হঠাৎ দেখা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এত বছর পর হঠাৎ ত্রয়ীকে দেখে আমি একটুও অবাক হইনি। আমার মন সব সময় বলত, হুট করে একদিন ত্রয়ীর সঙ্গে দেখা হবে। হয়তো সঙ্গে থাকবে ত্রয়ীর বর, ছোট দুটি বাচ্চা। আশ্চর্য! ত্রয়ীর সঙ্গে সত্যিই দুটো বাচ্চা। সঙ্গে কি ওটা ওর বর? কী জানি? ত্রয়ী তো ফিরেও তাকাচ্ছে না। কেমন পালিয়ে পালিয়ে থাকছে। কিন্তু একটা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আর কই পালাবে? আর আমি তো পিছু পিছু ঘুরেই বেড়াচ্ছি। ত্রয়ীকে দেখে মনে হচ্ছে খুব বিরক্ত। হবে নাই-বা কেন? ওকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছিলাম। আজ এত বছর পর আমায় দেখল। আর আমি ওর পিছু পিছু ঘুরছি। বেচারি কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। আমি সব সময়ই আবেগহীন। ওকে ছেড়ে চলে যেতে যেমন কিছু মনে হয়নি, আজ এত বছর পর ওকে দেখেও আমার কোনো ভালোবাসা উপচে পড়েনি। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। এই বিয়ের দাওয়াতে আমার আসার কথাই ছিল না। আর এখন মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস এসেছি!

খেতে বসেছি ত্রয়ীর টেবিলে। ব্যাপারটা মোটেই কাকতালীয় নয়। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম কখন ত্রয়ী খেতে বসবে! গোল টেবিলে আমি আর ত্রয়ী মুখোমুখি। চারপাশে আর কে বসেছে, আমি দেখার প্রয়োজনটাও বোধ করিনি। বললাম না, ত্রয়ীকে দেখতে এত ভালো লাগছে। আজ আফসোস হচ্ছে, কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না একদম। ত্রয়ীর কোনো দোষ ছিল না। লক্ষ্মী মেয়ের সব গুণ ওর ছিল। এখনো হয়তো আছে। বিয়ে, সংসার—এসব সামাজিক প্রথা আমাকে খুব বিকর্ষণ করে। একধরনের ভয় পেয়েই পালিয়ে গিয়েছিলাম। সোজা বাংলায় দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কিছু না জানিয়ে হুট করে যোগাযোগ বন্ধ করাটা ঠিক হয়নি মনে হচ্ছে। মেয়েটা ফিরেও তাকাচ্ছে না।

আবেগহীন হলেও আমার অবচেতন মন খুব চাইত ত্রয়ীর সঙ্গে আবার দেখা হোক। কেন আমার মন এটা চাইত, তার উত্তর আজ আমার কাছে পরিষ্কার! আমি আসলে সরি বলতে চাই। আমি আজ বুঝতে পারছি, কী বিশাল অপরাধ করেছিলাম! কিন্তু ত্রয়ী কি মাফ করবে? বিয়েবাড়িতে সবার সামনে যদি কষিয়ে চড় দেয়? না, থাক, মানসম্মান নিয়ে থাকি। বাচ্চাগুলো খুব ফুটফুটে। মায়ের দুই হাত ধরে রয়েছে দুজন। বেশ মায়া লাগছে দেখতে। বিয়ে বোধ হয় ত্রয়ীর বরের অতি আপন কারও। ভদ্রলোক মেহমানদারিতে মহা ব্যস্ত। সেদিক থেকে ত্রয়ী ম্যাডামের কোনো মাথাব্যথা দেখছি না।

লেখিকা
লেখিকা

কিন্তু ভেতরের অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে। ত্রয়ীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার এ সুযোগটা আর হয়তো পাব না কোনো দিন। অপমানিত হওয়ার যে ভয়টা পাচ্ছি, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি অপরাধী আমি ত্রয়ীর কাছে। মাফ না করলে না করুক, ক্ষমা চাওয়া উচিত। অন্তত ত্রয়ী মনে রাখবে যে আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম। ক্ষমা চাওয়ার জন্য মেয়েটাকে একটু একা পাওয়া দরকার। বিয়েবাড়ির এত হইচইয়ের মধ্যে কীভাবে কথা শুরু করি? আর ওর বরের সামনে তো প্রসঙ্গ তোলাই যাবে না। ভদ্রলোক কী আবার ভেবে বসেন!

সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে পেয়েও গেলাম। ওর বরকে এখন আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। ত্রয়ী দাঁড়িয়ে আছে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে এক কোণে। এখন গিয়ে কথা বলা যায়। রেগে গেলে দৌড় দেব! বরকে ডাকার আগেই পালাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

পেছন থেকে ডাকলাম। ত্রয়ী? কোনো সাড়া নেই। ভালো রাগ তো মেয়ের। আবার ডাকলাম। এই ত্রয়ী।

: জি, আমাকে বলছেন?

: ভালো আছো, ত্রয়ী?

: আমার নাম ত্রয়ী না তো! আপনি কাকে খুঁজছেন?

: ওহ ত্রয়ী! জানি খুব রেগে আছো। আমি যা করেছি, তা আসলে খুব অন্যায়। আমরা দুইটা মিনিট কথা বলি? প্লিজ, আমি আসলে ক্ষমা চাই তোমার কাছে।

: দেখুন আপনি ভুল করছেন। আমার নাম ফারিয়া। ত্রয়ী নয়।

: Like, seriously? একটু ঠান্ডা হও!

: আপনি কে? আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।

: আচ্ছা শোনো, তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছ না? বাংলা বিভাগ? আমি কত গিয়েছি তোমার ক্যাম্পাসে, ভুলে গেছ?

: জি না। আমি একজন ডাক্তার। আপনি সত্যি ভুল করছেন। আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন কেন বলুন তো? আপনাকে চিনি না আমি।

: তুমি...সরি আপনি দেখতে অবিকল আমার এক বন্ধুর মতো। আচ্ছা আপনার পরিচিত কারও নাম কি ত্রয়ী? Cousin? Or anyone close? যার সঙ্গে আপনার চেহারার মিল রয়েছে?

: দুঃখিত। আমি ত্রয়ী নামের কাউকে চিনি না ভাই। আমার চেহারার সঙ্গে কারও মিল নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানে পারলার থেকে সেজে এসেছি তো! তাই হয়তো আপনি গুলিয়ে ফেলেছেন।

: বিরক্ত করার জন্য সরি, আপু। আমি অত্যন্ত লজ্জিত। ভালো থাকবেন।

উফ্‌! আমি এত হতবাক জীবনে কখনো হইনি। দুটো মানুষের চেহারার এত মিল কীভাবে হয়? আমি কি সত্যিই চিনতে ভুল করেছি? নাকি ত্রয়ীর চেহারাটাই ভুলে গেছি? কী আজব ব্যাপার! এই মেয়ে ত্রয়ী নয়। ত্রয়ীর চোখে আমার জন্য আবেগ ছিল। এই মেয়ের চোখে বিস্ময়। আমার দায়িত্বহীনতা আর আবেগহীনতা আজ আমাকে বিশাল একটা শিক্ষা দিল। আজ প্রথমবারের মতো মনে হলো, ত্রয়ীর সঙ্গে বোধ হয় এই জীবনে আর দেখা হবে না। বিনা নোটিশে ত্রয়ীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট আমি আজ অনুভব করছি। এই অপরাধবোধ নিয়েই কি বেঁচে থাকব আমি? আমার মতো পাথরহৃদয়ধারীর চোখের কোণে আবিষ্কার করলাম জল। নিয়তির এ কেমন অভিশাপ! ফারিয়া না কী যেন একটা নাম বলল মেয়েটা? কী ভাববে সে আমাকে? মেয়েটির সঙ্গে কথা না বললেই ভালো করতাম হয়তো। এই বিয়ে অনুষ্ঠানেই আসা উচিত হয়নি আমার!

(ফারিয়া ওরফে ত্রয়ীর জীবনে আজকের রাতটা সবচেয়ে সুন্দর রাত। নিজের অজান্তেই খিলখিল করে হেসে উঠছে একটু পরপর। স্বামী পাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু ত্রয়ীর চোখে ঘুম নেই। অনেক দিনের চাপা কষ্ট আজ কিছুটা হলেও উড়ে গেছে। আত্মতৃপ্ত এই রাতে যে ত্রয়ীর না ঘুমোলেও চলবে।)

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি