ফেরিওয়ালার চোখ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মাঝরাতে আকাশের কী ভীষণ নীরবতার কান্না।
বাতাসের করুণ শব্দ অথচ কী দারুণ!
মনে হয় দূরান্তের কোনো রমণী সলতে টেপা প্রদীপ জ্বালিয়ে
সারা রাত বসে না পাওয়ার আখ্যান রচনায় ব্যতিব্যস্ত।
আর তার কান্নাগুলো আকাশফেরি করে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
কালিদাসের মেঘদূতেরা যখন মর্ত্যের পৃথিবীকে আলিঙ্গনে মত্ত,
দিনের পড়ন্ত আলোয় দেখি একরূপ; আবার রাতের আকাশে দেখি বৃষ্টি আচরণে সমর্পণ।
সমর্পিত সেই বৃষ্টির শব্দ আমি বহুকাল শুনি না,
আমার বাড়ির উঠোনে, টিনের ছাদে, গাছের ডালে,
কংক্রিটের দোতলার ছাদের ঠিক পাশে বাতাবি লেবুর ফুলগুলো চুইয়ে পানি পড়ত,
আর কী সুন্দর লেবুর সুবাসভরা ঘ্রাণ!
সেই সুবাস হাত মুঠো করে, ধারণ করেছি মস্তিষ্কে।
আকাশের গায়ে কত কী যে আঁকিবুঁকির জন্ম দিই!
ছেলেবেলায় নয়, এখনো আঁকি।
ফুল, পাখি, গাছ, গান, মানুষ, হংস–শাবক,
বিনুনি দোলানো কোনো এক কিশোরীকে, বিরাট আলাদিনের দৈত্য আঁকি।
পোড়া মাটির ধোঁয়া ধোঁয়া সোঁদা গন্ধ পেতাম ছোটবেলায়, বৃষ্টির পর।
ঝিরিঝিরি শব্দে আধেক অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকার কলরবে, একটা শূন্যতার হাহাকার বিরাজ করত,
এখন আর তা নিতে পারি না,
তা নয়, কোথাও খুঁজে পাই না।
সেই গন্ধ, সময়, পরিবেশ।
বদলে যাচ্ছে স—ব।
আমার দেখার চোখ!
বদলে যাচ্ছে মানুষের কথা, ভাষা আর সমসাময়িকতা।
ঠিক তখন, দোলাচলের মায়া মুগ্ধতায় আমি নির্বাক দেখি,
বৃষ্টির ছাট আমার জানালায় এসে আছড়ে পড়ে,
শিউলি-বকুলের গন্ধ শুঁকে যেভাবে আলাদা করতে পারি
তেমনি আকাশের কান্নাকেও দিন রাতের পরতে পরখ করি;
অনুমান অপাঙক্তেয় হয়ে ঠাওর করি ভালোবাসার আকাশচুম্বিতা
আবার পরাজিতের চুম্বনে বুঝে নিই, ধরাতলের অবস্থান।
বৃষ্টিভেজা ম্যাপল পাতাকে আমি স্থলপদ্ম বলি;
প্রকৃতি যখন তার নগ্নতার শেষ ঢালিখানি শূন্যতায় ছুড়ে ফেলে।
আমি হঠাৎ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কাঁচা-পাকা-হলুদ-কমলা-ধূসর
ম্যাপলের আত্মসমর্পণ দেখি।
একই অঙ্গের কী বিচিত্র রূপ!
জীবনকে বুঝি অপার বিস্ময়ে, রঙিন মহামায়ার ঘূর্ণায়নে।
বিষণ্ন সন্ধ্যায় দেখি বিষণ্ন আকাশকে,
কী যেন এক কষ্টের তীব্রতা ধারণ করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে দগদগে ক্ষত নিয়ে
মর্ত্যের পৃথিবীকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইছে।
আকাশকে আলিঙ্গন করতে চাইল ধূসর মাটি।
ইচ্ছে পূরণের কথা আমার জানা নেই।
ভীষণ নীরবতায় কাঁদতে চাইল,
যেমন ভীষণ অভিমানে কাঁদে নারীরা!
তখন মেঘগুলো তুলোর মতো ভেসে বেড়ায়, কখনো মেঘ পালক হয়ে আবার কখনো বরফ কণা।
আমার অস্থির চক্ষু যুগল এখন কারও চোখে আর প্রণয় দেখে না;
হন্যে হয়ে কারও গম্ভীর মমতা ভরা চুম্বন দেখে না।
হাহাকার আর শোষণের পৃথিবীতে প্রকৃতি আজ বড্ড বেসামাল।
আকাশ দুরন্ত হয়ে ছুটে চলে রোদ-বৃষ্টি-মেঘের হয়ে, অবিশ্রান্ত।
আমি ফেরিওয়ালা হয়ে যাচ্ছি, ক্রমশ; আকাশ মেঘেদের দলছুট হয়ে।
...

রাওদাতুল জান্নাত: জেনেভা, সুইজারল্যান্ড।