সরস্বতীপূজা ও হাতেখড়ির গল্প

হাতেখড়ির দৃশ্য
হাতেখড়ির দৃশ্য

আমাদের সময় লেখাপড়ার হাতেখড়ি হতো আদর্শলিপি বই আর টিনের স্লেটে চক দিয়ে লেখার মধ্য দিয়ে। ক্লাসের হিসেবে তখন ছোট ওয়ান, বড় ওয়ান তারপর ক্লাস টু। অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে। ১, ২ নিয়েও এই রকম ছড়া ছিল, যেটা এখন আর ভালোভাবে মনে করতে পারছি না। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সব একসঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। তারপর কোরাসে ওপরের ওই ছড়াগুলো পড়তাম। আর স্যারেরা লিখতে দিলে কে কার আগে লিখে স্যারকে দেখাতে পারে, সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা কাজ করত। লেখা জমা দেওয়ার ব্যাপারে আমি বরারই সবার আগে থাকতাম। একটা জমা দেওয়া হয়ে গেলে অন্য লেখাটা নিয়ে আগেই স্যারের টেবিলের পাশে ঘুরঘুর করতাম।

একদিন কোনো কারণে আমি সবার আগে লেখাটা জমা দিতে পারলাম না। আমার আগেই আমার ক্লাসের প্রবাল নামে একটা ছেলে লেখাটা জমা দিয়ে দিল। আর যায় কোথায়, আমার টিনের স্লেট দিয়ে দিলাম এক ঘা ওর মাথা বরাবর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল। সারা ক্লাস রক্তে মাখামাখি। সবাই ওকে নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগে আমি দ্রুত ক্লাস থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে সবার অজান্তে সোজা চৌকির তলায়। তারপর প্রবালের পুরা পরিবার আমাদের বাড়ি এসে আমার মায়ের কাছে নালিশ দিল। পরের ঘটনা আর না বলি। বড় হয়ে যাওয়ার পর এখন আমি প্রবালকে কাকা ডাকি। আর প্রবাল বলে ভাতিজা কী ঘা যে দিছিলা, এখনো আমার মাথার ওই জায়গায় চুলা ওঠে না। এ কথা বলে একদিন প্রবাল মাথাটা বাড়িয়ে দিল। দেখি সত্যিই মাথার অনেকখানি জায়গাজুড়ে গড়ের মাঠ। এভাবেই আমাদের লেখাপড়ার পাঠ শুরু হয়েছিল।

আমার একটা সূক্ষ্ম ইচ্ছা ছিল আমার মেয়ে তাহিয়াকেও আদর্শলিপি আর স্লেট দিয়ে লেখাপড়াটা শুরু করাব। আদর্শলিপি তো সহজেই জোগাড় হয়ে গেল আর চকও। কিন্তু স্লেট কোথায় পাই। একবার অফিসের কাজে খুলনা গিয়েছিলাম। ওখানে অনেক খুঁজে ডুমুরিয়া বাজারে স্লেট পাওয়া গেল। কিন্তু ওটা টিনের না, প্লাস্টিকের। তারপর আরও অনেক খুঁজে পেলাম কাঠের স্লেট। কিন্তু টিনের স্লেট কোথাও পেলাম না। ওইগুলো দিয়েই শুরু হয়ে গেল তাহিয়ার প্রথম পাঠ। এরপর খাতা পেনসিল এবং একসময় খাতা-কলম দিয়ে লেখা শুরু করল। এর মধ্যেই একদিন মেয়ে আমাকে বলল, ওর ক্লাসের সুষ্ময় নামে একটা ছেলে ওকে নাকি মেরেছে। আমি বললাম, তুমিও ওকে মেরে দাও তাহলে সমান সমান হয়ে যাবে। এরপর মেয়ে যা বলল, সেটার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাহিয়া বলল, ‘সুষ্ময় প্রতিদিন ক্লাসে হরলিকস নিয়ে আসে আর টিফিনের সময় হরলিকস খায়। ওর গায়ে জোর বেশি। তুমিও আমার জন্য হরলিকস নিয়ে এসো। তাহলে আমার গায়েও জোর হবে। আমি তখন ওকে মেরে দেব।’ আর ওদের স্কুলের পড়াশোনার ধরন নিয়ে আর না-ই বা বললাম। পড়াশোনা নিয়ে প্রতিদিন মা আর মেয়ের লেগে যায় আর আমাকে রেফারির দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে সিদ্ধান্ত সব সময়ই মেয়ের পক্ষে যায়। এটাই ছিল বাংলাদেশে আমাদের নিত্যদিনের রুটিন।

স্লেটে হাতেখড়ি
স্লেটে হাতেখড়ি

অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর আমাদের দল ভারী করতে স্বর্গ থেকে একসময় রায়ানের আগমন ঘটল। এরপর থেকে আমরা একেবারেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠি। কারণ আমাদের তিনজনের সঙ্গে একা ওদের মা কোনোভাবেই পেরে ওঠে না। তাহিয়ার পড়াশোনাও আগের চেয়ে বরং আরও শ্লথগতিতে চলছে। সময় গড়িয়ে রায়ান ইতিমধ্যেই তার তিন বছর শেষ করে চারে পা দিয়েছে। রায়ানকে কীভাবে হাতেখড়ি দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে মনে মনে একটা উপায় খুঁজছিলাম। এর মধ্যে একদিন ফেসবুকে একটা ইভেন্টের নোটিফিকেশন পেলাম সিডনিতে সরস্বতীপূজার। সঙ্গে সঙ্গে গোয়িং দিয়ে রাখলাম। কারণ এর আগে আমরা সপরিবার দুর্গাপূজা ও কালীপূজা দেখতে গিয়েছিলাম।

তারপর থেকে ক্ষণ গণনার শুরু। পূজার কার্যাবলির বিবরণ দেখে অবশ্য একটু দুঃখিত হলাম। কারণ হাতেখড়ির আয়োজন হবে দুপুরে। সে সময় আমি অফিসে থাকব। সকাল থেকে শুরু হয়ে প্রায় মধ্যরাত অবধি পূজা চলবে জেনে অবশ্য কিছুটা আশান্বিত হলাম। মনে মনে চিন্তা করলাম, অফিস শেষে অন্ততপক্ষে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে প্রতিমা দর্শন করতে যেতে পারব। অফিস শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরে পূজামণ্ডপে চলে গেলাম সপরিবার। মা সরস্বতীর সামনে বসে একটা ছবিও তুলে নিলাম, যেটা ওদের জন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। ছবি তোলা শেষ করে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা শুরু করলাম। এর মধ্যে এক দাদা আমাদের এক প্লেট প্রসাদ এনে দিলে আমরা অনেক আনন্দ নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। তাহিয়া আর আমার খাওয়া দেখে রায়ানও আগ্রহ দেখানোতে ওকেও একটু ভাগ দিলাম আমরা।

সবশেষে তাপস দা ও ইমন দার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। কিন্তু রায়ানকে হাতেখড়ি দেওয়ার আক্ষেপটা মনে মনে রয়েই গেল। তাই পরদিন তাপস দাকে মেসেজ দিয়ে বললাম, হাতেখড়ি দেওয়ার কোনো ছবি থাকলে যেন আমাকে পাঠান। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে ছবি পাঠিয়ে দিলেন। ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এটা যেন আমাদের শৈশবের হাতেখড়ির সেই চিরায়ত দৃশ্য। বাচ্চারা লাইন ধরে একে একে পুরুত মশায়ের সামনে যাচ্ছে। আর পুরুত মশায় পরম মমতায় প্রত্যেক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অনেক আদরে তাদের হাতে চক দিয়ে অন্য হাতে ধরা স্লেটে প্রথম অক্ষরটা লিখে দিচ্ছেন। সেটা লেখা শেষে বাচ্চারা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে পাশে দাঁড়ানো অভিভাবকদের দেখাচ্ছে। এখন অবশ্য চক স্লেটের জায়গায় এসেছে পেনসিল খাতা। কিন্তু হাতেখড়ির সেই উৎসবে একটুও ভাটা পড়েনি।

বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ বা অস্ট্রেলিয়া সব জায়গার বাচ্চারাই এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বেড়ে উঠছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদের পড়াশোনার প্রথম পাঠও শুরু হয়ে যাচ্ছে আইপ্যাড বা ট্যাবের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা যদি সামান্য একটু চেষ্টা করি তাহলে হাতেখড়ির মতো একটা অনেক সুন্দর স্মৃতি ওদেরকে উপহার দিতে পারি, যেটা ওদের সারা জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হয়ে থাকবে।

...

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>