নারীকে সম্মান করুন দেশের উন্নতি হবেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কয়েক দিন আগে খবরটি পড়লাম। টেনশনমুক্ত রাখতে অন্তঃসত্ত্বা ইউএনও বীণাকে ওএসডি। চোখ ভিজে এল। মনে পড়ে গেল বাংলাদেশে ১৯৯৪-২০০৭ সাল পর্যন্ত আমার চাকরি ও আমার দুই সন্তানের জন্মের সময় আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।

অনার্স পরীক্ষার পর পরই আমি ১৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। ১৯৯৪ সালে আমি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। ১৫তম বিসিএসের ভাইভা দিতে চাইলে আমার প্রিন্সিপাল আমাকে ছুটি দেননি। এ জন্য ১৬তম বিসিএসের ভাইভা ঢাকা গিয়ে গোপনে দিয়ে আসি। ১৯৯৬ সালে আমি অন্তঃসত্ত্বা। ডেলিভারির মাত্র সাত দিন বাকি। ঈদের ছুটি শেষে অনেক কষ্টে খুলনা থেকে ময়মনসিংহ পৌঁছেই শুনলাম, আমাকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। আর ওখানকার আরেকজন ম্যাডামকে আমার জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। প্রেগনেন্সি ছাড়া আমার আর কোনো অপরাধ ছিল বলে আমার জানা নেই।

এরপর আমি ১৯৯৬ সালে ১৬তম বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করি। তখন ম্যাটারনিটি লিভ ছিল মাত্র এক মাসের। আমি কোনো লিভ পাইনি। তখন আমার এই কষ্টের কথা লিখেছিলাম ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকায়—ম্যাটারনিটি লিভের প্রয়োজনীয়তা কোথায় শিরোনামে। খুলনার সরকারি বিএল কলেজে আমার ছোট্ট মেয়ে শ্রেয়াকে নিয়ে অনেক কষ্টে চাকরি করছিলাম। আমার মাও তখন নজরুলনগর গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ক্লাস টেনে থাকতে। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তার মাঝেও তিনি আমাদের চার ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। নিজে এমএ ও বিএড পাস করেছেন এবং চাকরি করছিলেন। আমার মার সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাঁর ম্যানেজিং কমিটি, সে কথা আরেক দিন বলব।

বিএল কলেজে চাকরি করা অবস্থায় আমি ২০তম বিসিএসে ইনফরমেশন ক্যাডারে শাহবাগে পেস্টিং পাই। আবার অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে সিডনিতে মাস্টার্স করার সুযোগ পাই। দেশে বাচ্চা নিয়ে চাকরি করতে গিয়ে এত বাধা-বিপত্তিতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই স্বামী-সন্তানসহ চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়। দেশপ্রেমে গদগদ হয়ে দেশে আবার ফিরে গেলেও, যে সুযোগ-সুবিধা আর সম্মান একজন মা হিসেবে আমি অস্ট্রেলিয়ায় আমার ইউনিভার্সিটিতে বা কর্মক্ষেত্রে পেয়েছিলাম, তা কোনো দিনও ভুলব না।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এরপর আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই ২০০২ সালে। ইংরেজি বিভাগের প্রধান কখনো ছুটিতে গেলে আমাকে বিভাগের দায়িত্ব পালন করতে হতো। এমন একদিন যেদিন আমি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে, আমার একজন সিনিয়র সহকর্মী তাঁর প্রোমোশনের ফাইল আমার কাছ থেকে সই করিয়ে নিয়ে যান। বিকেলবেলা বিভাগীয় প্রধান ফোন করে বললেন, আপনি...এর প্রোমোশনের ফাইল কীভাবে সই করলেন? আপনি জানেন উনি কোন ব্লকের লোক? এর পরপরই প্রোভিসি ও ভিসি স্যার ফোন করে একই কথা বললেন, ‘তোমাকে পলিটিকস বুঝতে হবে। বিভাগীয় প্রধান ওই ফাইল সাইন করেন না আজ কত দিন। আর তুমি একদিন দায়িত্বে থেকে ফাইল ছেড়ে দিলে। এ রকম করলে তো তুমি চাকরি করতে পারবে না।’

আমি তো ব্লক, লাল-সাদা-নীল বুঝিনি তখনো। আর ওই ভদ্রলোক যাঁর ফাইল স্বাক্ষর করে আমি বিপদে পড়েছিলাম, তিনি কীভাবে তার প্রতিদান দিয়েছেন জানেন? আমি সৌদি আরবে বিনা বেতনে বৈধ লিয়েনে থাকা অবস্থায়, আমার জায়গায় তাঁর পছন্দের অন্য একজনকে নতুন নিয়োগ দিয়েছেন। কারণ তিনি তখন বিভাগীয় প্রধান।

যা হোক, ২০০৫ সালে আমি যুক্তরাজ্যে এক ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে আমার রিসার্চ পেপার উপস্থাপন করি। ২০০৬ সালে দীর্ঘ ১০ বছর পর আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা হই। এ সময় আমি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতির জন্য আবেদন করি। ম্যাটারনিটি লিভে থাকা অবস্থায় ভিসি স্যারের রুমে আমাকে জরুরি তলব করা হয়। অথচ তখন ডাক্তার আমাকে কমপ্লিট বেড রেস্ট দিয়েছেন। দীর্ঘ পাঁচতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডিপার্টমেন্টে কাউকে না পেয়ে ভিসি স্যারের রুমে গিয়ে দেখলাম ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সবাই সেখানে। বিভাগীয় প্রধান, আমার পূর্বের ছাত্রী ও তখনকার কলিগ, লাল-নীল-সাদা সব শিক্ষক সেখানে উপস্থিত। ভিসি স্যার বললেন, ‘বিভাগীয় প্রধান ভুল করে আপনার প্রোমোশনের ফাইল সই করেছিলেন। আপনার ইংল্যান্ডের পেপার পাবলিশ না হওয়া পর্যন্ত শুধু অ্যাকসেপটেন্স লেটার দিয়ে আপনার আবেদন, এ জন্য বাতিল করা হলো। এ ব্যাপারে আপনার বিভাগীয় সবার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং সবাই এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।’

বিভাগের কেউ এ ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করেননি। আমার তখন উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস। দুই বেলা ইনসুলিন নিতে হতো। ক্রনিক এনিমিয়ার কারণে নিয়মিত রক্ত নিতে হতো এবং গাইনোকোলজিস্ট আমাকে কমপ্লিট বেড রেস্ট দিয়েছিলেন। আমার প্রোমোশনের আবেদন বাতিল করা হলো। আমার আবেদন বাতিল করার জন্য এভাবে নাটকীয়ভাবে আমি যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সবার সামনে আমাকে এভাবে অপমান করার মানে আমি আজও খুঁজে পাই না। শুধু তা-ই নয়, এরপর আমার ইংল্যান্ডের পেপার পাবলিশড হওয়ার পরও সিলেকশন বোর্ডের মিটিং বাতিল করা হয়েছে বহুবার। অতিষ্ঠ হয়ে আমি যখন সৌদি আরবের কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য বিনা বেতনে লিয়নের আবেদন করি, সেটি শেষ মুহূর্তে সিন্ডিকেটে বাতিল করা হয়। বাধ্য হয়ে আমি আর্ন লিভ নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ি।

লেখিকা
লেখিকা

যা হোক, আমার ব্যক্তিগত কষ্টের কথা বলার কারণ একটাই, বীণা বা আমার মতো বাংলাদেশে সব কর্মজীবী মা, যে ইটভাটায় কাজ করেন বা গার্মেন্টসে কাজ করেন, সবারই অবস্থা একই। এখন আমি কানাডায় থাকি। এখানে একজন নারী, একজন সন্তানসম্ভবা মা, একজন মেয়ে সরকারের কাছ থেকে যে আইনগত অধিকার ও সবার কাছে যে সম্মান পান, তা বলে শেষ করা যাবে না। এখানে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মাতৃত্বকালীন ছুটি, পিতৃত্বকালীন ছুটি, সবেতনে ও বেতন ছাড়া আরও কত ধরনের ছুটি যে আছে, বলে শেষ করা যাবে না। বাচ্চা জন্ম নিলে সরকার চাইল্ড বেনিফিটও দেয়। সর্বোপরি এখানে নারী নির্যাতন তো দূরে থাকুক, প্রত্যেকে যেভাবে নারী ও মেয়েদের সম্মান এবং তাদের অধিকার আদায়ে একতাবদ্ধ, তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। নারীদের অসম্মান বা নির্যাতনের যে কঠোর শাস্তির বিধান এ দেশে আছে, তা সত্যি অতুলনীয়।

প্রিয় পাঠক দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ আর কানাডার তুলনা করে আমার মাতৃভূমিকে ছোট করার বা আমার প্রাক্তন সহকর্মীদের কাউকে ছোট করা বা কষ্ট দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। আমি জানি কানাডার জন্ম অনেক আগে। বাংলাদেশের জন্ম অনেক পরে। ওদের ইতিহাস বলে দেয়, অনেক নির্যাতনের ইতিহাস তাদেরও আছে। কিন্তু তারা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখানে যেতে হলে আমাদের বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। বাংলাদেশে যেভাবে শিশু ও নারী ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন ও সহিংসতা চলছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার অচিরেই। শুধু আইন প্রয়োগ করলেই হবে না, আইনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই নারীর প্রতি সম্মান বাড়াতে হবে। নারীকে সহযোগিতা করতে হবে তার কর্মক্ষেত্রে। কারণ নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো একটি ভীষণ কষ্টকর কাজ করে। আর পুরুষের জন্ম হয় নারীরই গর্ভে। তাই মাতৃত্ব বা নারীত্বের সম্মান সমগ্র সমাজকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে। নারীর প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করুন। নারীকে তার যোগ্য সম্মান দিন। তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন। দেখবেন বাংলাদেশও শামিল হবে উন্নত দেশের কাতারে।

ভালো থাকুন সবাই, ভালো রাখুন সবাইকে।
...

মাহমুদা নাসরিন: শিক্ষক ও সমাজকর্মী।