ি। পর্বতের কোলে ঢলে পড়ছে ধোঁয়াটে মেঘের দল। পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বাঁধাই করা পথ। পথের মাঝবরাবর হলুদ দাগ কাটা। ডান পাশটা উঠে গেছে খাঁড়া ওপরের দিকে। একটুখানি বেঁকে তাকালেই দেখা যায় কেমন করে খাঁড়া পাহাড়ের বুক চিরে ঝুলে আছে লতাগুল্ম। পথের বাঁ পাশটা নেমে গেছে সোজা নিচে। কী অদ্ভুত নিয়মে নিচের দিকে চলে যাওয়া খাঁড়া ঢালের বুক চিরে গজিয়েছে কয়েটা উঁচু উঁচু বৃক্ষ! যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই বেড়ে চলেছে আঁকাবাঁকা পথ। ডান পাশে পর্বতের খাঁড়া চূড়াটা আড়াল করে রেখেছে পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়া সূর্যটাকে। বাঁ দিকে খানিকটা দূরে আরেকটি পাহাড়। ওই পাহাড়ের ঢালে সূর্যের আলোর চিকচিকে প্রতিফলন। আকাশ জুড়ে নীল সমুদ্রের বুকে বিকেলটা যেন একটু একটু করে ঢলে পড়ছে। একটু একটু করে ভারী স্নিগ্ধ আমেজে শিথিল হয়ে পড়ছে সূর্যের তেজটাও। পড়ন্ত বিকেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরাও ছুটে চলেছি একটু একটু করেই।

বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (সর্ব ডানে)
বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (সর্ব ডানে)

খানিকটা এগোতেই লেগে গেল জ্যাম। যেখানে সুবিধা পাচ্ছে পার্কিং করে হেঁটে চলেছে ভ্রমণপিপাসু মানুষ। বুঝতে পারলাম এ পথের অন্ত মিলেছে অদূরেই। আমরাও ভাবলাম পার্কিং করে হেঁটে চলে যাই। অবশ্য ততক্ষণে একটু অসুবিধা হয়ে গেল। রাস্তার ধারে আর ঠাঁই মিলছে না। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শামীম। কোথাও যদি একটুখানি সুযোগ মেলে! একসময় সেই সুযোগটা এসে গেল। দ্রুত বাঁয়ে পার্কিং করল শামীম। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি। যতই এগোচ্ছি মানুষের ঢল যেন ততই বেড়ে চলেছে। একসময় আচমকাই দেখা মিলল নয়নাভিরাম অন্তহীন পথের শেষটুকু। একেবারে শেষ প্রান্তটি ইউটার্ন নিয়ে চলে গেছে পাহাড়ের অপর পিঠে। মূল রাস্তা থেকে পয়েন্টটা খানিকটা সম্প্রসারিত। দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির। কয়েকটি স্তরে ভাগ করা। প্রতিটি স্তর ওপরটা থেকে খানিকটা নিচু করা হয়েছে। যেন সবগুলো স্তর থেকে স্মোকির রূপ দেখতে কোনো ব্যাঘাত না হয়। যত দূর দেখা যাচ্ছে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন অসংখ্য পর্বতের চূড়া মাথায় মাথা লাগিয়ে খুনসুটি করছে। বিকেলটা একটু একটু পড়ন্ত হচ্ছে। চিকচিকে রোদ এসে মুখে পড়লেও তাপমাত্রা ততক্ষণে হিমাঙ্কে। মানুষের গিজগিজ যেন বেড়েই চলেছে। নানা মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ পর্বতের অপূর্ব রূপ দেখতে, কেউ বা নিজের একখান সেরা সেলফি তুলতে।

ডান দিকে খানিকটা এগোতেই বুঝতে পারলাম এটাই শেষ পয়েন্ট নয়। ওই পাশটা ঘেঁষে কিছুটা ওপরের দিকে চলে গেছে বাঁধানো একটা পথ। জানতে পারলাম কিছুটা পথ হেঁটে গেলেই দেখা মিলবে প্রেয়সী মনের আরাধ্য স্মোকির সর্বোচ্চ পিক। যেখান থেকে দেখা যাবে মার্কিন মুলুকের সাতটি স্টেট। হেঁটে চললাম সে পথে। কিছুটা সরু। খানিকটা দূর থেকে বোঝা যায় কতটা খাঁড়া হয়ে চলে গেছে এ পথ। ডান পাশটা আলতো খাঁড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে। বাঁ পাশটা কিছুটা ঢাল বেয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। দুই পাশে ছোট ছোট ঝোপমতো গাছ। দেখতে অনেকটা দেবদারুর মতো। এদিকটায় উঁচু উঁচু গাছ তেমনটা নেই। ওপরে মেঘমুক্ত গাঢ় নীল আকাশ। দিগন্তের এক কোণে সূর্যের হাসি। কনে দেখা আলো আছড়ে পড়ছে চারপাশে। উত্তরের হিম হিম শীতল বাতাস। ফুরফুরে মন। এক অন্য রকম কাল্পনিক স্বর্গরাজ্যের অনুভূতি বৈকি!

লেখক
লেখক

খানিকটা হাঁটার পর মনে হলো বুকটা চেপে ধরে আসছে। বিশ্রামের আদলে দু-চারটা ছবি তুলে নিয়েছি। মুগ্ধ নয়নে দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে যাই স্মোকির শীর্ষবিন্দুর দ্বারে। অনেকটা প্যাঁচানো সিঁড়ির মতো করে মাথার খানিকটা ওপরে গোল করে তৈরি করা হয়েছে। যেখানটায় একের পর এক লাইন ধরে ছুটে চলেছে ভ্রমণপ্রেয়সী মানুষ। ওপরে ওঠার পথ কিছুটা পিচ্ছিল। দুই পাশে বরফ জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে গত রাতে তুষার ঝরেছিল। খানিকটা সতর্ক হয়ে হেঁটে চলেছি সে পথে। তবুও পা পিছলে পড়ার উপক্রম! দু-একটা সাদা মেয়ে এরই মধ্যে পা পিছলে পড়লেও তেমন কোনো ব্যথা পায়নি নিশ্চয়ই। কোথাও যেন আলতো করে মিষ্টি একটা রোমান্টিক অনুভূতি খেলে গেল! একসময় নিজেকে আবিষ্কার করি রূপসী স্মোকির সেই শীর্ষবিন্দুতে। হা করে তাকিয়ে আছি দূরের দিকপালের দিকে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আছড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। দৃষ্টির অন্তরীপ পুরোটায় পর্বতময়। দিগন্তের দূর প্রান্তরে ধোঁয়াটে কুয়াশার আনাগোনা। দূর পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের মলিন কিরণ লেপ্টে পড়ছে। সমুদ্রতট থেকে সাত হাজার ফিট ওপরে আমি! এক আশ্চর্য ঘোরে কেটে গেল খানিকটা সময়। ঘোর কাটতে কাটতেই বুঝতে পারলাম পেছনে পড়ে আছে লম্বা লাইন। তড়িঘড়ি করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। তারপর সিক্ত হৃদয়ের উষ্ণ ব্যাকুলতা নিয়ে নামতে থাকি পুরোনো সেই পথ ধরে।

গোধূলি যতই গাঢ় হয়ে আসছে ততই যেন কুয়াশার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। দেখতে দেখতে একসময় দূর দিগন্তে রক্তিম সূর্যটা ঢুপ করে ডুবে গেল। একটু একটু করে সাঁঝের টানে আঁধার করে আসে চারপাশটায়। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে চারপাশের কোলাহল। প্রকৃতির স্নিগ্ধ নীরবতাকে সঙ্গী করে নীড়ে ফিরতে শুরু করে ভ্রমণপ্রেমী মানুষ। নিয়মের বেড়াজালে আমরাও ফিরছি সেই পথে। কিছুটা সময়ের মধ্যে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে পড়েছে চারপাশটা। অনেকটা নিথরভাবে বসে রইলাম বাঁধানো একটা বেঞ্চিতে। ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল খানিকটা সময়। হঠাৎ করেই ঝিঁঝি পোকার ডাকে যেন চৈতন্য ফিরে এল। যদিও ঝিঁঝি পোকার এই ডাক কেবলই চেতনার বিস্মৃতি বৈকি। পাশ্চাত্যের এ দেশে ফেলে আসা স্বদেশি ঝিঁঝি পোকারা যেন বড্ড বেশি বেমানান! এ দেশে হাজারো চাকচিক্যের মাঝে আজও খুঁজি ঘরের আঙিনায় রেখে আসা ঝিঁঝি পোকার দল। স্মৃতির জগতে আজও খুঁজি ঝোপের ধারে জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো। ফেলে আসা আবেগপ্রবণ সেই স্মৃতিগুলো আজও পিছু নেয় বারবার। সিক্ত হৃদয়ের ব্যাকুলতায় আজকাল কখন যে নয়ন জোড়া ভিজে ওঠে ঠিক টেরই করতে পারি না!

একসময় কেটে যায় ঘোর। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে আসে অনেকটা পথ। ঘনিয়ে আসে ফেরার সময়। ছোট ছোট পায়ে ফিরছি গাড়ির খোঁজে। কনকনে হিমেল হাওয়ায় নাক–মুখ বন্ধ হয়ে আসছে বারবার। দুই হাতে বুক চেপে ধরে হেঁটে চলেছি। হেলেদুলে একসময় গাড়িতে চড়ে বসি। ফিরেছি সেই পুরোনো পথেই। সেই সিলভিয়া, ফ্রাঙ্কলিন ফেলে আটলান্টা। তারপর মধ্য রাতে নীড়ে ফেরা।

মনির হোসেন: পিএইচডি শিক্ষার্থী, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র
ই–মেইল:<[email protected]>