কানাডার সিনেটে বিল এস-২৪৭ উত্থাপন

হ্যালিফ্যাক্সের মেয়র মাইক স্যাভেজের সঙ্গে প্রোক্লেমেশনসহ বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড লিটারারি সোসাইটির দুজন সদস্য
হ্যালিফ্যাক্সের মেয়র মাইক স্যাভেজের সঙ্গে প্রোক্লেমেশনসহ বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড লিটারারি সোসাইটির দুজন সদস্য

সংগীতশিল্পী রামনিধি গুপ্তের দেশপ্রেম ও মাতৃভাষাবিষয়ক বিখ্যাত সৃষ্টি, ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা মিটে কি আশা’ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিভিন্ন কৃষ্টির আবহে মাতৃভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণের গুরুত্বের কথা। ভাষার মাধ্যমে একজন মানুষ তার ভাবপ্রকাশ ঘটায়। আর মাতৃভাষার মাধ্যমেই মূলত বিকশিত হয় একটি জাতির সঠিক আত্মপরিচয়। তাই মাতৃভাষার সঙ্গে অবধারিতভাবে থাকে একটি জাতির নিবিড় যোগসূত্র। একটি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যর সঠিক প্রতিফলন ঘটে তার ভাষার মাধ্যমে। আর বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের মূল শিকড়ই হলো বাংলা ভাষা।

হ্যালিফ্যাক্স মিউনিসিপ্যালটির প্রোক্লেমেশন
হ্যালিফ্যাক্স মিউনিসিপ্যালটির প্রোক্লেমেশন

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ‘বাংলা ভাষার’ অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দেওয়ার নিরিখে উর্দুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে অধিষ্ঠিত করার এক ঘৃণ্য হীন প্রয়াস নেয়। এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের অসংখ্য মানুষ। রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে উনিশ শ বায়ান্নর রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় ঐক্যের স্বরূপ সৃষ্টি আর সব দেশপ্রেমী জনতাকে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ করে। পাকিস্তানি শাসক–সমর্থিত পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে প্রতিবাদী ছাত্র ও জনগণের ওপর। গুলিতে নিহত হয় শুদ্ধ দেশপ্রেমের আদর্শে লালিত অনেক উজ্জ্বল অমূল্য প্রাণ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের প্রিয় ভাষা ও মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার এবং আত্মত্যাগের এক বিরল ঐতিহাসিক অধ্যায়কে সৃষ্টি করে। যার পরম্পরায় উনিশ শ একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাংলাদেশিদের প্রতি অসহযোগিতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১৬ ডিসেম্বর আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এসেছে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা।

মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত
মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত

বিশ্ব দরবারে ২১ ফেব্রুয়ারির মহান আত্মত্যাগের এই অবিস্মরণীয় ইতিহাসকে যথাযথ স্বীকৃতি দানের প্রয়াস ও দিনটির মাহাত্ম্য অটুট রাখার তাগিদে, মাতৃভাষার সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবনে করে প্রবাসে যে আলোকিত ব্যক্তিত্ব প্রথম স্বদেশপ্রেম ও ভাষাপ্রীতির স্বাক্ষর রেখেছেন, তিনি কানাডাপ্রবাসী নিবেদিত প্রাণ বাঙালি ও বাংলাদেশের কৃতি সন্তান রফিকুল ইসলাম। দেশে ও প্রবাসে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী সুবিস্তৃত (মাতৃভাষাপ্রেমী ও এর প্রতি অনুরাগী সম আদর্শের ব্যক্তি ও সংগঠনের সহযোগে) কর্ম উদ্যোগ ও নিরলস ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই জাতিসংঘের ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দান করে।

ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ দিনটি যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনসহ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের অনন্য এই ইতিহাস যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই দিকটি এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়।

মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত
মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত

এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর অন্য অনেক দেশ ও শহরের মতো কানাডাতেও বিভিন্ন স্তরে (যেমন প্রাদেশিক ও মিউনিসিপ্যালটি) বিগত বেশ কয়েক বছরে এ দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার লক্ষ্যে সরকারিভাবে স্বীকৃতিদানের ঘোষণা (প্রোক্লেমেশন) দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, এ স্বীকৃতি আদায়ে দেশের বাইরে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ও তাদের পরিচালিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোই সব সময় সর্বাগ্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের অনেক মিউনিসিপ্যালটির স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক প্রোক্লেমেশন জারি করে পালন করা শুরু করেছে। বিগত দুই বছরে কানাডার রাজধানী অটোয়াতে বাংলা ক্যারাভান ও পিস (নভেম্বর ২০১৭), হ্যালিফ্যাক্সে কানাডা-বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড লিটারেরি সোসাইটি (ফেব্রুয়ারি ২০১৮) এবং টরন্টোতে অর্গানাইজেশন ফর টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে মনুমেন্ট ইনক (ফেব্রুয়ারি ২০১৮) কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের ফলে উল্লেখিত শহরগুলোর মিউনিসিপ্যালটিগুলো এই প্রোক্লেমেশন জারি করে।

মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত
মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত

এরই ধারাবাহিকতায় কানাডিয়ান সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটে বিল এস-২৪৭ (bill s-247) বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিলটি বর্তমানে সিনেট সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিটিতে নিরীক্ষাধর্মী রয়েছে। এই বিলটি আইন হিসেবে সংসদে পাস হওয়ার সমর্থনে জনমত সৃষ্টি করতে কানাডায় বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীরা সমগ্র কানাডা জুড়েই যথারীতি নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত
মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত

সম্প্রতি এ মাতৃভাষা দিবস বিলের স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির প্রয়াসে হ্যাশট্যাগ (#) ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ (#EnactIMLDbillS-247) গ্রহণ করে কানাডার অটোয়াভিত্তিক সংগঠন বাংলা ক্যারাভান ও পিস। এ যাত্রায় তাদের সহযাত্রী হয়ে মাতৃভাষা দিবসের এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, টরন্টো, হ্যালিফ্যাক্স আর মন্ট্রিয়লসহ কানাডাজুড়ে আরও বিভিন্ন সমমনা সম-আদর্শিক মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তার ও এই দিবস রক্ষার আদর্শে ব্রতী বাঙালি সংগঠনগুলো। একই সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হয় কানাডার অন্য কমিউনিটির সংগঠনসমূহ। সমমনা এ সংগঠনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কয়েকটি সংগঠন হচ্ছে: মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস ফাউন্ডেশন (ভ্যাঙ্কুভার), কানাডা-বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড লিটারেরি সোসাইটি (হ্যালিফ্যাক্স), বাকাওভ–অটোয়া, বিসিসিবি–টরন্টো। এ ছাড়া, এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে অটোয়াভিত্তিক আফ্রিকান অ্যাসোসিয়েশন, প্যালেস্টাইন অ্যাসোসিয়েশন, তামিল সংঘ ও বেঙ্গলি কমিউনিটি সার্ভিস সেন্টার ইত্যাদি। একই সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে মন্ট্রিয়ল অ্যাসোসিয়েশন, সিবিএমসি আর ইনডিজেনাস ডাকোটা ইয়ুথ ফোরাম।

মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত
মাতৃভাষা বিলের সপক্ষে বাংলা ক্যারাভান ও পিসের নানা কার্যক্রমের একটি মুহূর্ত

প্রগতির ও বহুজাতিক সংস্কৃতির আদর্শে লালিত দেশ কানাডায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসবে পূর্ণ মর্যাদায় পালনের নিমিত্তে সিনেটর মুবিনা জাফর কর্তৃক আনীত বিল এস-২৪৭ পাস করার প্রয়াসে বাংলা ক্যারাভ্যান ও পিস–এর সঙ্গে দীর্ঘ এ পরিক্রমায় উপরিউক্ত সকল সংগঠনগুলোই সর্বদা কর্মমুখর থেকেছে। কানাডার প্রবাস জীবনে ব্যতিক্রমী পরিমণ্ডলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাতৃভাষা দিবস ও মাতৃভাষার স্বীকৃতি রক্ষার্থে মূল সংস্কৃতির ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াসে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ প্রকৃতপক্ষে একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের এই উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়।