গল্পটি শেষ হয়ে গেছে!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একরোখা ও রাগী ছেলেটা বিদেশে যাওয়ার পর এবং অনেকটা তার বিয়ের পরে একেবারে অর্ধেকের বেশি ঠান্ডা হয়ে গেল!

যেটা সে না বলত, তা কখনোই কারও কথায়, হ্যাঁতে পরিণত করা সম্ভব হয়নি।

এমনকি মা, এত আদর করে, নরম করে, কখনো চিল্লিয়েও বোঝাতে যেতেন। সে বুঝতই না। তার এক কথা, কঠিন কথা তা; কিছুতেই ভাঙা যাবে না।

একবার তো কোরবানের ঈদে, টাকা পয়সার একটু টানাটানি হওয়ায়, ঘরে ভাগে কোরবানি করার চিন্তাভাবনা করা হয়।

সে শুনেই লাফিয়ে ওঠে। ‘ভাগে কোরবানি! কিছুতেই না। যদি ভাগে করো, কসম খোদার এক টুকরো মাংসও মুখে দেব না আমি।’

বড় ভাইয়েরাও চেঁচিয়ে ওঠেন। ‘এক টাকা দেওয়ার মুরোদ নেই, আবার বড় বড় কথা বলিস! না খেলে না খাবি, যা।’

পরে একটু নরম হয়ে তাকে বোঝাতে যান তাঁরা। ‘সব সময় কি সবার এক যায় রে? এই বছর শুধু। তারপর দেখিস, আর কখনো ভাগে কোরবানি দিতে হবে না ভাই। দেখবি তখন দুইটা গরু কোরবানি দেব ইনশা আল্লাহ।’

প্রথম ও শেষবারের মতো ভাগে কোরবানি দেওয়া হয় সেবার। কিন্তু একরোখা, রগচটা ছেলে শফিকে কোনোভাবে এক টুকরো মাংস কিংবা মাংসের ঝোল খাওয়ানো গেলই না!

একদিন তার মা কী জানি কী জন্য কিছুক্ষণ বকাঝকা করেছিলেন। হয়তো কাজকর্ম কিছু করে না সে জন্য। এই তুচ্ছ কারণে সে এক মাস ঘরের ভাত-পানি কিছুই মুখে দেয়নি।

সারা দিন কোথাও ঘুরে রাতে এসে শুয়ে পড়ত। খেতে বললে, জবাব দিত, ‘খেয়ে এসেছি।’

ছয় ফুটের বেশি লম্বা। স্বাস্থ্যবান শফির পনেরো কেজির বেশি ওজন কমে যায়! একেবারে শুকনো হাড়–জিরজিরে হয়ে গিয়েছিল সেবার।

শেষ পর্যন্ত মা কেঁদেকেটে, এমন করলে তিনিও সঙ্গে মরে যাবেন। এমনতর ভয়ভীতি দেখিয়ে তার মুখে ভাত তুলে দেন।

দীর্ঘ এক মাস পর মায়ের হাতে খেয়েছিল। হয়তো সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল খিদে কিংবা বাইরে আর কোথাও আর ধার–কর্জ দিচ্ছিল না কেউ!

শফি যে শুধু রাগী তা কিন্তু নয়। অনেক সময় সে বাচ্চাদের চেয়েও কোমল বেশি। একবার তার মেজ ভাইয়ের ছোট শিশুকন্যার ডায়রিয়া হয়েছিল। সেকি অস্থিরতা শফির।

ভাবি আর কন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। সারা রাত কন্যাটির হাত ধরে জেগে বসে ছিল সে। আর দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছিল তার।

ভাবি মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করবেন নাকি দেবরকে সান্ত্বনা দেবেন বুঝে উঠতে পারেন না। শফির এমন রূপ যে তিনি আগে দেখেননি!

মেয়েটি সুস্থ হলে, সারা পথ কোলে বসিয়ে বাড়ি ফিরেছিল শফি।

সেই শফিকে যখন বিয়ে করানো হলো, রাগ অনেক পড়ে গিয়েছিল তার।

বিয়ের আগে, কখনোই এক টাকা উপার্জন করেনি সে। তাই বিদেশে পাঠানো হয়েছিল তাকে। সেখানেও ভালো আয় করতে পারেনি। কোনোভাবে নিজের খরচ চালাত শুধু। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে সেখান থেকেও বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয় এবং আবার বেকারত্ব!

বিয়ের পর ভাইদের এক কথায় আবার বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। বিয়ে যাকে করল, তাকেও কীভাবে ভাইদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে, এই বোধটা হয়তো তার মাথায় এসেছিল। তা ছাড়া নতুন বউ এক-আধটু ওয়াক ওয়াকও করা শুরু করছে, নিশ্চয়ই তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আসার ইঙ্গিত!

তড়িঘড়ি করে মিডলইস্টে পাড়ি দেয় সে। মনে অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। তার নিজের একটা সংসার, ভাবা যায়!

নতুন একজন অপরিচিতা তার বউ। তাকে ভালোবাসে। তার চলে আসায় চোখের পানি ফেলছে। তার অপেক্ষা করবে কথা দিয়েছে!

তাদের দুজনের রক্তে–মাংসে গড়া মিলিত একজন, নতুন একটা সৃষ্টি বড় হচ্ছে বউয়ের শরীরে। সে পৃথিবীতে আসবে একটি মনুষ্য শিশু আকারে, তাকে বাবা ডাকবে, তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে!

আহা, আহা, বুকটা নিশ্চয় শীতল হয়ে যাবে তার! নাকি ভারী হয়ে যাবে কিংবা ভরে যাবে ভালোবাসায়।

আর ভাবতে চায় না শফি। কল্পনা যত করে, কাছে পেতে ইচ্ছে করে বউকে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সংসারে।

না, এবার তার কাঁধে দায়িত্ব এসেছে। অনেক তো বসে খেয়েছে। রাগে–গোসসায় অনেক সময় ব্যয় করেছে সে। এত রাগ, গোসসা, অভিমান কোত্থেকে যে উদয় হতো! সবকিছু ভেঙে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে হতো কেন, কে জানে।

শফির চিঠি লেখার অভ্যাস নেই। কোনো দিন কাউকে দুই লাইন লেখার প্রয়োজন হয়নি তার। কোনো দিন কাউকে ভুলেও প্রেমপত্র দেয়নি। মনেও আসেনি এমন চিন্তা কখনো। এসব চিন্তা করাও যেন মানাত না তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।

কিন্তু এখন তার চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। বউ যখন ইনিয়েবিনিয়ে প্রেম ভালোবাসার কথা লেখে চিঠিতে। পেটটা একটু উঁচু হচ্ছে, শাড়ি ভেদ করে দেখা যাচ্ছে বলে লেখে, তখন তার খুব দেখতে ইচ্ছে করে! ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, পেটে কান চেপে শুনতে ইচ্ছে করে!

সে বউকে চিঠিতে তা জানায়। ভালো লাগা, ভালোবাসার কথা জানাতে ভালোই লাগে তার। কিন্তু এ–ও জানায়, সে এখন আসতে পারবে না। দুই বছরের আগে ছুটি পাওয়া সম্ভব নয়। তারপরই ভিসা লাগাতে হবে, তা–ও অনেক টাকার ব্যাপার, উপার্জন সে হিসেবে খুব কম!

বউ সান্ত্বনা দেয়, ‘বাবু যখন বাবা ডাকবে, তখনই তো আসবে। সেটা তো আরও মজার। মন খারাপ করো না। আমরা অপেক্ষায় থাকব।

শফি বউয়ের পেটে বাচ্চার বয়স হিসাব করে। আর দুই মাস পর ছেলে অথবা মেয়ে যা–ই আসুক না কেন, আলহামদুলিল্লাহ।

শফি খবর নিয়েছে, গ্রামের রফিক ভাই দেশে যাবেন। তাকে দিয়ে কিছু জিনিস পাঠানো যাবে।

সে পছন্দ করে কয়েকটা রঙিন গেঞ্জির সেট কিনে নেয়। ছেলেমেয়ে যেকোনো শিশুকেই পরানো যাবে। কাপড়ের তৈরি কয়েক জোড়া জুতো, বেবি পাউডার, অলিভ অয়েল, যেহেতু বাচ্চা শীতের সময় হবে, তাই ছোট একটা কম্বল, দুটি সোয়েটারও কিনে রাখে।

অন্যের হাত দিয়ে দেবে। প্যাকেট বেশি বড় হলে নিতে চাইবেন না আবার। তার জিনিসও তো থাকবে। এরপরেও মায়ের জন্য কয়েকটা ভিকস, বাম, মুভ ক্রিম কিনে রাখে।

বউয়ের জন্য কিছু দিতে গেলে, ভাবিদের জন্য না দিলে ভালো দেখাবে না, ওজনও বেড়ে যাবে। এই ভেবে আর কেনা হয় না।

থাক, শফি নিজে যখন যাবে, নিয়ে যাবে। বছরখানেক সময় হাতে আছে, আস্তে-ধীরে কিনে রাখবে সে। টাকাও কিছু হাতে জমুক। এই বলে সান্ত্বনা দেয় নিজের মনকে।

যথাসময়ে জিনিসগুলো মা–বউয়ের হাতে পৌঁছায়।

বউ অনাগত সন্তানকে পরাবে বলে আলমারিতে সযত্নে তুলে রাখে। তার মন গর্বে, ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায় ভরে যায় স্বামীর প্রতি।

নির্দিষ্ট সময়ে তার দু–তিন দিন ধরে হালকা হালকা ব্যথা শুরু হয়। নতুন মা হবে, বাচ্চার নড়াচড়া, গতিবিধি সে বুঝতে পারে না।

ব্যথা নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করে। কাউকে বলতেও লজ্জা লাগে!

চতুর্থ দিনে উথালপাতাল ব্যথা শুরু হয়। ঘরের অন্যান্য সদস্য বুঝতে পেরে দাই ডেকে আনেন। অনেক অনেক কষ্ট পেয়ে শফির বউ একটা মৃত শিশুর জন্ম দেয়।

বাপের মতো অনেক লম্বা হতো সে। জন্ম নেওয়া শিশুটি ছিল সাধারণ শিশু থেকে অনেক বেশি লম্বা ও স্বাস্থ্যবান। বাপের চাপা রং নয়, মায়ের উজ্জ্বল গায়ের রং নিয়ে দুনিয়াতে এসেছিল দেবশিশুটি।

এত সৌন্দর্য নিয়ে আসবি যখন, জানটা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারলি না, দুখিনী মা কাঁদেন। তাকে বাচ্চা ধরতেও দেওয়া হয় না।

দাই বলেন, ‘সেই শিশু আরও দুই দিন আগে পেটেই মারা গেছে! গায়ের চামড়া নরম হয়ে গেছে! ছুঁলে চামড়া হাতে চলে আসবে!’

আহা রে! শারীরিক কষ্ট, সঙ্গে মৃত বাচ্চা, কেমন লেগেছিল তার। পাশে স্বামীটিও নেই।

লেখিকা
লেখিকা

শফিকে সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃসংবাদ দেওয়া হয় না। বিদেশ–বিভুঁইয়ে থাকে। কষ্ট পাবে। তারও তো বাচ্চা নিয়ে অনেক আশা থাকতে পারে।

চিঠিতে জানতে চায় সে সন্তানের কথা। জবাব পাওয়ার আগেই লোকমুখে খবর পেয়ে চিল্লিয়ে কেঁদে ওঠে শক্ত মনের, সাহসী, রাগী পুরুষ শফি। তখন তার সব রাগ ক্ষোভ সাহস উড়ে গিয়ে নিজেকে খুব অসহায় নরম মনে হচ্ছিল।

দুই বছর পার হয়। শফি একটা একটা করে অনেক জিনিস কিনে রাখে। এবার সে দেশে যাবেই যাবে। নতুন ভিসাও লাগিয়েই চলে যাবে। সব ঠিকঠাক, টিকিট কাটা বাকি শুধু। কোম্পানি থেকে পাসপোর্ট নেবে, আর কোনো কাজ নেই।

শফি কাজ থেকে এসে সারা রাত স্বপ্ন দেখে। অভাগী বউটাকে একটুও কষ্ট দেবে না সে। অনেক আদর করবে। আল্লাহ চায় তো, এবার জীবিত ফুটফুটে একটা বাচ্চা আসবে তাদের।

এমন সময় দেশে শফির বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যায়। শাশুড়ি খুব বকাঝকা করেন। এবারসহ তিনবার!

এই মেয়ে কোনো কাজেরই নয়। নাকের নাকফুল কীভাবে হারায় মানুষ? তার নাকের ফুল আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি হলো, কই, তিনি তো একবারও হারাননি। আর বউটা তিনবার হারাল। কী অলক্ষুনে কথা! তার স্বামী থাকে দেশের বাইরে।

নাকে নাকফুল মানে স্বামীর পরিচয়। যেমন হিন্দুদের সিঁথি দেখে বোঝা যায়, বিবাহিতা, তেমনি মুসলমানদের নাকফুল। নাকে থাকতে হবে নাকফুল, তাতে স্বামী বর্তমান বোঝায়। কানে থাকতে হবে দুল, নয়তো কানের ছিদ্রে স্বামীর সব টাকা যে চলে যায়। হাতে থাকতে হবে চুড়ি, ভাগ্য থাকবে সঙ্গে সঙ্গে। এমনই তো জানেন তিনি।

তার শাশুড়ি তাকে শিখিয়েছেন, তিনি শিখিয়েছেন মেয়েদের, বউদের।

কথাগুলো কতটুকু সত্যি তা তিনি জানেন না, জানার চেষ্টাও করেননি। মা, দাদি, শাশুড়িরা কি আর ভুল শেখাবে!

কিন্তু এই বউটা এত অগোছালো। একটা নাকফুল সামলিয়ে রাখতে পারে না। যতবার সে নাকফুল হারায়, ততবার তাঁর বুক ধক করে ওঠে! ছেলেটা চোখের আড়ালে, কত কথা যে মনে আসে! তাই খুব বকলেন।

পুকুরপাড়ের আমগাছটার পাতাগুলোও কেমন হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। মায়ের বুক কাঁপে। শীতকাল ছাড়া এমন হলুদ তো কোনো দিন হয় না! কী অশুভ খবর তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, আল্লাহ ভালো বলতে পারবেন। তিনি নফল নামাজ আদায় করে দেন। তাঁর চারটা ছেলেই এই মুহূর্তে বিদেশে। ছোটজন কয়দিন আগে ফিরেছে। বড়জন তো দেশেই থাকে। পাঁচ মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে।

ওদিকে শফি পাসপোর্ট আনতে গেলে, তাকে বলা হয়, ‘এখন নয়, আরও কিছুদিন পরে।’

শুনেই তার মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। আগের সব রাগ ফেরত আসে। ঘরে এসে রাগে দুঃখে, দুশ্চিন্তায় সে অস্থির হয়ে পড়ে। তার সব আশা, স্বপ্ন, কল্পনা যেন মুহূর্তেই ভেঙে দিয়েছে। ‘না’ শুনবে, সে আশাই করেনি।

হঠাৎ খুব ঘাম দিতে থাকে তার শরীরে। বুকে ব্যথা হতে থাকে। সে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়।

রুমের তিন–চারজন মানুষের খবর হয়ে যায়, এত বড় শরীরটাকে আলগিয়ে হসপিটালে নিয়ে যেতে।

খবর পেয়ে মেজ ভাই অনেক দূরে তাঁর কাজের স্থান থেকে যেন দৌড়ে যান, ভাইকে দেখতে। দুই–আড়াই ঘণ্টার পথ নিজে গাড়ি চালিয়ে ছুটে যেতে চান ছোট ভাইয়ের পাশে।

তখন শফির হুঁশ ফিরে এসেছিল। চিকিৎসা করার সময় তার শরীরের কাপড় কেটে নিয়েছিলেন ডাক্তার। শফি খুব লজ্জা বোধ করে।

ভাইকে বলে, ‘আমার জন্য নতুন শার্ট আর লুঙি কিনে এনো।’

‘ঠিক আছে। এখন গিয়ে আবার যখন দেখতে আসব, সঙ্গে করে কিনে নিয়ে আসব। তুই বিশ্রাম নে। এখন তোর শরীর একটু ভালো লাগছে তো?’ ভাই জানতে চান।

‘হ্যাঁ, এখন অনেক ভালো লাগছে। হঠাৎ কী হয়েছিল বুঝতে পারলাম না।’

‘থাক, ওই সব আর ভাবিস না। শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাবি।’

মেজ ভাই চলে যান। পরদিন আবার দেখতে আসবেন। তা ছাড়া ছোট ভাইয়েরা আছে।

গভীর রাত। মেজ ভাইয়ের কাছে হাসপাতাল থেকে খবর যায়, শফি আর বেঁচে নেই!

তিনি খবরটা শুনেই চলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভাইয়ের কাছে যাবেন, তিনি পা নড়াতে পারেন না। কী শুনলেন এটা! বিকেলেই তো সুস্থ দেখে এলেন। বারবার তাঁর লজ্জামাখা মুখে নতুন জামা নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা কথাটা কানে বাজছে। ভাইয়ের শেষ চাওয়াটা যে তিনি পূরণ করতে পারলেন না!

দেশে শফির মৃত্যু খবর পৌঁছে যায়। কিন্তু কারও সাহস হয় না, মা–বাবা বা শফির বউয়ের কানে কথাটা পৌঁছাতে!

মা সেদিনও শফির বউয়ের নাকফুল নিয়ে নিজে নিজেই প্যানপ্যান করছিলেন। খালি নাক যতবার চোখে পড়ে, তার বকা দিতে ইচ্ছে করে। ঘরে আর অতিরিক্ত নাকফুল নেই যে তার নাকে পরিয়ে দেবেন। তাড়াতাড়ি একটা আনিয়ে পরিয়ে দিতে হবে।

এসব নিজে নিজে যখন বলছিলেন, ছোট ছেলে এসে বলে, মা আর বকাঝকা কোরো না তো। আর বকতে হবে না ভাবিকে।

‘কেন আর বকতে হবে না?’ মায়ের প্রশ্ন।

‘আমি অনেকগুলো নাকফুল কিনে এনে দেব, তাই।’ বলার সময় তার গলা ধরে আসে। চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা। আরও বলে, ‘মা, তাড়াতাড়ি বাজারের থলে দাও, বাজারে যাব।’

‘অসময়ে বাজার কেন?’

‘আপারা সবাই আসবে তো, সে জন্য।’

‘হঠাৎ ওরা সবাই আসবে কেন? কী হয়েছে? ওরা আসবে, আমাকে কেউ বলেনি কেন?’

তখন ঘরের পেছনের পুকুরপাড় ধরে গ্রামের নারীদের লাইন ধরে আসতে দেখা যায়। হলুদ পাতা নিয়ে আমগাছটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে!

‘অ অহিদের মা, ধৈর্য ধরো...।’

এমন কথা কেউ কেউ তাঁকে বলে বসেন।

‘কিসের ধৈর্য, কী হয়েছে আমাদের? কেউ আমাকে কিছু বলে না কেন!’

‘মা, শফি ভাই আর নেই...।’

ছোট ছেলে কান্নার জন্য কথা শেষ করতে পারে না।

মায়ের বিলাপ আর শোনে কে!

তিন দিন পর ট্রাকে করে শফির মরদেহ আনা হয়। বড় একটা বাক্সে বন্দী শফির এত বড় শরীরটা। গায়ের ওপর এত এত চায়ের পাতা!

অবিরাম বৃষ্টি পড়া শুরু হয় সেদিন। বৃষ্টির মধ্যে শফিকে শেষ গোসল দিয়ে, জানাজা পড়ে, কবরে শোয়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

কিন্তু খাটিয়ায় তার এত দীর্ঘ শরীরটার জায়গা হয় না। তাই বাক্সটিতেই আবার যত্ন করে শুইয়ে দেওয়া হয় তাকে। বাক্সের চারধারে বাঁশ বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় দূরের কবরস্থানে।

ক্লান্ত বউ তিন দিন ধরে কাঁদতে কাঁদতে কাঁদার শক্তি হারিয়ে ফেলে।

একমাত্র সন্তানটি মৃত জন্ম নিল। শফির সঙ্গে কয়েকটা মাসের সংসার শুধু। স্বামীটা তাকে একেবারে বিধবা বানিয়ে ছেড়ে চলে গেল। কারও মা, কারও বউ, আর কোনো পরিচয়ই নেই তার! তার আর কোনো গল্প থাকবে না শফির সঙ্গে!
...

ফারহানা বহ্নি শিখা: পশ্চিম লন্ডন, যুক্তরাজ্য।