একুশ বছর পর-দুই

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বিমানবন্দর থেকে ফিরে হাসানের খুবই মন খারাপ হয়ে যায়। ২১ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হাসান মোটেও আশা করেনি। যাহোক, জীবন চলে তার নিজের নিয়মেই। এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার হাসান মানবীকে মেসেঞ্জারে মেসেজ দিয়েছে, কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি। সপ্তাহখানেক পর একদিন মেসেজের উত্তর এল। মানবী জানাল, সে ভালো আছে ও ভালোমতোই সিডনি পৌঁছেছিল। উত্তর পেয়ে হাসান যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল আর মেসেঞ্জারে মানবীকে একসঙ্গে একগাদা প্রশ্ন করে বসল। বিমানবন্দরে কেন দেখা হলো না। মোবাইলের সিম কিনেছে কি না? দেখা করা যায় কীভাবে ইত্যাদি। মানবী একে একে মেসেঞ্জারে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জানাল, বিমানবন্দরে হাসানের সঙ্গে তার বোনের দেখা হওয়ায় তাদের দেখা হয়নি। হাসানের তখন মনে পড়ল বিমানবন্দরে মানবীর বোনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। হাসান মানবীর বোনকে জানিয়েছিল, সে–ও এসেছে তাকেই স্বাগত জানাতে।

মানবী জানাল, হাসানকে দেখে তার বোনের স্বামী জিজ্ঞেস করলে বোন নাকি বলেছিল, এই ছেলে কলেজজীবন থেকে আমার বোনকে বিরক্ত করছে। এখন আবার সিডনিতে এসেছে বিরক্ত করতে। এরপর তার বোন ও বোনের স্বামী বিমানবন্দরের অন্য এক্সিট দিয়ে মানবীকে বের করে নিয়ে যায়। ফলে হাসানের সঙ্গে মানবীর দেখা হয়নি। মানবী আরও জানায়, হাসান যদি বিমানবন্দরে না যেত তাহলে একদিন তাকে তার বোনের বাসায় দাওয়াত করতে পারত। ওই ঘটনার পর পরিস্থিতি কিছুটা অস্বস্তিকর। মানবী বোন আর বোনজামাইয়ের কাছে এখন কী করে বলবে তার দেখা করার কথা।

মেসেঞ্জারে প্রায় প্রতিদিনই তাদের দুজনের কথা হয়। হাসান জানতে চায় সিডনি তার কেমন লাগছে। উত্তরে মানবী বলে সবই ভালো শুধু দাওয়াতগুলো ছাড়া। দাওয়াতের কথা মনে হলেই তার গায়ে জ্বর আসে। তারপরও তাকে তার বোনের পরিচিতদের বাসায় দাওয়াতে যেতে হয়। মানবী প্রতিদিন কী কী করে, দিন শেষে সেটা নিয়ে হাসানের সঙ্গে আলাপ হয়। মানবীর তার বোনের বাসার বারান্দাটা খুবই পছন্দ হয়েছে। বেশ খোলামেলা। সামনে গাছ আছে। সেখানে অনেক পাখি আসে। আর তার ব্যস্ততা বোনের সদ্য ভূমিষ্ঠ মেয়েটাকে নিয়ে। তার খুবই খারাপ লাগবে তাকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু তবুও যেতে হবে। এই কদিনেই বাবুটা তাকে চিনে ফেলেছে।

হাসানের কাছে মেসেঞ্জারে তাদের দুজনের এই কথোপকথন অনেকটা অভিভাবককে লুকিয়ে টিন এজারদের পত্রালাপের মতো মনে হয়। হাসান মানবীকে বারবার বলছিল এত কাছাকাছি আসার পর দেখা হবে না সেটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। মানবীও যুক্তি দিয়ে যাচ্ছিল তার পক্ষে একা বের হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে বিমানবন্দরের ওই ঘটনার পর। অবশেষে একদিন মানবী বলল দেখা হতে পারে। সে বারান্দায় দাঁড়াবে। হাসান রাস্তা থেকে তাকে দেখে চলে যাবে।

মানবীর কথা শুনে হাসানের মনে হলো অন্ততপক্ষে দেখা তো হবে। মানবী হাসানকে তার বোনের বাসার ঠিকানা দিয়ে দিল। হাসান সেটা গুগল ম্যাপ থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে মানবীকে বারবার দেখিয়ে কনফার্ম হয়ে নিল বাসার অবস্থানটা ঠিক কোথায়। মানবী জানাল, তার বোনের বাসাটা দোতলায়। হাসান বাসার সামনে এসে কল দিলেই সে বারান্দায় চলে আসবে। মানবী আরও জানাল কোন সময়টা সে ফ্রি থাকে।

অফিস থেকে লাঞ্চের আগে বের হয়ে গেলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই হাসান তার সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসতে পারবে। নির্দিষ্ট দিনে হাসান অফিসের এক কলিগকে বলে বের হয়ে গেল। বের হয়েই মানবীকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিল সে রওনা দিয়েছে। স্টেশন থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটাপথে মানবীর বোনের বাসা। হাসান যেন সেই পথটুকু আর শেষ করতে পারছিল না। অনেক বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছিল হাসানের কাছে। হাঁটাপথটুকু মোটামুটি দৌড়ে পার হয়ে গেল।

বাসার সামনে গিয়ে বুকে ২১ বছর আগের সেই একই কম্পন অনুভব করল হাসান আর সেই সঙ্গে ভয়টাও। মানবী ফোন করে জানাল সে বারান্দায়। কিন্তু হাসান বলল, সে তো তাকে দেখতে পাচ্ছে না। রাস্তার পাশে যে বাসাটা সেটার সামনে অনেক গাছপালা। হাসান পুরো কম্পাউন্ডটা একবার ঘুরে ফেলল। কিন্তু কোনো বারান্দাতেই কাউকে দেখা গেল না। এভাবে কিছুটা সময় চলে গেল। হাসানের মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে সে এখানে অপেক্ষা করছে।

একটা চৌরাস্তা থেকে দ্বিতীয় কম্পাউন্ডেই মানবীর বোনের বাসা। সেখানে একসঙ্গে বেশ কয়েকটা বাসা। তাই হাসান দ্বিধায় পড়ে গেল আসলে কোন বাসাটা মানবীর বোনের। আবার মনের মধ্যে এমন শঙ্কাও কাজ করছিল, এবারও হয়তো তাকে বিফল মনোরথেই ফিরে যেতে হবে। মোড়ের প্রথম বাসাটার একেবারে শেষের সীমানার বাসার দেয়ালের পাশেই দুজন কাজ করছিল কোনো একটা ইউটিলিটি লাইন ঠিক করার জন্য। হাসান তাই বেশ লজ্জা পাচ্ছিল এভাবে ওই বাসার চারদিকে ঘুরঘুর করতে। আর ভয়ও হচ্ছিল এভাবে ঘুরঘুর//////// করতে দেখে কেউ যদি চোর ভেবে পুলিশটুলিশ ডেকে বসে।

হাসানকে মানবী ফোনে বলল, তুমি কি দুজন লোককে দেখতে পাচ্ছ যারা কাজ করছে। হাসান বলল, আমি তো তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। মানবী বলল, তুমি ওদিক দিয়ে ভেতরে এসো। আসলে সেটা ছিল পাশের বাসার ব্যাকইয়ার্ড। তাই হাসান মনে একটু ভয় নিয়ে মানবীর বোনের বাসার দেয়াল বরাবর পাশের বাসার ব্যাকইয়ার্ডে ঢুকে পড়ল। তারপর দোতলার বারান্দায় তাকিয়ে দেখল মানবী তার বোনের মেয়েকে কোলে নিয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। আসলে মানবী তার বোনের মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘোরার অছিলায় বারান্দায় এসেছে বোনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। অন্য আরেকজনের বাড়ির মধ্যে ঢুকে হাসান মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিল তাকে দেখার পর সেটা কেটে গেল।

বেশ কিছুটা দূরত্বে ছিল তারা আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দেখা। তারপর মানবী বলল, দেখা তো হলো এবার যাও। হাসান আবদার করেছিল আর কিছুক্ষণ থাকার। মানবী বলল, তার বোন যেকোনো সময় বারান্দায় চলে আসতে পারে। এখন তাকে ভেতরে চলে যেতে হবে। এ সময় হাসানের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে জুম করে বারান্দার সেই মানবীর একটা ছবি তুলে ফেলল। সেটা দেখে মানবী কপট রাগ করল। আর হাসান তার ফিরে আসার পথের দিকে পা বাড়াল। যদিও হাসানের আসার ইচ্ছা ছিল না। ফেরার সময় মানবীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে হাসানের কথা হচ্ছিল আর মনের মধ্যে ভিড় করছিল ২১ বছর আগের সব স্মৃতি। কুষ্টিয়ার থানাপাড়ার সেই নির্দিষ্ট রাস্তার সেই নির্দিষ্ট বাড়ি তার সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি। অবশেষে দুনিয়ার সব সাহস জড়ো করে কলবেলে চাপ এবং ফুটবলের গতিতে আবার বাউন্স করে ফিরে যাওয়া।

২১ বছর আগে কুষ্টিয়া শহরে তাদের দুজনের দেখা হওয়ার কথা ছিল। তখন তাদের সাক্ষাৎ হয়নি। সেই সাক্ষাৎই হলো ২১ বছর পরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। হাসান জানে না জীবনে আর কোনো দিনও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে কি না। এখন ছবিটাই হাসানের একজীবনের অনেক বড় স্মৃতি। দুজন মানব–মানবীর মধ্যে সিডনি শহরে এভাবে সাক্ষাতের গল্প হয়তো দ্বিতীয়টি নেই। দেয়ালের দুই পাশে দুজন। দুজনেরই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। তবুও কী এক অকৃত্রিম টান। যার মধ্যে নেই কোনো শর্ত, নেই কোনো চুক্তি। হাসান মাঝেমধ্যে ভাবে সেটাই ভালো হয়েছে কারণ শর্ত অথবা চুক্তি থাকলে হয়তোবা তাদের বন্ধুত্বটা এতকাল স্থায়ী হতো না।

এ লেখার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: