মরা গাছের ছায়া

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

জামিলা স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে। কোলে আট মাস বয়সী ছেলে নিতু। ওই দূরে আলাকপুর বরাবর ট্রেন দেখা যায়। যাত্রীরা উৎসুক চোখে নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ট্রেনের অপেক্ষা করছে।

সামনেই দেখা যায় সুনয়না আর রেশমা দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর তারা উঁকি দিয়ে স্টেশনের দিকে আসা ট্রেনটিকে দেখছে। দীর্ঘ তিন বছর পর দুই বান্ধবীকে একসঙ্গে দেখে জামিলার মনে আনন্দ ঝলকানি দিয়ে ওঠে। আবার পরক্ষণেই তা নিভে যায়। কেমন যেন লজ্জা করতে থাকে।

দুই কদম এগিয়েও আবার চার কদম পিছিয়ে যায়। পাঘাচং স্টেশনের সাইনবোর্ড সেখানে ঠিক ওখানেই ফুলবাড়িয়ার পাকা রাস্তাটি এসে রেলসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জায়গাটা আকন্দ ঝোপে ঘেরা। ঝোপের পাশে নিজেকে আড়াল করে জামিলা ট্রেনটির স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে।

অদূরে তমিজউদ্দীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। নীল-সাদা পোশাক পরা মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। ঘুমন্ত নিতুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে জামিলা একদৃষ্টিতে স্কুলের দিকে চেয়ে আছে। দুই চোখ ছেপে অশ্রুর ঢল। আজ আর আশা-নিরাশার মধ্যে কোনো সেতু নেই তার।

নবম শ্রেণিতে ক্লাস শুরু হওয়ার কয়েক দিন পরই পক্ষাঘাতে বাবা অক্ষম হয়ে যায়। জামিলার পড়ালেখায় শুরু হয় নানান জটিলতা।

বছর শেষ হতে না হতেই বাবা ইহলোক ছেড়ে যান। তারপরই শুরু হয় নানান কথা। ছোট চাচা রজব আলীই এসে তার সদ্য স্বামীহারা ভাবিকে বোঝাতে লাগলেন—তোমার মেয়ে দেখতে-শুনতেও তেমন না। ভাইয়ের চিকিৎসায় দেনা শোধ করতে ৪ শতাংশ বাড়িটাও গেছে। থাকার জন্য আমার একটা ঘর তোমারে দিয়া রাখছি। আগামী বছর ছেলেডারে বিয়া করামু। তখন ঘরটা আমার লাগব। তখন তুমি কই থাকবা? ভালা একটা বিয়েতেও মেলা খরচ। এই লোক সব খরচ দিয়া বিয়া করতে রাজি হইছে। তুমি আর অমত কইরো না, ভাবি।

: ভাই রে, অমত করি না তো। মেয়েডার গায়ের রং কালা। মা-বাপ কালা। মেয়ে আর সুন্দর অইব ক্যামনে। তাই বইলা কী এই আশি বছইরা বুড়ার কাছে...।

: হ, আশি বছইরা বুড়া এইডাই তোমার চোখে পড়ে। কতগুলা সম্পত্তি, ওইডা তো দেখো না। একবার চিন্তা করছ, তোমার মাইয়্যা আজীবন পায়ের ওপর পা তুইলা খাইতে পারব। তোমারেও দেখভাল করতে পারব। অসুবিধা অইব না, ভাবি। খামাখা অমত কইরো না।

আড়ালে দাঁড়ানো জামিলা মা আর চাচার এই আলোচনা শুনে ভয়ে শিউরে ওঠে। ওই দিনই স্কুলে গিয়ে হেডস্যারের পা জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় বিস্তারিত বলে। হেডস্যার জামিলাকে ফ্রি স্টুডেন্ট শিপ দেন। তারপর নিজের পকেট থেকেই বই-খাতা-কলমের কিছু খরচ দিয়ে জামিলাকে বলেন নিয়মিত ক্লাস করতে।

এদিকে ঘরে খাবার নেই। ছোট ভাইটা স্কুলে যায় না। ক্ষুদায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। ধারদেনায় চারদিক অন্ধকার। অবশেষে মা আর ছোট ভাইটা এ বাড়ি ও বাড়ি ভাত ভিক্ষা করতে শুরু করে। এদিকে ক্ষুদায় জামিলার পাকস্থলী পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এমনই কোনো একদিন বিকেলে পাশের গ্রামের রহমান মিয়া জামিলাদের বাড়িতে আসেন।

রিকশা বোঝাই করে সঙ্গে নিয়ে আসেন আট কেজি গরুর মাংস। পাঁচ কেজি পোলাওয়ের চাল। দুটি মুরগি। দশ কেজি আলু। দুই লিটার তেল। আধা লিটার নারকেল তেল। ভালো মানের চারটি শাড়ি। আছে আরও কিছু কাপড়। ঘরে এসে নগদ বিশ হাজার টাকা জামিলার মায়ের হাতে দেন। রহমান মিয়া চৌকির ওপর জীর্ণ বিছানায় শুয়ে রজব আলীর সঙ্গে নানান গল্প করে যাচ্ছেন।

রাক্ষুসে খিদে নিয়ে মা-মেয়ে দুজন মিলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রান্না শেষ করে। এ বাড়িতে রান্নার এমন ঘ্রাণ জামিলা জীবনেও পায়নি। তৃপ্তিসহ খাওয়া শেষে সে লক্ষ করে, মা আর ছোট ভাই অয়নের চেহারাই যেন বদলে গেছে। খুশিতে বাক্যহারা মা টাকাগুলোর দিকে অপলক চেয়ে থাকেন। একটু পরপরই সেগুলো গুনছে। বেশ কয়েকবার গোনে। একবার চৌকির নিচে রাখে তো আরেকবার রাখে বালিশের নিচে।

এসব দেখে অয়ন বলে, মা, আমারে এক শ টেহা দেও না, আইসক্রিম খামু।

মা অয়নের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। এক শ টাকা হাতে দিতেই সে আনন্দে দুই তিন লাফ দিয়ে দেয় এক দৌড়।

জামিলাদের ঘরে আজ এই প্রথম হাসির সূর্যোদয়। এ পরিবারের কেউ আর অন্ধকার দেখতে চায় না। অভাবের দৈত্যর কোনো মায়াদয়া নেই। ওই দৈত্যের কথা ভাবতেই জামিলার ভয় করতে লাগল।

সন্ধ্যার আগেই কাজি ডেকে শুভবিবাহ সমাধা হয়ে যায়।

বাড়িসহ প্রায় চল্লিশ বিঘা জমির মালিক রহমান মিয়া। পাঁচ ছেলে আর তিন মেয়ে রেখে তাঁর স্ত্রী মাস দুই আগে মারা গেছেন। তাঁর ছোট ছেলে মুনির। মুনিরের বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। সব মিলিয়ে বিরাট সংসার। বুদ্ধিমান রহমান মিয়া কোনো ক্যাচাল তৈরি হতে দেননি। বেঁচে থাকা অবস্থাতেই ছেলেমেয়েদের জায়গাজমি ভাগ করে দিয়ে শুধু বাড়িটি নিজের নামে রেখে দেন।

নিতুর জন্মের সপ্তাহখানেক পরই জামিলার মা মারা যান। নানা রকম চিন্তাভাবনা করে রহমান মিয়া মনে মনে আশা করেছিলেন, প্রথম তরফের ছেলেমেয়েদের তো সবই দিয়ে দিলাম। এখন এই বাড়িটার দক্ষিণ দিকে পুকুরপাড়ে একটা ঘর তুলে ৫ শতাংশ জায়গা মা-ছেলেকে লিখে দেবেন।

না, রহমান মিয়ার এই চিন্তা আর সফল হয়নি। বার্ধক্যজনিত রোগে একদিন সকালে রহমান মিয়ার বর্ণিল জীবনের অবসান ঘটে।

আত্মীয়স্বজন সব চলে গেলে কুলখানির পরের দিন সকালে রহমান মিয়ার পাঁচ ছেলে একত্র হয়ে জামিলাকে টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে বের দিয়ে বলে, এই মাগি, তুই এ বাড়িতে ক্যান?

হতভম্ব জামিলা বলে, ক্যান, আমি নিতুর মা। তোমার বাবাই তো আমাকে...। এখন এসব কী বলছ তোমরা!

এমন লাঞ্ছনা আর অপমানে অনুভূতির সর্বত্র যেন আগুন ধরে যায়। জামিলার গলা জড়িয়ে আসে।

: উনিশ কি বিশ বছর বয়স তোর। তুই মাগি কী কইতে চাস। বাইর হ।

জামিলার দুই চোখে দরদর করে অশ্রু গড়াতে থাকে। নিতুকে বুকে জড়িয়ে বলে, আমার নিতু...।

: তিরাশি বছর বয়স অইছিল আমার বাপের। সম্পর্কে তোর দাদা। দাদা-নাতনির বাচ্চা আবার অয় ক্যামনে? ওই বেশ্যা, তুই কার লগে কোহানে পেট বাজাইছস। হেই পাপ আমার বাপেরে দিতে চাস?

এ কথা বলেই বড় ছেলে আসিদ জামিলার গালে খুব কষে চড় বসিয়ে দেয়। চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে যায় জামিলার। মাকে এভাবে মারছে দেখে আট মাস বয়সী নিতুও কাঁদতে থাকে। অবুঝ শিশু অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকায় শুধু।

একে তো মরা বাড়ি। সবদিক সামাল দিতে গিয়ে জামিলা নিজের প্রতি আর খেয়াল করতে পারেনি। গত রাতেও তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। নিতুকে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ক্লান্ত জামিলা নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। মারমুখী পাঁচজনের সামনে সে যেন ফাঁসির আসামি। ভয়ে কম্পমান জামিলা নিতুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে নীরবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

এখনই ট্রেন ছেড়ে যাবে। সারা এলাকা কাঁপানো এক হুইশেল দিতেই নিতু কেঁপে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে। স্টেশন ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটি বহু দূরের ওই সুহাতা বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তখনো জামিলা স্কুলের দিকে চেয়েই আছে। মনে পড়ছে মায়ের কথা। ভিজে যাচ্ছে চোখ দুটো। ঠিক তখনই স্কুল থেকে সমস্বরে জাতীয় সংগীতের আওয়াজ ভেসে আসে।

সব-হারানো জামিলার ভেজা চোখে ততক্ষণে অশ্রুর বান ডাকে। কঠিন এক মর্মবেদনার ভেতর দিয়ে তার মুখে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে আসে—লেখাপড়া রে লেখাপড়া, তোর চেয়ে আপন বুঝি জগতে আর কেউ নাই।

স্টেশন পার হয় জামিলা। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে। ভাদেশ্বরার কাছাকাছি আউটার সিগন্যালের অদূরে সে জামগাছটার ছায়ায় এসে বসে। কোলে শুয়ে মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা নিতুর দিকে চেয়ে সে বলে, নিতু রে খিদা লাগছে। তোরে লইয়া আমি অহন কই যামু?
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ই–মেইল: [email protected]>, ফেসবুক: Ishaque Hafiz