একুশ বছর পর

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

কুষ্টিয়া শহরের থানা পাড়ার একটা নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে হাসান তার সেই বিখ্যাত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। তার বুকের মধ্যে কামারের দোকানের হাপর ওঠানামা করছে। হৃৎকম্পন এত বেশি দ্রুত হচ্ছে, যেন সে নিজে নিজেই গুনতে পারছে। সাইকেলের প্যাডেলে সমানে পা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, সাইকেলের চাকাগুলো অতি ধীরে ঘুরছে। বারবার ব্রেকের সঙ্গে আটকে যাচ্ছে চাকাটা। হাসান এর আগেও বহুবার এই রাস্তা দিয়ে গেছে। বাড়িটা ভালোমতো চেনার জন্য সে প্রথমে রিকশাকে ফলো করে এসেছে বেশ কয়েকবার। তা ছাড়া একা একা বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়েছে বাড়িটার সামনে দিয়ে। মাঝেমধ্যে ছাদ উঁকি দিয়ে দেখেছে। যদি কখনো ছাদে ওঠে। বিশেষ করে কালিপদ স্যারের বাসায় যাওয়ার সময় হাসান সব সময় এই রাস্তাকেই বেছে নিত, যদি দৈবক্রমে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কলেজের ক্লাসে সব সময় হাসানের চোখ চশমা পরা সেই মুখটাকে খুঁজে ফিরত। ক্লাসের ফাঁকে, করিডরে, এমনকি রাস্তায়ও সে একই মুখের সন্ধান করত।

সেই মুখ দেখামাত্রই মনে হতো দুনিয়াটা পুরোপুরি থেমে গেছে। চারপাশের লোকজনের আনাগোনা, হইহুল্লোড় সব থেমে যেত। তার পোশাক–পরিচ্ছদ, মাথায় ছোট করে কাটা চুলের রাবারের বাঁধন, চোখের চশমা, এমনকি চশমা পরার কারণে চোখের দুই পাশে চশমার ফ্রেম বসে যে দাগ হয়েছিল, সবই একেবারে শতভাগ দেখতে পেত হাসান। তার সঙ্গে কখনোই কথা হয়নি। কথা হওয়ার তেমন কোনো সুযোগও তৈরি হয়নি। মফস্বলের কলেজ। ছেলেমেয়েরা আলাদা আলাদা বসে। কমনরুমও আলাদা। একবারই শুধু কথা হয়েছিল। তবে সেটাকে কথা না বলে ঝগড়া বলাই শ্রেয়। নির্দিষ্ট বাসার কাছে যেতে যেতে তাকে নিয়ে ঘেরা সব স্মৃতিই মাথায় মধ্যে একবার করে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। আর মনে মনে ঠিক করছে, দেখা হলে সে কী কী বলবে।

নির্দিষ্ট বাসার কাছে আসার পর সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নামে হাসান। অন্যদিন হলে সে ভালোভাবেই নামতে পারত। আজ কেন জানি নামতে গিয়ে মনে হলো সে পড়ে যাচ্ছে। কোনোমতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে নিজেকে সামলে নেয় হাসান। এরপর পৃথিবীর সব সাহস বুকে নিয়ে দরজার কলিং বেলে হাত রাখে। আর কান পেতে শোনার চেষ্টা করে ভেতরে কলিং বেলের শব্দ হচ্ছে কি না।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। হাসান এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী। সিডনির যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি হাসানের অসহ্য লাগে। তবুও সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজকের দিনটা তার জীবনে অনেক বেশি উত্তেজনা বয়ে নিয়ে এসেছে। অফিস থেকে সিডনি বিমানবন্দরে যেতে বাস–ট্রেন মিলিয়ে আধা ঘণ্টা লাগবে। হাসান বেশ কয়েকবার গুগল ম্যাপে গিয়ে দেখেছে। নির্দিষ্ট দিনে অফিস থেকে সময়মতো বের হতে পারাটাই মূল সমস্যা। সকালে বেশ কয়বার ভেবে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে অবশেষে বসের সামনে গিয়ে বলল, আমার এক বন্ধু সিডনি আসছে। তাকে রিসিভ করার জন্য আমাকে একটু এয়ারপোর্টে যেতে হবে। বস বললেন, ফিরবে কখন। সাড়ে দশটার মধ্যে পারবে ফিরতে? হাসান বলল, আশা করি তার আগেই ফিরে আসতে পারব। কারণ শুধু দেখা করে চলে আসব। বস অনুমতি দিলেন। অফিস থেকে সামান্য হেঁটেই বাসস্ট্যান্ড। বাস আসতে কেন যেন দেরি হচ্ছে। বাস দেরিতে এলে ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে। তাহলে হাসান বিমান ল্যান্ড করার প্রায় এক ঘণ্টা পরে গিয়ে পৌঁছাবে বিমানবন্দরে। অবশেষে বাস এল। ট্রেনটাও ধরতে পারল সময়মতো।

বিমানবন্দরে পৌঁছে এক্সিটে দাঁড়িয়ে হাসান অপেক্ষা করতে থাকে। এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। বিমানবন্দরে কত মানুষ তাদের আপনজনদের জন্য অপেক্ষায় আছে। যখনই কাঙ্ক্ষিত আপনজনের দেখা মিলছে, তাদের উল্লাস হাসানকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা কিছু মানুষ বের হচ্ছে, যাদের রিসিভ করার জন্য কেউই আসেনি। সেই মানুষগুলোর মুখে একধরনের নিস্তব্ধ নির্লিপ্ততা। দেখলেই বুকের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এর মধ্যে একজন এসে গল্প জুড়ে দিল হাসানের সঙ্গে। কথায় কথায় জানা গেল, তারও বন্ধু আসছেন এই দেশে প্রথমবারের মতো। দীর্ঘ দশ বছর পরে তার সঙ্গে আজ দেখা হবে লোকটার। হাসান তাকে বলল, তার বন্ধুর সঙ্গে আজ দেখা হবে একুশ বছর পর। তিনি শুনে খুবই অবাক হলেন ও হাসানকে উইশ করলেন।

সকাল সাড়ে আটটায় বিমান ল্যান্ড করার কথা। সব ফর্মালিটি শেষ করে বের হতে সাড়ে নয়টা বাজার কথা। কিন্তু প্রথমবারে সাধারণত একটু বেশিই সময় লাগে। তাই হাসান অপেক্ষায় আছে। অনেক দিন এত দীর্ঘ সময় ধরে হাসান দাঁড়িয়ে থাকেনি। পা দুটি মাঝেমধ্যে জানান দিচ্ছে। এভাবে একসময় সাড়ে দশটা, পৌনে এগারোটা বেজে যায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষের আগমনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। হাসান অপেক্ষা করতেই থাকে।

একুশ বছর আগেও হাসানের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা হয়নি। একুশ বছর পরে এসেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। তার সঙ্গে হাসানের জীবনে আদৌ দেখা হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কারণ, এখন তাদের মধ্যে অনেক কিছুর ব্যবধান। সময়ের ও দূরত্বের। কিন্তু যেটার ব্যবধান নেই, সেটা হলো মানসিকতা ও চিন্তাচেতনার। একুশ এখানে শুধু একটা সংখ্যা মাত্র। যদিও স্থান কাল আলাদা। কিন্তু এই পুনরাবৃত্তির কোনো কারণ হাসানের যুক্তিতে আসে না। সেই মানুষটা কেন জানি হাসানের অনেক কাছের একজন। যদিও তার সঙ্গে জীবনে একবার মাত্র সামনাসামনি কথা হয়েছে। আর মুঠোফোনে দু–তিনবার। তবুও মানুষটার প্রতি তার মন একটা অনুভূতি তৈরি করে রেখেছে। সেটাকে আসলে ঠিক কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা মুশকিল। সেটা হয়তোবা ভালো লাগার অথবা সম্মানের। তবে হাসানের কাছে সেটা বন্ধুত্বের প্রতীক।

এমন একজন নিঃস্বার্থ বন্ধু, যাকে দেখার দরকার হয় না, ছোঁয়ার দরকার হয় না। এমনকি কথা বলারও দরকার হয় না। শুধু মোবাইল বা কম্পিউটারের বোবা কি–বোর্ডের ভাষাই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। বিজ্ঞানের এই আধুনিক যুগে এসেও এমন আটপৌরে একটা সম্পর্ক একজন মানব–মানবীর মধ্যে হতে পারে, সেটা ভেবেই হাসানের অবাক লাগে। এত কাছাকাছি এসেও সাক্ষাৎ না হওয়াটা হাসানকে অনেক পীড়া দেয়। তবুও হাসান সেই সম্পর্ককেই ধরে রাখতে চায়। আসলে দুজন মানুষের কোনো সুন্দর সম্পর্কের জন্য কাছাকাছি থাকার বা কথা বলার দরকার নেই। দরকার শুধু পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সম্মানবোধ। তাই হাসান ভুলে যেতে চায় একুশ সংখ্যাটিকে। শুধু এই শতভাগ নিঃস্বার্থ নির্ভেজাল সম্পর্কটাই তাকে জীবনচলার পথে অনেকখানি উৎসাহ দিয়ে যাবে, যেখানে সময় ও দূরত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
...

লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>