ভালোবাসি ভালোবাসি

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

রঙ্গন বসে আছে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায়। আজ সারা দিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং ওর। আজ ছুটি। রিমঝিম বৃষ্টি ওকে নিয়ে যাচ্ছে সেই কবেকার কোনো এক না–ভোলা দিনের কাছে। পুরো বারান্দাটা কাচঢাকা। স্যারাউন্ড সিস্টেমে গান বেজে চলেছে—‘মেঘলা মেঘলা এই দিনে তোমায় পড়েছে মনে, সারা দুপুর বসে আছি কখন যে চুপিসারে আসবে আমার কাছে মেঘলা মেঘলা এই দিনে...।’

রঙ্গন হারিয়ে গেছে সেই ১৬ বছর আগে। মাত্র চান্স পেয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেলে। হোটেলটা পাহাড়ের মধ্যে। হোস্টেলে ওরই মতো আরও কত রঙিন প্রজাপতি এসে উঠেছে। সবার সঙ্গে পরিচিত হতে হতেই দিন চলে যায়। তারপর নতুনভাবে এত বেশি পড়াশোনার চাপ। ওর মনটা পড়ে থাকে গল্পের বইগুলোর কাছে। মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে বাবা–মা, ভাইবোনের কথা খুব মনে পড়ে যায়। চোখের পানি মুছে ছুটির অপেক্ষায় থাকে ও। মাঝেমধ্যে বাসা থেকে ফোন আসে। সেই আশায় যত ফোন ওর কাছে আসে ও ছুটে চলে যায় ধরতে। কিন্তু অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না।

এর মধ্যে ক্যাম্পাসে ইনডোর খেলা শুরু হয়ে গেল। রঙ্গন টেবিল টেনিস খেলাতে নাম দিল আর রোজ খেলতে চলে যেত সন্ধ্যা হলেই। তারপর শুরু হলো বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের তোড়জোড়। অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে কী যে খুশি ও।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সকাল সাতটায় ফোন এল ওর কাছে। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে। ফোনটা ধরতেই কেমন যেন মাদকতা মেশানো গলায় কেউ বলেছিল—‘রাজকন্যার ঘুম ভাঙল?’ রেখে দিতে গিয়েও পারল না ও। ওদিক থেকে ছেলেটা বলে বসল, ‘আমি ভালোবাসা চাইতে ফোন করিনি। কখনো কখনো অচেনা কাউকে খুব কাছের মনে হয়। আজ আমার খুব মন খারাপ। প্লিজ একটু কথা বলো। তোমার বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু কখনো চাইব না।’ রঙ্গন জানতে চাইল কী হয়েছে? সে বলল, ‘আমার ছোটবেলার বন্ধু বিদেশ চলে গেছে আজকে। কত কথা সেই রবিন ভাইকে নিয়ে। নিজের নাম বলল না শুধু। সেই শুরু। ছেলেটা দুই–তিন সপ্তাহ পরে ফোন করত একবার। শুধু কথা বলতে। বন্ধুর মতো। মাস কয়েক চলে গেল এভাবে।

লেখিকা
লেখিকা

পরীক্ষার আগের দিন ফোন করে বলে বসল, ‘একটু বাইরে আসবে? পাঁচ মিনিটের জন্য?’ রঙ্গন গেল। দেখল সদ্য পাস করা মানাম ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে বের হতে দেখে এগিয়ে এলেন। হাতে আধফোটা লাল গোলাপ। বললেন, ‘তুমি তো খুব ফুল পছন্দ করো, পরীক্ষার আগের দিন মন ভালো রাখতে নিয়ে এলাম। প্লিজ নাও। তুমি তো জানো, অন্য কিছু আমি কখনো চাইব না।’ পরীক্ষার মধ্যে শুধু আর একদিন ফোন করেছিলেন। বলতে, ‘রাজকন্যা কথা বলতে চাই সারা রাত একদিন।’

এর মধ্যে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। পরদিন রঙ্গন বাসায় যাবে। হঠাৎ মানাম ভাই দেখা করতে চাইলেন। রঙ্গন গেল। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল হঠাৎ। ছোট্ট ভিজিটিং রুমে ওরা দুজন শুধু। মানাম ভাই বলতে শুরু করলেন কোনো এক রাজকন্যাকে খুব মিস করবেন তিনি। তারপর হঠাৎ হাত ধরে বলে বসলেন, ‘ভালোবাসি’। রঙ্গন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আপনি কথা রাখেননি। ভালোবাসা চাইবার অধিকার আপনাকে আমি দিইনি।

তারপর রঙ্গন চলে এল ঢাকায়। মাঝেমধ্যে মনে হতো মানাম ভাই ফোন করেছেন, কিন্তু রক্ষণশীল বাবা–মা কারও সঙ্গেই কথা বলতে দেননি। ছুটির পর ক্যাম্পাসে ফিরে রঙ্গন বুঝল, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে কোথাও। আজেবাজে ফোন আসতে লাগল, ‘তুমি যদি অমুককে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক করো, মেডিকেল ছেড়ে চলে যেতে হবে। মানাম ভীতু ছেলে। ও তোমার পাশে কখনো দাঁড়াবে না’ রঙ্গন বোঝাতে চেষ্টা করল ওদের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বের। কাজ হলো না। একদিন রাতে ক্যাম্পাসে গুলির শব্দ শুনল রঙ্গন। মানাম ভাইয়ের জন্য এই প্রথম মন কেমন করে উঠল।

পরদিন অনেক ভোরে ওর ভিজিটর এল। গিয়ে দেখে মানাম ভাই। বলল, ‘প্লিজ গাড়িতে ওঠো, একটু কথা বলব। কালকে রাতে ওরা গুলি করতে চেয়েছিল আমাকে। বলেছে তোমার সঙ্গে আমি আর কখনো দেখা করতে পারব না।’ রঙ্গন ডিসিশন নিয়েছিল চলে যাবে বিদেশে। নতুন করে ডাক্তারি পড়বে। ভাবল শেষবারের মতো কথা বলে যাবে। উঠে পড়ল গাড়িতে। ওরা চলে গেল পতেঙ্গা সৈকতে। মানাম হাত ধরে বাতাস আর শব্দের তানে গান গাইল, ‘কান পেতে শোন এই বুকের মাঝে, কী যে এক তোলপাড়, যেন টর্নেডো ছোবল হেনেছে সে হঠাৎ করে, এমনি হলেই নাকি কাব্যতে কয়, ভালোবাসা হয়েছে যে প্রথম দেখায়।’ রঙ্গন বলেছিল ও চলে যাবে কিন্তু মানাম চোখের পানি মুছে বলেছিল, ‘তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা হবে না’। ওর অশ্রু ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে রঙ্গন বুঝে গিয়েছিল এটাই ভালোবাসা। অন্য কিছু না, অন্য কোথাও না। সৈকত থেকে ওই দিন দুপুরে মানামের বন্ধুর বাসায় গিয়ে বিয়ে। তারপর ক্যাম্পাসের বড়ভাইদের জানাল ওরা বিবাহিত। মানাম তার কমাস পরেই আর্মিতে চলে গেল। রঙ্গন পড়াশোনা শেষ করল চিটাগাং মেডিকেল থেকেই। জয়েন করল আর্মিতে। জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই একসঙ্গে পেরোল।

হঠাৎ বাংলোর সামনে হর্ন শুনে বাস্তবে ফিরে এল রঙ্গন। দেখল বাচ্চা দুটো মানামের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে বাসায় আসছে। মাথায় ছাতা নেই। দোতলায় উঠে আসতেই ছোট মেয়েটা বলল, ‘মা চল বৃষ্টিতে ভিজবে’। রঙ্গন বলল ঠান্ডা লেগে যাবে মা। মানাম এসে হাত ধরে বলল, ‘রাজকন্যা চল’। এ ভালোবাসার ডাক উপেক্ষা করার শক্তি ওর নেই। বৃষ্টির সঙ্গে গলা মিলিয়ে মানাম গাইছে, ‘সে যে ছন্দের তালে, পাহাড়ি নৃত্যে নেচে চলে...সে যে রূপে অপরূপা কোনো কবির কল্পনা...।’
...

ফারহানা আহমেদ: সানডিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।