বাংলা ভাষার জন্য একজন বিদেশির ভালোবাসা

ইউশি ইশি
ইউশি ইশি

ইউশি ইশি জাপান থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ছয় মাসের প্রশিক্ষণে। তিন মাসের মধ্যে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতাধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে তাঁর সংযুক্তি ছিল সব মিলিয়ে এক মাস। এর মধ্যে নকশা বিভাগে (ডিজাইন ইউনিট) তাঁর সংযুক্তি ছিল এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহেই ভিনদেশের ভিন্ন ভাষার একজন ছেলে আমার সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেলেন। তাঁর কাছ থেকেই শিখলাম কীভাবে নিজের দেশ ও ভাষাকে সম্মান করতে হয়। একটা নতুন পরিবেশে গিয়ে কীভাবে নিজেকে সেই পরিবেশের সঙ্গে মুহূর্তেই খাপ খাইয়ে নিতে হয়।

নকশা বিভাগে আমার রিপোর্টিং বস ছিলেন তাপস দাদা। বুয়েট পাস করে সরকারি চাকরি না করে হালাল জীবিকার আসায় টেলিকম সেক্টরে ঢুকেছিলাম জীবিকার তাগিদে। কিন্তু একসময় উপলব্ধি হলো টেলিকম সেক্টরের চাকরি যেকোনো সময় যেকোনো কারণে চলে যেতে পারে। তাই আগেভাগেই বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়লাম। উপজেলা পর্যায় থেকে বদলি হয়ে একসময় এলজিইডির নকশা বিভাগে থিতু হলাম। সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম, সরকারি ব্যবস্থা এত দূষিত হওয়ার পরেও কেন ভেঙে পড়ে না। হাতে গোনা কিছু সৎ মানুষ দায়িত্ব নিয়ে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছেন। তাপস দাদার কাছে থেকেই শিখলাম আসলে মানুষকে কতখানি নীতি মেনে চলতে হয়। এই মানুষটা আমার দেখা শতভাগ সৎ একজন সরকারি কর্মকর্তা। আর সরকারি ব্যবস্থায় যাঁরা সৎ থাকেন, তাঁদের সঙ্গে কেউ লাগতে যায় না। কারণ, তারা জানে, সৎ মানুষদের কোনোভাবেই বাগে আনা সম্ভব না। তাপস দাদা ছিলেন বুয়েটে আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। ছাত্র হিসেবে তুখোড় কিন্তু দেশের সেবা করবেন বলে পাস করেই সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন। আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি, তাপস দাদার মতো একজন মানুষের সঙ্গে এক বছর কাজ করেছিলাম। আমার বিদেশে আসার ব্যাপারে তাঁর সায় ছিল না। তিনি দ্বিমতও করেননি।

ইউশি ইশির সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ইউশি ইশির সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)

সেই তাপস দাদাই একদিন সকালে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইউশিকে। পরিচয় করে দিয়ে বললেন, ‘আগামী এক সপ্তাহ তোমার সঙ্গে থাকবে।’ কথায় কথায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার তাপস দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা বস ও জুনিয়র থেকে ভাই ভাইয়ে রূপ নিয়েছিল। পাশে দাঁড়ানো খর্বকায় চাইনিজ চেহারার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, হ্যালো। তার উত্তরে ইউশি পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে আমাকে বললেন, ‘আপনি কেমন আছেন?’ আমি চমকে গিয়ে থতমত খেয়ে বললাম, ‘জি, আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’ উত্তরে ইউশি বললেন, ‘জি, আমিও ভালো আছি।’

এরপর সময় দ্রুতই গড়িয়ে যেতে থাকে। আমরা সারা দিন বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগলাম। এলজিইডির নকশা বিভাগের কর্মপদ্ধতি থেকে শুরু করে কর্মের পরিধি সবকিছু সম্বন্ধে তাঁকে সম্যক ধারণা দেওয়ার একটা চেষ্টা করে গেলাম। ইউশি কোনো কিছু বুঝতে না পারলে আমাকে সব সময়ই বাংলায় প্রশ্ন করতেন। আর কোনো বাংলা শব্দ জানা না থাকলে ইউশি তাঁর ব্যাগ থেকে কী যেন একটা বই বের করে দেখে নিয়ে পুরোপুরি বাংলায় আমাকে প্রশ্ন করতেন। আমরা দ্রুতই বন্ধু হয়ে গেলাম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করে আমি ইউশিকে আমার সঙ্গে খাবার আমন্ত্রণ জানালে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলে। একজন ভদ্রমহিলা আমাদের দুপুরের খাবারের জোগান দিতেন। তাঁকে বলে দিলাম, সেই সপ্তাহ আমার জন্য দুটি করে খাবারের বাক্স দিতে।

ইউশি ইশির তোলা গ্রামবাংলার ছবি
ইউশি ইশির তোলা গ্রামবাংলার ছবি

ইউশি খুবই আগ্রহ নিয়ে আমার সঙ্গে খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল ঝালের জন্য। কারণ, তাঁরা বেশি ঝাল খেতে অভ্যস্ত নন। তাই খাবার সময় সব সময়ই পাশে পানির বোতল রাখতেন। একমুঠো করে ভাত খেতেন আর এক ঢোঁক করে পানি। এভাবে দুদিন খাওয়ার পর ইউশি ঝাল তরকারি খেতেও অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। অন্য কোনো তরকারি খেতে সমস্যা না হলেও মাছ খেতে গিয়ে ইউশি একটু বিপদে পড় গেলেন। রুই বা মৃগেল মাছ হলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইলিশ মাছ হলে তিনি আর ভালোভাবে খেতে পারতেন না। ইউশি বলতেন, ইলিশ মাছ খেতে মজা কিন্তু অনেক বেশি কাঁটা।

যা হোক, দুই–তিন দিনের মধ্যে আমার সহকর্মী আসিফ, রকিব, আবুল হায়াত ভাই, শারমীন আপু, সাজিয়া আপু, হাসিব, মাসুদ, হাসান, কৃষ্ণেন্দু, মানস ও উচ্ছ্বাস সবার সঙ্গেই ইউশির খাতির হয়ে গেল। কাজ শেষ করে আমরা একসঙ্গে কোথাও বাইরে খেতে গেলে ইউশিকেও নিয়ে যেতাম। এভাবে আমাদের সঙ্গে চলাফেরা করে ইউশি একেবারে খাঁটি একজন বাঙালি হয়ে উঠলেন। ইউশি আমাদের সঙ্গে গিয়ে ফুটপাথের চা, শিঙারা, সমুচা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, শুঁটকি ভর্তা, ধনেপাতার ভর্তা, ঝালমুড়ি, বট পরোটা—সবকিছুই খেয়ে ফেললেন। অবশ্য বট পরোটা খাওয়ার পর তাঁর পেট খারাপ হয়েছিল। এরপর আমরা তাঁকে বট পরোটা খেতে দিইনি। এক সপ্তাহ সময় দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। এরপর এলজিইডিরই অন্য অনেক বিভাগ ও প্রকল্পে ইউশি কাজ করেছিলেন। কিন্তু দুপুরে খাবার সময় হলেই আমার কাছে চলে আসতেন। তারপর আমরা খেতে খেতে আড্ডা দিতাম।

লেখককে দেওয়া ইউশি ইশির কার্ড
লেখককে দেওয়া ইউশি ইশির কার্ড

একসময় এলজিইডিতে তাঁর কাজ করার মেয়াদ শেষ হয়ে এল। ইউশি পরে অন্য একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ শুরু করলেন। সেই কাজের সূত্রে তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে চলে গেলেন। তত দিনে আমরা সবাই ফেসবুকে ইউশির বন্ধু হয়ে গেছি। তাই তাঁর প্রতিদিনের কাজকর্মের ছবিই আমরা দেখতে পেতাম। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের অকৃত্রিম জীবনধারা তাঁর খুবই ভালো লেগেছিল। প্রায় প্রতিদিনই ইউশি সেখানকার অনেক সুন্দর ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। তাঁকে দেখে তখন বোঝারই উপায় ছিল না, এই ছেলে মাত্র দুই মাস আগে জাপান থেকে বাংলাদেশে এসেছে। ইউশি সবার সঙ্গে সব সময় হাসিখুশি ব্যবহার করে মজা করে যাচ্ছেন। আর তিনি যেহেতু বাংলা বলতে পারতেন, তাই গ্রামবাংলার মানুষ তাঁকে দ্রুতই আপন করে নিয়েছিলেন। এভাবেই একসময় তাঁর ছয় মাস সময় শেষ হয়ে এল। ইউশি দেশে ফেরার সময় বিদায় জানাতে আমি তাঁর সঙ্গে ঢাকার বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম।

ইউশিকে নিয়ে লিখব—এই ভাবনা অনেক দিন ধরেই ছিল। তাই এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ভাবলাম লিখেই ফেলি একজন প্রবাসীর বাংলা ভাষাপ্রীতি সম্বন্ধে। ইউশির বাংলা বলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় যে দিক ছিল, সেটা হলো তিনি একেবারে শুদ্ধ বাংলা বলতেন। বেশির ভাগ শব্দই তিনি আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। আর বাকিগুলো বলতেন বই দেখে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই টের পেলাম, শুধু বাংলা শব্দ ব্যবহার করেও পূর্ণ বাক্য তৈরি বা মনের ভাব প্রকাশ করা সম্ভব।

আমি ইউশিকে নিয়ে লিখব ভেবে তাঁকে মেসেঞ্জারে মেসেজ দিতেই উত্তর এল। জানাল, সে এখন আছে লস অ্যাঞ্জেলেসে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশের কোন জিনিসটা তোমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে? উত্তরে ইউশি বলল, বাংলাদেশের মানুষ অতি অল্পেই সুখী ও সব সময়ই হাসিখুশি। আর বললেন, জাপানি ভাষার থেকে বাংলা ভাষাকে তার সহজ মনে হয়েছে। বাংলা বলতে পেরে তিনি সত্যিই গর্ব অনুভব করেন।

ইউশি বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। আমি তাঁকে যখন বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম, তখন উপহার হিসেবে ইউশি আমাকে একটা কার্ড দিয়েছিলেন। তার একপাশে ছিল কুস্তিগিরদের বিভিন্ন কসরতের ছবি আর উল্টো দিকে ছিল আমাকে লেখা তাঁর চিরকুট। যেখানে ইউশি ‘ধন্যবাদ’ শব্দটা বাংলায় লিখে আমাদের আবারও ঋণী করে গিয়েছিলেন।


লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>