ভালোবাসার বসন্ত দিনে...

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

চারদিকে বসন্তের মিষ্টি হাওয়ার আবহ। গাছে গাছে রং–বেরঙের ফুলের বাহারি শোভা। বসন্তের দ্বিতীয় দিন। আজ তথাকথিত ‘ভালোবাসা দিবস’। সকাল থেকেই অর্কর মনটা বেশ ফুরফুরে। দীর্ঘ পাঁচ মাস ফোনে জেরিনের সঙ্গে মন দেওয়া–নেওয়ার পালা শেষ করে আজ একদম আজীবনের জন্য জেরিনের সঙ্গে জীবন কাটাবে বলে প্রস্তাব করবে। অর্কর বিশ্বাস জেরিন অর্ককে ফিরিয়ে দেবে না। এত দিন কথা বলে অন্তত এটুকু মনে হয়েছে, জেরিন অর্ককে ভীষণ ভালোবাসে। এবার আর হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হবে না। সবাই কী এক নাকি? এমন সময় অর্কের মোবাইলটা বেজে উঠল। অর্ক ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল কলটা জেরিনের।

: অর্ক ফোন ধরে হ্যালো বলে বলল, জেরিন দেখ তো কী কাণ্ড! আমি এখন তোমার কথাই ভাবছিলাম আর তুমি ফোন দিলে।

তুমি তো সারাক্ষণই আমার কথা ভাব। এ আর নতুন কী? শোনো, আমি কিন্তু রেডি। বাসা থেকে বের হচ্ছি। তুমি চলে এস তাড়াতাড়ি।

অর্ক খুশিতে আটখানা। বলল, আমিও রেডি। বের হচ্ছি। তুমি শাড়ি পরেছ তো? খোঁপায় বেলি ফুলের মালা।

জেরিন বিরক্তির সঙ্গে বলল, শাড়ি? তোমার কি মাথা খারাপ? শাড়িতে আমি কমফোর্ট ফিল করি না। তুমি তো জানই আমি শাড়ি পছন্দ করি না।

অর্ক ভীষণ অবাক হলো, জেরিনই একদিন কথায় কথায় বলেছিল শাড়ি ওর প্রিয় পোশাক। যাক সে কথা।

: ঠিক আছে জেরিন, তুমি বাংলা একাডেমি চলে আস। আমি আসছি।

: বাংলা একাডেমি? তুমি তোমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বাংলা একাডেমি মিট করবে? ওখানে কী? ধানমন্ডি আস। একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমাদের ফার্স্ট ডেট হবে বাবু!

: বাবু? জেরিন তোমাকে না বলেছি আমাকে বাবু না ডাকতে? অসহ্য লাগে। আর চায়নিজ রেস্টুরেন্টে কেন যাব? বাংলা একাডেমিতে বইমেলা হচ্ছে। তুমি তো জানো আমি বই কত ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার মাঝেই তো তোমাকে দেখতে চাই। আগে বইমেলায় আসি। তারপর না হয় তোমাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করব।

হতাশ কণ্ঠে জেরিন বলল, ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছা। দেরি করো না কিন্তু! বাই।

অর্ক ফোনটা রেখে ঘড়ি দেখল। সকাল দশটা। এখনই বের হতে হবে। তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হতে যাবে, পেছন থেকে হঠাৎ ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল।

: অর্ক ভাই?

বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি, দু হাতভরা রেশমি চুড়ি, খোঁপায় গাঁদা ফুলের মালা। অপূর্ব মায়াকাড়া দুটি চোখ!

: স্পর্শীয়া তুই? দিলি তো আমার যাত্রাটা নষ্ট করে। পেছন থেকে ডাকলি কেন? দেখছিস না বের হচ্ছি?

: সরি অর্ক ভাই! আমি আসলে একটু বাংলা একাডেমি যাব। তুমি যদি যাওয়ার সময় আমায় নামিয়ে দিতে! মামি বলল তোমার সাথেই যেন যাই।

: মা এ কথা বলেছে? কেন? অন্য দিন তুই একা যাস না ভার্সিটি? আজ কী হলো? মা? শুনছ?

রান্নাঘর থেকে অর্কর মা ছুটে এলেন।

: তুমি স্পর্শীয়াকে বলেছ আমার সাথে যেতে?

: হ্যাঁ, বলেছি! আজ পাত্রপক্ষ স্পর্শীয়াকে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে আজই বিয়ে পড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু স্পর্শীয়া আজ বইমেলায় যাবেই যাবে। কোনো কথা শোনে না। এত বারণ করলাম তবুও যাবে। মা-বাবা নেই, ওর আবদার কি কখনো অপূর্ণ রেখেছি? সে জন্য বলেছি, তোর সাথে যেতে। তুই তো আজ আবারও ছ্যাঁকা খেয়ে ফিরে আসবি!

: মা তুমি মানুষ না শত্রু? একটা শুভকাজ শুরু হওয়ার আগেই তুমি এমন অশুভ উক্তি কী করে করো?

: পূর্বের অভিজ্ঞতা তাই বলে! যাই হোক, তোর পাগলামি তুই সামলা। আপাতত স্পর্শীয়াকে নিয়ে যা!

টুংটাং শব্দ তুলে রিকশা ছুটছে বাংলা একাডেমি। অর্ক পরে আছে নীল রঙের পাঞ্জাবি। গুনগুন করে গান গাইছে। স্পর্শীয়া বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে!

: কীরে স্পর্শীয়া? একদম চুপ! কথা বলছিস না যে?

: কী কথা বলব?

: এই যে আজ তোকে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে বিয়ে হয়ে যাবে। তুই চলে যাবি বরের সঙ্গে!

: আমি চলে গেলে বুঝি খুব খুশি হবে? আপদ বিদায় হবে!

: ধুর! কী যে বলিস! তুই চলে গেলে আমার লাইব্রেরি সামলাবে কে? এতগুলো বইয়ের যত্ন কে নেবে শুনি?

: কেন? জেরিন দেখবে। আজ তো তুমি জেরিনকে প্রপোজ করতে যাচ্ছ।

অর্ক কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর গুরুগম্ভীর ভাবে বলল, হয়তো! জানি না। আর সবার মতো যদি আজ জেরিনও আমাকে ফিরিয়ে দেয়? কেউ কথা রাখেনি!

অর্কর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল স্পর্শীয়া। মৃদুস্বরে বলল, কেউ কথা রাখতে চেয়েছিল হয়তো!

অর্ক চমকে উঠল, মানে? কী বললি!

: না মানে, জেরিন তোমার কথা রাখবে কিন্তু তোমার প্রপোজ করার ধরনে আগে পাঁচজন প্রত্যাখ্যান করেছে। জেরিন কী করে সেটাই দেখার বিষয়! আচ্ছা? এভাবে প্রপোজ না করলে হয় না? এখনকার মেয়েরা অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করে! এতবার রিফিউজ করেছে তবুও তোমার শিক্ষা হয় না!

অর্ক দৃঢ় কণ্ঠে বলল, দেখ স্পর্শীয়া! আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল! যত দিন না আমার প্রচলিত পদ্ধতিতে অর্থাৎ আমি যেভাবে প্রপোজ করতে চাই সেভাবে সম্মতি না দেবে, আমি বিয়ে করব না। আমি যাকে আমার জীবনসঙ্গী করব তাকে অবশ্যই বই ভালোবাসতে হবে। আমার মতো বইয়ের সাগরে ডুবে থাকতে হবে, আমার বইয়ের যত্ন নিতে হবে!

: সারাক্ষণই যদি তোমার বউ বই নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে সংসার দেখবে কে? তোমাকে রান্না করে খাওয়াবে কে? তুমি তো না খেয়ে মরবে!

: কেন? তুই কি বই পড়িস না? তোকে তো আমি বইয়ের মাঝেই দেখি। এরপরও তো তুই আমাদের পুরো সংসারটা আগলে রেখেছিস! তোর বিয়ে গেলে মায়ের খবর আছে। মানা করে দে পাত্রকে!

স্পর্শীয়া কাতর স্বরে অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ে ভেঙে দেব? তাহলে তো কেউ আমাকে বিয়ে করবে না।

অর্ক কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ধুর! তোর মতো এমন অপ্সরীকে কে বিয়ে করবে না?

: তুমি করবে?

অর্ক ভড়কে গেল, কী বললি?

স্পর্শীয়া উচ্চ স্বরে হেসে কথাটা উড়িয়ে দিল, মজা করেছিলাম! আচ্ছা তুমি কি চোখের ভাষা বোঝো অর্ক ভাই!

অর্ক বিজ্ঞের মতো বলল, কেন বুঝব না? অবশ্যই বুঝি!

: আমার চোখের ভাষা বোঝো? স্পর্শীয়ার চোখের কোণে জল!

অর্ক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না।

রিকশা এসে থেমেছে দোয়েল চত্বরের সামনে। স্পর্শীয়া দ্রুত রিকশা থেকে নেমে গেল। যাওয়ার বেলায় শুধু এটুকু বলে গেল, আজ হয়তো আমার বিয়ে যাবে। হয়তো আজই শেষবারের মতো তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটালাম। তুমি ভালো থেকো অর্ক ভাই!

অর্কর মোবাইল বেজে উঠল।

: হ্যালো অর্ক? এসেছ?

: হ্যাঁ জেরিন। আমি চলে এসেছি। তুমি কোথায়?

: কোথায় আর? যেখানে আসতে বলেছ! তুমি আর জায়গা পাওনা। বইমেলায় গার্লফ্রেন্ডের সাথে মিট করবে?

: জেরিন তুমি ওখানেই থাক। আমি আসছি।

শুক্রবার ছুটির দিন। সকাল থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে উপচে পড়া ভিড়। জেরিন ভীষণ বিরক্ত! অর্কর মতো একটা রুচিহীন ছেলের সঙ্গে কীভাবে যে সম্পর্ক হলো! ভালো কোথাও গেলে যদি খরচ বেশি হয় তাই এই বইমেলায় ডেকেছে। আজ নাকি ‘ভালোবাসা দিবস’! এই বইমেলায় আমাকে সে প্রপোজ করবে। যত্তসব!

অর্ক ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বইমেলার দিকে। স্পর্শীয়ার শেষ কথাগুলো কানে বাজছে। কী বলে গেল মেয়েটা?

মোবাইলটা বেজে উঠল।

: অর্ক তুমি কোথায়?

: আসছি!

: তোমার আর আসতে হবে না। আমি এমন লম্বা লাইন পেরিয়ে বইমেলায় যেতে পারব না। আমি ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছি। তুমি চলে এসো!

অর্কর মনটা বিষণ্নতার কালো মেঘে ছেয়ে গেল। জেরিনের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল কিন্তু...।

আলো-আঁধারির মাঝে টুংটাং শব্দ যেন নিঃশব্দকে ছাপিয়ে অর্কর কর্ণকুহরে ভীষণভাবে আঘাত করছে। নির্লিপ্ত নয়নে চেয়ে আছে জেরিনের দিকে। জেরিন আয়েশ করে কাঁটা চামচ দিয়ে নিখুঁতভাবে চাওমিন খাচ্ছে। খাওয়ার মধ্যেও একটা আর্ট আছে। জেরিন সেটা জানে। কেবল জানে না একটা মানুষের মনের আকুতি! অর্ক আজ হতাশ! মেয়েটার বইমেলার প্রতি এত অনীহা কেন?

: আচ্ছা জেরিন, তুমি বইমেলায় না গিয়ে সোজা রেস্টুরেন্টে কেন চলে এলে?

জেরিন আদুরে গলায় অর্ককে বলল, দেখ বাবু! আমি চেয়েছি আজ তোমার সঙ্গে নিরিবিলিতে কোথাও সময় কাটাতে। বইমেলার এত ভিড়ে কি কথা বলতে পারতাম ঠিকমতো? তুমিই বলো!

: উহ্ জেরিন! তোমাকে কতবার বলব, আমাকে বাবু ডাকবে না। আমার অসহ্য লাগে! আমাকেই যদি বাবু ডাকো নিজের বাচ্চাকে কী ডাকবে?

: সরি! আসলে মনে থাকে না। তোমাকে একটু বেশি লাভ করি তো তাই আর কী? তো আমার সারপ্রাইজ? এক মাস ধরে আজকের কথা বলে আসছ। আমার তো আর তর সইছে না!

অর্কর সমস্ত শরীর কাঁপছে! ফোঁটা ফোঁটা ঘাম নাকের ডগায় জমা হচ্ছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আভাস আজ আগেই পেয়েছে কিন্তু তবুও শেষ চেষ্টা করে দেখা যায়। জেরিন যদি সত্যি অর্ককে ভালোবাসে তবে অর্ককে ফিরিয়ে দেবে না!

: অর্ক? কী ভাবছ? আমার সারপ্রাইজ? আমি কিন্তু খুব এক্সাইটেড!

অর্ক মৃদু হেসে জেরিনকে বলল, তাহলে চোখ বন্ধ করো আর হাত দুটো বাড়াও!

জেরিন কিছুটা অবাক হলো। দুই হাত বাড়াতে কেন বলল? আজ অর্ক অবশ্যই প্রপোজ করবে কিন্তু এক হাত বাড়াতে বললে বুঝত অনামিকায় একটি আংটি জ্বলজ্বল করবে কিন্তু দুই হাত দিয়ে কী করবে? কিছুক্ষণ ভাবল! হয়তো দুই হাতে মায়ের হাতের সোনার চুড়ি পরিয়ে দেবে! মন্দ না! আবার অর্ক হাতে করে র‌্যাপিংয়ে মোড়ানো একটা বাক্স এনেছে, ওটাও দিতে পারে। যাই হোক, দেখা যাক!

: কই চোখ বন্ধ করো!

জেরিন দুই চোখ বন্ধ করে হাত দুটো বাড়িয়ে দিল।

অর্ক জেরিনের হাতে বাক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, উইল ইউ ম্যারি মি জেরিন?

জেরিনের ঠোঁটের কোণে হাসি! দুই চোখ খুলে আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলল, ইয়েস মাই ডিয়ার! আই রিয়েলি লাভ ইউ!

অর্ক অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, সত্যি জেরিন!

: হোয়াই নট? কিন্তু এত ভারী বক্সে কী এনেছ অর্ক?

: খুলেই দেখ?

: আমি ভাবলাম তুমি আমাকে রিং পরিয়ে প্রপোজ করবে!

: রিং থেকেও অনেক মূল্যবান জিনিস তোমার জন্য এনেছি।

: সত্যি? জেরিন আনন্দে আত্মহারা। তাহলে তো আর দেরি করা যায় না!

জেরিন দ্রুত র‌্যাপিং পেপারটা খুলে ফেলল। বাক্সটা খুলে চোখ বড় বড় করে তাকাল। বাক্সের ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে এল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস, জীবনানন্দ দাসের কবিতার বই।

জেরিন রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ল। চিৎকার করে বলে উঠল, এগুলো কী? বই? তুমি ভালোবাসা দিবসে গার্লফ্রেন্ডকে একগাদা বই দিয়ে প্রপোজ করেছ? না একটা আংটি, না চুড়ি, না ফুল শুধু বই? তোমার মতো একজন বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার এত কিপটা?

অর্ক গম্ভীর কণ্ঠে বলল, বই দিলে কি মানুষ কৃপণ হয়ে যায়?

: তাই বলে কেউ বই দিয়ে প্রপোজও করে না। আমি ফ্রেন্ডদের কাছে মুখ দেখাব কী করে?

অর্ক জেরিনের হাত থেকে বইগুলো ফিরিয়ে নিল।

: তোমাকে কারও কাছে মুখ দেখাতে হবে না। আজকের পর থেকে আমিও তোমার মুখ দেখতে চাই না।

: হোয়াট? কী বলছ অর্ক?

: হুমম ঠিক বলছি! তোমার আগে আরও পাঁচজনকে আমি এভাবেই বই দিয়ে প্রপোজ করেছি। তারাও তোমার মতো আকাশ থেকে পড়েছে! বইয়ের মতো মূল্যবান সম্পদের অর্থ যারা বোঝে না, তাদের দিয়ে আমি কী করব বলো? আর আমিও নির্বোধ, আমার চোখের সামনে এমন একজন বইপ্রেমিক রেখে আমি কিনা! ঠিক আছে জেরিন! ভালো থেকো। আশা করি, কেউ একজন ডায়মন্ডের রিং পরিয়ে তোমাকে প্রপোজ করবে!

অর্ক দ্রুত বেরিয়ে গেল। জেরিন হতবাক হয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে রইল।

: হ্যালো স্পর্শীয়া! তুই কোথায়?

: আমি বইমেলায়। কেন অর্ক ভাই?

: তুই বাসায় যাসনি?

: যাব। মামি বারবার ফোন দিচ্ছে। আমি এখনই বের হব। তুমি কোথায়?

: স্পর্শীয়া তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাক। আমি আসছি!

: তুমি আসছ মানে? জেরিনকে প্রপোজ করেছ? খবর কী?

: গুষ্টি মারি জেরিনের! তুই আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমি আসছি।

: আশ্চর্য! কী হয়েছে বলবে তো?

অর্ক ফোন রেখে দিল। মাকে একটা ফোন দেওয়া দরকার। অর্ক তাড়াতাড়ি মায়ের মোবাইলে ফোন দিল। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর অর্কর মা ফোনটা রিসিভ করলেন।

: হ্যালো মা? কোথায় ছিলে? ফোন ধরছ না কেন?

: আমি কি বসে আছি নাকি? আজ স্পর্শীয়াকে দেখতে আসবে। কত কাজ!

: মা ওদের আসতে নিষেধ করে দাও।

: কেন? নিষেধ করব কেন?

: মা তোমার বয়স হয়েছে। স্পর্শীয়া সব সময় তোমার পাশে থাকে। সব কাজে সাহায্য করে বাড়ির মেয়ের মতো। আমাদের সবার খেয়াল রাখে। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের কী হবে?

: আমাদের কী হবে সেটা ভেবে একটা এতিম মেয়েকে বিয়ে দেব না?

: বিয়ে দেবে না কেন? দেবে। অত দূরে কী দরকার?

: অর্ক? তুই কী বলতে চাস, একটু সহজ করে বল তো?

: না, মানে! মা? আসলে হয়েছে কী, আমি ভেবে দেখলাম একমাত্র স্পর্শীয়াই আমাকে বোঝে! আমি যেমন বইপাগলা, ও তেমনি বইপাগলি! আমার ওকেই প্রয়োজন!

: ও! তোর প্রয়োজন পূরণ করতে স্পর্শীয়াকে চাস! ভালোবাসিস না!

অর্ক কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল, ভালোবাসি মা! অনেক ভালোবাসি! কিন্তু এত দিন বুঝিনি! সকালে যখন বললে স্পর্শীয়ার বিয়ের কথা, তখন বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল! রিকশায় বসে স্পর্শীয়ার কথায় দিব্যি বুঝতে পারছিলাম ও আমাকে কতটা ভালোবাসে! কিন্তু জেরিন আমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসেছিল। আমি মনে মনে চাইছিলাম জেরিন যেন বাকি পাঁচজনের মতো আমাকে ফিরিয়ে দেয়। জেরিন তাই করেছে মা! আমি এখন স্পর্শীয়ার কাছে যাচ্ছি। তুমি পাত্রপক্ষকে মানা করে দাও প্লিজ মা!

অর্কর মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এখন আর সম্ভব না অর্ক! অনেক দেরি হয়ে গেছে!

: দেরি হয়ে গেছে মানে?

: পাত্র নিজেও তোদের মতো বইপাগল। স্পর্শীয়া আজকের দিনে বইমেলায় গিয়েছে শুনে সে তো খুশিতে আটখানা। বলল, বইমেলাতেই স্পর্শীয়াকে আংটি পরাবে।

অর্ক আকাশ থেকে পড়ল!

: এই উজবুক আবার কোত্থেকে জোগাড় হলো? বইমেলায় কেউ আংটি পরায়?

: কেন? তুই যদি সবাইকে বই দিয়ে প্রপোজ করতে পারিস, সে কেন বইমেলাতে আংটি পরাতে পারবে না? তোরাই তো প্রপোজ ডে, প্রমিজ ডে, ভ্যালেনটাইন ডে আর কী সব ছাতামাতার ডে বানিয়েছিস!

: তাই বলে...!

: দেখ অর্ক ওলট-পালট কথা বলবি না। ক্ষমতা থাকলে ওই ছেলের আগে গিয়ে স্পর্শীয়াকে প্রপোজ কর। দেখি কে লক্ষ্মীমেয়েটাকে জয় করতে পারে!

অর্ক রাগে ফুঁসতে লাগল! ঠিক আছে মা। তোমার ছেলে আজ তার ভালোবাসাকে জয় করেই ফিরবে।

বসন্তের মাতাল হাওয়ায় চারপাশ কেমন উতলা হয়ে আছে। অর্ক বইমেলায় পাগলের মতো স্পর্শীয়াকে খুঁজছে। স্পর্শীয়ার মোবাইল বন্ধ! এত লোকের ভিড়ে কোথায় খুঁজবে স্পর্শীয়াকে? আর যদি সেই পাত্র আগেই স্পর্শীয়াকে পেয়ে যায়, তখন? ভেবেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!

হঠাৎ করে কে যেন অর্ককে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সামনে ছুটে গেল। অর্ক চিৎকার করে উঠল, কী ব্যাপার? চোখে দেখেন না?

ভারী ফ্রেমের চশমা পরা ছেলেটি অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই সরি! অনেকক্ষণ ধরে পুরো মেলায় আমার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজেছি। পাইনি! এখন দেখলাম। তাই ছুটছি। পাছে আবার না হারিয়ে ফেলি।

ছেলেটির কথায় অর্ক সামনে তাকাল। স্পর্শীয়া?

ছেলেটির হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ!

এটাই কি সেই পাত্র? মেলায় আংটি পরাতে এসেছে? উজবুক? আবার বলে আমার ভালোবাসার মানুষ! তুই কদিন চিনিস ওকে? আমি ওকে সেই পিচ্চিকাল থেকে চিনি!

: এই যে শুনছেন? অর্ক ছেলেটিকে পেছন থেকে ডাক দিল। ছেলেটির সেদিকে মনোযোগ নেই। সে তার মতো ছুটছে! অর্ক সমানতালে ছুটতে লাগল। ছেলেটির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি যার জন্য ছুটছেন, সে কিন্তু আমার!

ছেলেটির চোখ কপালে! আপনার মানে?

: জি আমার! কী মনে করেছেন? হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসবেন? আর এসব কী? বইমেলায় কেউ আংটি পরায়?

: আংটি? কিসের আংটি? যান তো মিয়া? এসব পাগল যে কোথা থেকে আসে?

ছেলেটি আবারও ছুটল!

অর্ক অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি দৌড়ে স্পর্শীয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্কর বুকে হতাশার বিস্ফোরণ! কানে বাজছে, ‘সই কেমনে বাঁধিব হিয়া, আমার বধূয়া আন বাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়া।’

অর্ক আর এক মুহূর্ত ভাবল না। শরীরের সমস্ত শক্তিকে ভর করে স্পর্শীয়ার দিকে ছুটতে লাগল। চিৎকার করে স্পর্শীয়াকে ডাকতে লাগল!

দূর হতে চেনা কণ্ঠটা কানে বাজতেই স্পর্শীয়া ফিরে তাকাল, অর্ক ভাই? পাগলা গরুর মতো ছুটে আসছে কেন?

অর্ক চিৎকার করে স্পর্শীয়াকে ডেকেই যাচ্ছে। সেই ছেলেটি আর মাত্র দু কদম আগে। দৌড় প্রতিযোগিতায় অর্ককে কখনো কেউ হারাতে পারেনি। আজও পারবে না। অর্ক ছেলেটিকে পেছনে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে স্পর্শীয়ার সামনে এসে দাঁড়াল!

স্পর্শীয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। অর্ক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল স্পর্শীয়ার সামনে, অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ‘বাংলা বিহার, উড়িষ্যার...।’

স্পর্শীয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললে?

অর্কর মাথা ঝিমঝিম করছে। কী বলতে এসে কী বলছে স্পর্শীয়াকে।

‘স্পর্শীয়া ওইখানে যেওনাকো তুমি
বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে...।’

পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল, ছেলেটি স্পর্শীয়ার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসছে। অর্ক নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে নিজেও হেসে দিল। বুকের ভেতর থেকে তীব্র আতঙ্কের বোঝাটা অপসারণ হলো!

অর্ক স্পর্শীয়ার দিকে তাকিয়ে দুই হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইল। আমায় তুই ক্ষমা করে দে। আমি চোখের সামনে তোর মতো রত্নকে ফেলে বাইরের পৃথিবীতে ছুটে বেড়িয়েছি। তোর চোখের ভাষা বুঝতে সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস! আমি নির্বোধ অন্য মেয়ের মাঝে ভালোবাসার চাষ করতে গিয়ে আমার আঙিনায় চির বসন্তের ফুলগুলোকে দেখতে পাইনি। আমি ছোটবেলা থেকে বইপোকা! বই ভীষণ ভালোবাসি। সব সময় চাইতাম আমার জীবনসঙ্গী যে হবে, সেও আমার মতো বইপোকা হবে। বইয়ের মাঝে ডুবে থাকবে। আর সে জন্যই মেয়েদের ফুল, চকলেট, আংটি দিয়ে প্রপোজ না করে বই দিয়ে প্রপোজ করতাম। আমার এই অভিনব ভালোবাসার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। সবাই আমাকে কৃপণ, রসকষহীন ভাবত! কিন্তু আমি তো সবার মাঝে ভালোবাসার আলো জ্বালাতে চেয়েছিলাম। ওই সব পার্থিব বস্তুর চেয়ে জ্ঞানের আলো কি বেশি মূল্যবান নয়?

স্পর্শীয়া অভিমানের সুরে বলল, এসব আমাকে কেন বলছ?

: তোকে কেন বলছি বুঝিস না? এই নে...। অর্ক নীল পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাইব্রেরির চাবিটা স্পর্শীয়ার হাতে গুঁজে দিল। এই নে। আজ থেকে আমার সমস্ত বই তোকে দিলাম। তুই শুধু তোর ভালোবাসার স্পর্শে আমায় জড়িয়ে রাখিস!

স্পর্শীয়ার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। মুচকি হেসে মামিকে ফোন দিল।

: মামি তোমার ছেলে এখনো পায়ের কাছে বসে আছে। লাইব্রেরির চাবি দিয়েছে, ভালোবাসা চেয়েছে কিন্তু ভালোবাসি বলেনি। কী করব?

অর্ক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে স্পর্শীয়ার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিল।

: মা? এসব কী? স্পর্শীয়া তোমাকে কেন জিজ্ঞেস করছে?

অর্কর মা হাসতে হাসতে বললেন, গর্দভ! তোর হিয়ার মাঝে আসলে কে লুকিয়ে আছে সেটাই আমরা জানতে চেয়েছিলাম। তাই একটু নাটক করলাম। স্পর্শীয়া অন্য কারও হয়ে যাবে জানার পর তোর মনের অবস্থা কী হয়, সেটাই জানতে চাচ্ছিলাম! কিন্তু এত ঘটা করে তোরা ‘ভালোবাসা দিবস’ পালন করিস, আর মেয়েটাকে ভালোবাসি বলিসনি? একটা মেয়ের হৃদয়ের আকুতি বুঝবি কবে বলত?

অর্ক স্পর্শীয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এতক্ষণ এতগুলো ভাষণ দেওয়ার পরও বুঝিসনি আমি তোকে ভালোবাসি? আবার মাকে নালিশ করলি?

: বেশ করেছি! ভালোবাসি বলনি যে!

: সব কথা কি মুখে বলতে হয়? বুঝে নিতে হয়!

: তারপরও বলতে হয়! আজ না ভালোবাসা দিবস?

অর্ক স্পর্শীয়ার দুহাত ধরে চিৎকার করে বলল, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি...। এবার খুশি তো?

স্পর্শীয়া মৃদু হেসে উত্তর দিল, ভালোবাসার বসন্ত দিনে তোমাকেও জানাই অনেক অনেক ভালোবাসা।
...

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।