ওয়াশিংটনে সরস্বতী দেবীর আরাধনা

সমবেত পুণ্যার্থীদের একাংশ
সমবেত পুণ্যার্থীদের একাংশ

‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমোহস্তুতে।’

মন্ত্রজ্ঞানের মধ্য দিয়ে দেবীর মঙ্গলালোকে, মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী, গাঁদা, পলাশ ফুল, খাগের কলম, দোয়াত আর পঞ্চ প্রদীপের শুভ্র শিখা, ধূপ ধুনার সুগন্ধি, কাসর, ঢোল আর শঙ্খধ্বনিতে মেতে উঠেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বসবাসরত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য ও ব্যাপক আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ওয়াশিংটনের অন্যতম সুপরিচিত সংগঠন ‘গ্রেটার ওয়াশিংটন হিন্দু সোসাইটি’ সপ্তমবারের মতো আরভিং মিডল স্কুল মিলনায়তনে তিথিমতো দেবী সরস্বতী পূজার আয়োজন করেছিল ৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার।

শীতের হাওয়ায় দোলা লাগিয়ে বসন্তের আগমন। রঙিন বসন্তের দাগ গায়ে লাগিয়ে প্রকৃতি আরও রঙিন। সেই রঙিন প্রকৃতির দেবী বরণ, মাতা সরস্বতী, বাকদেবী, জ্ঞানদাত্রী, দেবীর একহাতে বীণা, আরেক হাতে বরাভয়। শুভ্রবর্ণা দেবী সরস্বতী হংসবসনা। শুক্লা পঞ্চমী তিথির সকাল থেকেই ভক্তবৃন্দ হলুদ, বাসন্তী, সাদা, লাল রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে পূজার ডালি হাতে আসতে শুরু করেন পূজামণ্ডপে। ধূপ-ধুনার গন্ধ ও কাসরের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে পূজামণ্ডপের চারিদিক। সকল ভক্তরা যেন বাকদেবীর আরাধনায় মত্ত হয়ে ওঠেন।

সমবেত পুণ্যার্থীদের একাংশ
সমবেত পুণ্যার্থীদের একাংশ

শুভ্রবর্ণা দেবীর পূজা অর্চনা, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, হাতে খড়ি, প্রসাদ বিতরণ, মধ্যাহ্নভোজ, সান্ধ্যভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা দিয়ে সাজানো হয়েছিল সারা দিনব্যাপী এই পূজা অর্চনাকে। পূজার পৌরোহিত্য করেন মহাদেব ঘটক।

বৃহত্তর ওয়াশিংটনে বসবাসরত বাঙালি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রীতিনীতি সম্পর্কে অবহিত করবার লক্ষ্যে বেলা চারটায় শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। খুদে শিল্পীদের সরস্বতী দেবীর মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্দা তোলা হয়। এ পর্বে খুদে শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের কাগজের নৌকা আবৃত্তিসহ সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা করে।

শিশুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
শিশুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের ‘বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারী’ সমবেত সংগীতের মধ্য দিয়ে। সোসাইটির শিল্পীরা উপস্থাপন করেন একক ও দলীয় সংগীত এবং একক ও দলীয় নৃত্য। সংগীতের সুর লহরি আর নূপুরের ঝংকারে মেতে ওঠেন দর্শকেরা। অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে ছিল ওয়াশিংটনের স্বনামধন্য সংগঠন হৃদয়বীণার পরিবেশনায় ‘হৃদয়ের একুল ওকুল’ এবং অন্যতম সংগঠক আবু রূমী আর তার দলের পরিবেশনায় ছিল আধুনিক ও মাটির গান। গায়ক নাসের চৌধুরীর কীর্তন শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ব্যান্ড শ্যাডো ড্রিমসের ভিন্ন ভিন্ন গানের চমৎকার মিশ্রণ যা কিনা শ্রোতাদের এ প্রবাসের মাটিতে মাতিয়ে তোলে। অনুষ্ঠানের পুরো সময় জুড়ে যন্ত্রানুষঙ্গে সংগত করেছেন তবলায় আশীষ বড়ুয়া, কিবোর্ডে আবু রুমি, হারমোনিয়ামে সীমা দাস ও রাজদীপ ভাদুরী, বাঁশি মো. মজিদ, মন্দিরা জয় দত্ত, জিপসি সঞ্জয় বড়ুয়া। শব্দনিয়ন্ত্রণে ছিলেন শিশির। স্টেজ লাইটে ছিল প্রান্তিক।

সরস্বতী দেবী
সরস্বতী দেবী

সাবলীল সঞ্চালনায় পুরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটির পরিচালনা করেন মিঠুন দস্তিদার, শর্মিলা বণিক, কৃষ্ণা দত্ত ও লোটাস রায়।

দেবীর অনন্ত রূপ, চেতনার অনন্ত রূপেরই আঁধার, তাঁর আরাধনায় সিদ্ধ হয় পার্থিব জীবনের সমগ্র জ্ঞান আরোহণ। মানব লাভ করে চেতনা। যাত্রা শুরু হয় অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোকে। শুভ্রবর্ণা দেবীর আরাধনায় সন্ধ্যা আরতির মাঙ্গলিক ছোঁয়া মানব জাতির মধ্যে শান্তির মোহিনীর সুর বেজে ওঠে। সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের উপস্থিতি এই সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠানটিকে যেন আরও মাধুর্যমণ্ডিত ও সার্থক করে তোলে। পরিপূর্ণতা পায় এই পূজা অর্চনা।