আমার একুশ

বাঙালি জীবনে ফেব্রুয়ারির ‘একুশ’ এক অমিয় বিষাদের নাম। একুশ কেবল বর্ণমালার যূথবদ্ধ একটি শব্দের গাঁথুনি নয়, একটি গভীর অনুভূতির নাম। শহীদের রক্তে রাঙানো শিমুল-পলাশের এই ফাগুনে দ্বিগুণ আগুন জ্বেলেই বীর বাঙালি প্রতিষ্ঠা করেছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা নিজের ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। একুশ আমাদের প্রাণের গভীরের এক শক্তির নাম। এক অনির্বচনীয় বেদনায় যে ভালোবাসা লালন করি বুকের গহ্বরে, একুশ তারই অনন্ত প্রকাশ। একুশের অহংকার ধারণ করেই প্রতিদিন একটু একটু বেড়ে ওঠা। আমাদের হৃদয়ের গোপন মণিকোঠায় দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসায়, বোধে, আমাদের জাগ্রত বিবেকে একুশ সদা সচেতন রয়।

দীর্ঘ জীবনের পথপরিক্রমায় আজও মন পড়ে রয় শৈশবের ধূলি-কাদাময় মলিন পথের ছায়ায়। যেখানে আদিগন্ত আকাশের সীমানায় আমাদের স্বপ্নের ঘুড়িরা উড়ে বেড়াত। যার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমাদের কৈশোর-যৌবনের প্রারম্ভের দিনগুলো কেটেছে, একুশ সেসবের দীর্ঘ তালিকায় অনিবার্যভাবেই বারবার এসেছে। পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে, স্কুলই ছিল তখন সামাজিকীকরণের প্রথম ও একমাত্র অঙ্গন। প্রতিদিনের আনন্দ-বেদনার, সুখ-দুঃখের, ভালো-মন্দের এই যে জীবন আজকে যাপন করছি, তার সূতিকাগার তো ছিল সেই বিদ্যালয়ই। শিক্ষকদের পরম মমতা, ভালোবাসা আর শাসনের সুরে যে শিক্ষাদান, তা বইয়ের পাতা ছাড়িয়ে মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিল বিনা বাধায়। সেভাবেই এক পা-দু পা করেই আমাদের তিল তিল বেড়ে ওঠা। মনুষ্য শিশুকেই কেবল বেড়ে উঠতে হয়; ভেতরে, বাইরেও। আমাদের গাঁও-গেরামের জীবনে সেই মানুষ হয়ে ওঠার যুদ্ধে শিশুর সারথি ছিল স্কুল।

মনে পড়ে, একুশ একটি কাকডাকা ভোর। কুয়াশাঘেরা ধোঁয়াশা সকাল। পাকা ধানের গা মাড়িয়ে আলপথ ভেঙে মাঠের বুক চিরে খস খস শব্দে নগ্ন পায়ে হেঁটে চলার দিন। আমাদের জীবনে কেবল একটি ক্যালেন্ডারের তারিখেই সীমাবদ্ধ ছিল না সেই দিন। বহু কাঙ্ক্ষিত সেই দিনের পেছনে কত আবেগ, ভালোবাসা, রাত জাগার মতো কত পরিশ্রম জড়িয়ে ছিল। একুশ উদযাপনের জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত কমিটি গঠন করা হতো। যারা একুশকে ঘিরে যাবতীয় পরিকল্পনা করতেন একটি সমন্বিত উদ্যোগে এবং চূড়ান্ত দিনে প্রভাতফেরি শেষে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটত। সেই সুবিশাল আয়োজনে আমাদের ছিল না সেলফি, ছবি আপলোডিং। ফেসবুকিং কিংবা গুগল সার্চের বদৌলতে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করার সুযোগ। সেই জীবনে একুশকে ঘিরে যে ভালোবাসা আবর্তিত হতো, তার নিগূঢ় যে সত্য ছিল তা হলো, এই দিন বীর শহীদদের এই পুণ্যভূমিতে নগ্ন পায়ে হাঁটার দিন। সুন্দর করে ফুলের তোড়া বাঁধার প্রতিযোগিতার, আর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করে ছোট্ট এই বুকে একুশকে ধারণ করার দিন।

দিন পনেরো আগে থেকেই নিয়ম করে একাডেমিক ক্লাস শেষে চলত রিহার্সাল। রিহার্সালে কবিতা পাঠ, বক্তৃতা (একুশের উচ্চারণে), বিতর্ক ও গান ছিল আয়োজন ডালিতে। বক্তৃতার জন্য ঐতিহাসিক দলিল থেকে তথ্য সন্নিবেশ করা হতো। স্বরচিত কবিতা পাঠ, রচনা ও প্রবন্ধ প্রতিযোগিতাও ছিল উল্লেখযোগ্য। এর সবই দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের গাইডেন্সে চূড়ান্ত করা হতো। ছাত্র-শিক্ষকদের কর্মযজ্ঞের এই যে মিলনমেলা, তা আনুষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে চেতনার সম্মিলিত বাতায়নেই করাঘাত করত নির্দ্বিধায়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফেব্রুয়ারির হিমশীতল নীরবতা ভেঙে ভোরের সূর্য যে একুশ নিয়ে আসত আমাদের জীবনে, তাকে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিতাম। শহুরে জীবনের মতো চাইলেই আমরা তখন রাশি রাশি ফুল কিনে শহীদ মিনারের বেদিতে অর্পণ করতে পারতাম না। আমাদের নিজস্ব আঙিনার ফুলই ছিল তখন একমাত্র ভরসা। আগে থেকেই ঠিক করা থাকত, যাদের বাড়িতে ফুল আছে তারা একুশের আগের দিন সন্ধ্যায় পুষ্পমাল্য তৈরির কাজ সম্পন্ন করবে। যদিও মেয়ে বলে সন্ধ্যা অবধি সেসব কাজে যুক্ত হতে হয়নি আমায়।

খুব ভোর থেকেই ডেকোরেটরের লোকেরা এসে আগের দিনে পুঁতে রাখা বাঁশের সঙ্গে শামিয়ানা টাঙিয়ে শহীদ মিনারের বেদি ঘেঁষে মঞ্চ নির্মাণের কাজ শুরু করে দিতেন। স্কুলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় আধা মাইলের মতো রাস্তা হেঁটে, সমস্বরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গেয়ে প্রভাতফেরি সম্পন্ন করতাম আমরা। কৈশোরের সেই অবোধ দিনগুলোতেও একইভাবে এই গান গাইতে গিয়ে আমার গলা বুজে আসত, ঝাপসা হয়ে আসত চোখ। লোমকূপের গোড়াগুলো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। সেই একই রকম অনুভবের অনুরণন আজও শুনি গহন দ্বারে।

সে সময় আমাদের বড় অপছন্দের বিষয় ছিল বড় বড় লোকেদের ভারিক্কি ভারিক্কি বক্তব্য। অতি অপছন্দের আলোচনা অনুষ্ঠানের সমাপ্তির প্রত্যাশায় আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলেই আমাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। সুনসান নীরবতা, পিনপতন নিঃশব্দে আমরা ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’...এসব কালজয়ী গানের সুরের মূর্ছনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতাম। মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বিখ্যাত কবিতাগুলোও আমাদের বোধের ভেতরে ঘা দিয়ে যেত। এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়... কবিতায় আর কী বলব, যখন বুকের রক্তে লিখেছি একটি নাম বাংলাদেশ...এসব আবৃত্তি শুনতে শুনতে বুকের গহ্বরে অবিমল ভালোবাসার এক সুবিশাল ক্ষত তৈরি হতো। খুব বেশি ইতিহাস, দলিল দস্তাবেজ না ঘেঁটেও সেই শৈশবেই ভালোবাসায়, বোধে, চেতনায় ধারণ করতে শিখেছিলাম মহান একুশকে।

শহুরে স্কুলগুলোতে তখন কীভাবে, কেমন করে এই দিবস উদযাপন হতো, জানা ছিল না। তবে, শিক্ষায়তনে না হলেও হয়তো ভিন্ন আঙ্গিকে শিশুরা একুশের প্রভাতফেরিতে অংশ নিত এবং নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মসূচির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতো। তবে, আমি হলফ করে বলতে পারি, আজকের নগরজীবনের (ঢাকায়) স্কুলগুলোতে এই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় না। এটি স্রেফ একটি সরকারি ছুটির দিন। এই দিনে মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও আয়োজন করে নানাবিধ অনুষ্ঠান, যার অনেক কিছুই আমাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার বাইরে। অর্থাৎ এই প্রজন্মের এসব অনুষ্ঠানে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকছে না।

লেখিকা
লেখিকা

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছর দু-এক আগে একটি টিভি রিপোর্টে আমাদের জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলেমেয়েদের কিছু অতি সাধারণ প্রশ্ন করা হয়েছিল দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা ইত্যাদি বিষয়ে, যেখানে অতি উল্লেখযোগ্য হারে ভুলভাল জবাব দিয়েছিল তারা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জানা নেই বলে নিরুত্তর ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই যে অজ্ঞতা এর থেকে আমরা কী তথ্য পাই? সে কি কেবলই শিশুদের দায়? নাকি আমাদেরও কিছু দায় আছে? আজকাল আমাদের শহুরে স্কুলে জাতীয় সংগীত গাওয়ার রেওয়াজই নেই। আর সৃজনশীলতার দৌলতে এর রচয়িতার নাম যদি প্রশ্নব্যাংকে না থেকে থাকে, তবে শিশুদের শেখার দায় কতটুকু? আমাদের শৈশবে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি একটা শপথনামাও পাঠ করতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন...’ বলতে গিয়ে নয়ন জলে ভাসাটাই ছিল অনিবার্য। ঠিক একইভাবে শপথনামা পাঠ করতে গিয়ে ভেতরে যে দৃঢ়তা অনুভব করতাম, সেই স্বপ্নের আলোয় দুই চোখ চিকচিক করত। এসব বিষয় কেউ জোর করে মগজে সেঁটে দেয়নি তখন। আমার মতো করে আমার বন্ধুদেরও এমন হতো বলেই আমি বিশ্বাস করি! আর সেই মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার দায় নিয়েছিলেন আমাদেরই পূর্বসূরিরা!

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, করপোরেট বিশ্বের মুনাফার অর্জনের হাতিয়ার আজ আমরা, আমাদের বিশেষ দিবস, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সবকিছুকেই এমনভাবে গ্রাস করেছে, লুফে নিয়েছে আমাদের আবেগ, প্রেম, ভালোবাসা, আমাদের চিন্তার জগৎকে করেছে সংকীর্ণ, যার থেকে বেরোনোর উপায়ই নেই। আমাদের স্কুলে জাতীয় সংগীত গাওয়া না হলেও বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে আমরা জাতীয় সংগীত গাই, পতাকা ওড়াই, অতঃপর আমরা গিনেস বুকেও নাম লেখাই; হয় রবি, নয় গ্রামীণ, নয় শাহ সিমেন্টের নামে! ভাষার মাসে ভাষার গানের রিং টোন ব্যবহার করি, টি-শার্টে, শাড়িতে, পাঞ্জাবিতে, গয়নায়, আচারে-বিহারেই তো একুশ থাকে। একে আলাদা করে ধারণ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করি না আমরা। এই অনুভবহীনতাই আমাদের বোধের ভেতরে তুলেছে দেয়াল। ভুলতে বসেছি ইতিহাস-ঐতিহ্য। শিকড় ভুলে আমরা এক অদ্ভুত মোহের মধ্যেই দিন যাপন করছি!

আসুন সবাই মিলে আমরা এই বোধহীনতার দায় কাঁধে তুলে নিই। কেবল করপোরেটের পণ্য প্রসারের গুটি হয়ে নয়, আমাদের গৌরবের এই ইতিহাস ছুঁয়ে দিয়ে যাই আমাদের সন্তানদের চেতনার মর্মমূলে। একুশের তাৎপর্য ও প্রতিদিনের জীবনযাপনে এর উপস্থিতি অনুভবে, উপলব্ধিতে নিয়ে আসি। রাষ্ট্র থেকে সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিগত পরিসরেই এই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি এখন। অন্যথায় একটি বোধহীন, অসাড় প্রজন্ম ধীরে ধীরে বিশাল শূন্যতার গহ্বর নিয়ে বেড়ে উঠবে, যা আমাদের এই অর্জনকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্নই করে দেবে। একুশের প্রাক্কালে সব ভাষাশহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চলুন শুরু করি এই মহান কাজটি এবং নিজের ঘর থেকেই! একটি জাগ্রত সুন্দর স্বপ্নের আগামীর জন্য চলুন আরও একবার একাত্ম হই!